আওয়ামী লীগ

নিজস্ব প্রতিবেদক: জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পুরোপুরি পাল্টে যায়। বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠদের অনেকেই যোগ দেয় খুনিদের সঙ্গে। বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া দল আওয়ামী লীগেও দেখা দেয় ভাঙন। তা অব্যাহত থাকে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দেশে ফেরার পরও। তবে শেখ হাসিনা তার দৃঢ় নেতৃত্বে আবার দলকে ঐক্যবদ্ধ করেন। তার নেতৃত্বে দল এখন অতীতের যেকোনও সময়ের চেয়ে ঐক্যবদ্ধ।

জাতির পিতাকে হত্যার পর অনেক ত্যাগী নেতাকে নানান প্রলোভন এবং অত্যাচার-নির্যাতন করেও টলানো যায়নি। বিপরীতে ভীরু ও পদলোভী বেশকিছু নেতা খুনি মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়ে আওয়ামী লীগকে চাপে ফেলে দেয়।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের প্রায় এক বছর পর ১৯৭৬ সালের ২৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের সাবেক কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সদস্যদের বর্ধিত সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবে মহিউদ্দিন আহমেদ এবং ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সাজেদা চৌধুরীর নেতৃত্বে দলীয় কার্যক্রম ও মিজানুর রহমান চৌধুরীকে আহ্বায়ক করে গঠিত প্রস্তুতি কমিটি একযোগে কাজ চালিয়ে যাবে বলে সিদ্ধান্ত হয়। ওই সভায় ৩১ আগস্টের মধ্যে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নামে দলকে পুনরুজ্জীবিত করার লক্ষ্যে গঠনতন্ত্র জমা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এর সূত্র ধরে ১৯৭৬ সালের ৪ নভেম্বর আওয়ামী লীগ আনুষ্ঠানিকভাবে নিবন্ধন লাভ করে। পরে ১৯৭৭ সালের ৩ ও ৪ এপ্রিল হোটেল ইডেনে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে ঐকমত্যের ভিত্তিতে কমিটি গঠন সম্ভব না হওয়ায় সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দিনকে আহ্বায়ক করা হয়। তাকে নেতাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে ১০ দিনের মধ্যে ৪৪ সদস্যের একটি সাংগঠনিক কমিটির নাম ঘোষণার দায়িত্ব দেওয়া হয়। কারারুদ্ধ নেতারা মুক্তিলাভের পর কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হবেন বলেও সিদ্ধান্ত হয়।

১৯৭৮ সালের ৩ থেকে ৫ এপ্রিল তিন দিনব্যাপী আওয়ামী লীগের সম্মেলনে আব্দুল মালেক উকিলকে সভাপতি এবং আব্দুর রাজ্জাককে সাধারণ সম্পাদক করা হলে মিজানুর রহমান চৌধুরী এই কমিটিকে অগ্রহণযোগ্য আখ্যা দেন। পরে মিজান চৌধুরী ওই বছরের (১৯৭৮) ১ আগস্ট দেওয়ান ফরিদ গাজীকে নিয়ে আলাদা আহ্বায়ক কমিটি গঠন করেন। তাদের সঙ্গে যোগ দেন অনেকে। ফলে আওয়ামী লীগ স্পষ্টত দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। এ সময়ে আওয়ামী লীগে মোজাফফর হোসেন পল্টুর নেতৃত্বে আরেকটি ভগ্নাংশ বেরিয়ে যায় এবং সেটিও আওয়ামী লীগ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

পঁচাত্তর পরবর্তী আওয়ামী লীগের বিভক্তি সম্পর্কে লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমেদ তার ‘আওয়ামী লীগ: উত্থান পর্ব ১৯৪৮-১৯৭০’ বইয়ে লিখেছেন, “শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হওয়ার পর আওয়ামী লীগ মোটামুটি ছন্নছাড়া হয়ে গিয়েছিল। দলের মধ্যে ছন্দটা হারিয়ে গিয়েছিল। মিজানুর রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বে আলাদা আওয়ামী লীগ— এমন পরিস্থিতিতে দল আবার ভাঙার অবস্থা হয়েছিল।”

১৯৮১ সালের ১৩ ও ১৫ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় হোটেল ইডেনে। এই কাউন্সিল অধিবেশনে সর্বসম্মতভাবে আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে শেখ হাসিনাকে নির্বাচিত করা হয়। আর সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত করা হয় আব্দুর রাজ্জাককে। ১৯৮১ সালের ১৭ মে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দলীয় সভাপতি হিসেবে দেশে ফিরে কয়েক ভাগে বিভক্ত আওয়ামী লীগকে ঐক্যবদ্ধ করেন।

শেখ হাসিনার দলের নেতৃত্ব গ্রহণ সম্পর্কে মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, দলকে এক রাখার জন্যেই দলের কয়েকজন নেতা দিল্লিতে গিয়েছিলেন শেখ হাসিনার সঙ্গে পরামর্শ করতে এবং তারা তাকে রাজি করান সভাপতির পদ নিতে।

শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দলের মধ্যে নেতাকর্মীরা উৎসাহ পেয়েছিলেন বলেও উল্লেখ করেন এই লেখক।

এদিকে দলের সভাপতির দায়িত্ব নিয়ে দেশে এলেও শুরুর দিকটায় দলকে ঐক্যবদ্ধ করতে বেশ বেগ পেতে হয় শেখ হাসিনাকে। রক্তের উত্তরাধিকার ও আদর্শের উত্তরাধিকার ইস্যুতে টানাপড়েন শুরু হয়।  আদর্শের উত্তরাধাধিকার দাবিদাররা শেখ হাসিনার নেতৃত্বকে মেনে নিতে রাজি ছিলেন না। এরই জের হিসেবে শেখ হাসিনা দেশে ফেরার দুই বছরের মাথায় তারই সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক আওয়ামী লীগ ত্যাগ করে বাকশাল পুনরুজ্জীবিত করেন। এ সময় রাজ্জাকসহ দলত্যাগীদের বহিষ্কার করা হয়। পরে অবশ্য ১৯৯১ সালে বাকশাল বিলুপ্ত করে রাজ্জাক আবারও আওয়ামী লীগে ফিরে আসেন।