কোরবানির পশুর চামড়া বেচাকেনায় অব্যবস্থাপনা চলছে বেশ কয়েক বছর ধরে | ফাইল ছবি |
গোলাম মওলা: এবারের কোরবানি ঈদে কাঁচা চামড়া কেনা ও সংরক্ষণে ট্যানারিগুলোতে অর্থায়ন বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে ব্যাংকগুলো। গত বছরের চেয়ে অন্তত ১০ কোটি টাকা বেশি ঋণ পাবেন ট্যানারি মালিকরা। তবে বিগত কয়েক বছরের মতো এবারও সরকারের বেঁধে দেওয়া দামে পশুর কাঁচা চামড়া বিক্রি করা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
চামড়া শিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যবসায়ী উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সাভারে চামড়া শিল্পনগরী গড়ে তোলার পর থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়ার দাম বাড়লেও বাংলাদেশের বাজারে চামড়ার গুরুত্ব কমেছে। ব্যাংকও চামড়া খাত থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, সাভারে চামড়া শিল্প স্থানান্তরের পর উৎপাদনে যাওয়ার মতো সক্ষমতা অনেকেরই ছিল না। এতে ব্যবসা হারিয়ে খেলাপি হয়ে যান অনেকে। খেলাপি বাড়ায় চামড়া খাতের ব্যবসায়ীদের ঋণ দিতে আগ্রহ কমিয়েছে ব্যাংকগুলো।
ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত চামড়া খাতে বকেয়া ঋণ ৮ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ক্রিসেন্ট গ্রুপের একাই ৫ হাজার কোটি টাকা, বাকি সব ট্যানারিগুলোতে ৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ বকেয়া আছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চামড়া খাতে বর্তমানে ব্যাংকগুলোর মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ৫ হাজার ১২২ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে ৪ হাজার ১৪৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ মোট ঋণের প্রায় ৯১ শতাংশই খেলাপি। বাকি ৯ শতাংশ ঋণ নিয়মিত রয়েছে। এর মধ্যে সরকারি ব্যাংকগুলোয় বিতরণ করা ঋণের ৯২ শতাংশই খেলাপি। খেলাপি ঋণের ৯৬ শতাংশ অনেক পুরোনো। এগুলোর মধ্যে ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকা আদায় করতে না পেরে ব্যাংক অবলোপন করেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসেবে চামড়া খাতের রফতানিতে ঋণ দেওয়া হয়েছে ২ হাজার ২০০ কোটি টাকা, চামড়াজাত পণ্যে ঋণ দেওয়া হয়েছে ৬০০ কোটি টাকা। বাকি টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে শিল্পঋণ ও চলতি মূলধন হিসাবে।
আশির দশকে এ খাতে যেসব ঋণ দেওয়া হয়েছে, সেগুলোর প্রায় সবই এখন খেলাপি। নব্বইয়ের দশকে কিছু ভালো উদ্যোক্তা এসেছেন, তারা এখন এ খাতের সফল ব্যবসায়ী। মূলত তাদের ঋণই নিয়মিত রয়েছে।
চামড়া ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, ২০১৭ সালের পর থেকে ট্যানাররা ভালো নেই। অনেক ব্যবসায়ী খেলাপির তালিকায় পড়েছেন। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে সাভারে ট্যানারি শিল্প স্থানান্তর। অন্যদিকে, গত কয়েক বছরে চামড়া শিল্পে যাদের ঋণ দেওয়া হচ্ছে, তাদের বেশির ভাগের ঋণই পুনঃতফসিল করা হচ্ছে। তাই এ খাতের ব্যবসায়ীরা এখনও ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারছেন না। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে কাঁচা চামড়া কেনার ক্ষেত্রে। কয়েক বছর কাঁচা চামড়া বিক্রি করতে না পেরে মাটিতে পুঁতে ফেলার ঘটনাও ঘটেছে। তবে গত দুই বছরে সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে কম দামে কাঁচা চামড়া বিক্রি হলেও মাটিতে পুঁতে ফেলার ঘটনা আর শোনা যায়নি।
ধারণা করা হচ্ছে, এবারও সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে কম দামে কাঁচা চামড়া বিক্রি করতে হবে কোরবানিদাতাদের। মৌসুমি ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, তারা গত বছর কোরবানির পশুর চামড়া সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে কিছুটা কম দামে কিনছেন।
পাবনার মৌসুমি ব্যবসায়ী রইচ উদ্দিন বলেন, সরকার নির্ধারিত দামে কাঁচা চামড়া কিনলে লাভ হবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে। কারণ পরিবহন খরচ, লবণের দাম ও শ্রমিকদের মজুরি গত বছরের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে।
যদিও ট্যানারি মালিকরা বলছেন, সরকার নির্ধারিত দামে কাঁচা চামড়া কিনলে মৌসুমি ব্যবসায়ীদের লোকসান হবে না।
প্রসঙ্গত, গত বছর কোরবানির ঈদে বড় আকারের (৩০-৩২ বর্গফুট) গরুর চামড়া ৯০০ টাকা ও মাঝারি আকারের (২০-২২ বর্গফুট) চামড়া ৬০০ থেকে ৭০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। ছোট গরুর চামড়া ৫০০ টাকা, ছাগলের চামড়া ৫০ থেকে ৬০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
গত বছর কোথাও কোথাও বড় আকারের (৩৫ বর্গফুট) গরুর চামড়া ১২০০ টাকা, মাঝারি আকারের (২২-২৫ বর্গফুট) ৮০০-৯০০ টাকা এবং ছোট আকারের গরুর চামড়া ৪০০ থেকে ৫০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
সাধারণত মসজিদ বা মাদ্রাসায় পশুর চামড়া দান করেন অনেকে কিংবা কোরবানির স্থলে আগত পাইকারদের কাছে বিক্রি করেন। পাঁচ বছর আগেও একটি পূর্ণবয়স্ক গরুর চামড়া প্রায় দুই থেকে আড়াই হাজার টাকায় বিক্রি করা যেতো। অথচ এক দশকে চামড়ার জুতার দাম উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে! এবার ঢাকায় সরকার কর্তৃক প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত চামড়ার নির্ধারিত বিনিময় মূল্য ধরা হয়েছে ৫৫ থেকে ৬০ টাকা, ২০১৩ সালে যা ছিল ৮৫ থেকে ৯০ টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ট্যানারিগুলোকে এবার ২৭০ কোটি টাকা ঋণ দেবে ব্যাংকগুলো। এই ঋণ গত বছরের চেয়ে ১০ কোটি টাকা বেশি। যদিও ব্যবসায়ীরা বলেছেন তা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম।
বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. শাহীন আহমেদ বলেন, বাংলাদেশে চামড়ার বাজার দেড় থেকে দুই হাজার কোটি টাকার। সেই বাজারের জন্য মাত্র ২৭০ কোটি টাকা। এত বড় বাজারে কোনোভাবে এর প্রভাব পড়বে না। এছাড়া অনেকেই ঋণ খেলাপি হয়ে গেছে। সঠিকভাবে সঠিক সময়ে টাকা পরিশোধ করতে পারেনি। এর ফলে দেখা গেছে যে মাত্র ১০-১৫টি প্রতিষ্ঠান এই সুবিধা পায়।
ট্যানারি মালিকরা প্রতিবছর নিজস্ব মূলধনে ব্যবসা করলেও কোরবানির সময় নগদ অর্থের জন্য বিশেষ ঋণের প্রয়োজন হয়। এবার তাদের চাহিদা মেটাতে সবচেয়ে বেশি ঋণ দেবে চারটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক— সোনালী, জনতা, রূপালী ও অগ্রণী। বাকি ঋণ দেবে বেসরকারি ব্যাংকগুলো।
বিগত বছরগুলোর মতো এবারও বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএ) গত বছরের চেয়ে বেশি ঋণ সহায়তা চেয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে। গত বছর ব্যবসায়ীরা অন্তত ৫০০ কোটি টাকা ঋণ চাইলেও পেয়েছেন তার মাত্র অর্ধেকের একটু বেশি। অর্থাৎ ২৫৯ কোটি টাকা। তবে ২০২২ সালে ঋণের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি ছিল, ৪৪৩ কোটি টাকা।
মুসলমানদের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব ঈদুল আজহায় প্রায় এক কোটির বেশি পশু কোরবানি দেওয়া হয়। সরকার হিসেবে, এবার ১ কোটি ২৯ লাখ ৮০ হাজার ৩৬৭টি গবাদি পশু কোরবানির জন্য প্রস্তুত রয়েছে। এ মৌসুমে সংগ্রহ করা এই কাঁচা চামড়ার বাজারমূল্য প্রায় ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।
গত ১২ মে শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূনের সভাপতিত্বে এক সভায় বিটিএ সভাপতি মো. শাহীন আহমেদ বলেন, কাঁচা চামড়া ক্রয় ও সংরক্ষণের জন্য কোরবানির আগে বার্ষিক যে ঋণ দেওয়া হয়, এটা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম।
বিটিএর তথ্যমতে, বর্তমানে ট্যানারি মালিক ও বাণিজ্যিক রফতানিকারক মিলিয়ে সংস্থাটির সদস্যসংখ্যা প্রায় ৮০০। সারা দেশে ১ হাজার ৮৬৬ জন বড় ও মাঝারি চামড়া ব্যবসায়ী রয়েছে। এর বাইরে মৌসুমি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ঈদুল আজহায় পশুর চামড়া সংগ্রহ করেন, এমন অনেক এজেন্ট আছেন।
রাজধানীর পোস্তা, নাটোর বাজার, যশোরের রাজারহাট, গাইবান্ধার পলাশবাড়ী, রংপুরের তারাগঞ্জ, নওগাঁ, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, কিশোরগঞ্জ, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, আমিনবাজার ও টঙ্গী-গাজীপুরের আড়তগুলোতে কাঁচা চামড়া সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও মজুত করা হয়।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রায় ২০০টির মতো ট্যানারি আছে। এর মধ্যে ১২৭টি আছে সাভারের চামড়া শিল্প নগরীতে।