প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় নেতা–কর্মীদের উদ্দেশে হাত নাড়েন। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, ঢাকা, ২৩ জুন  | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

বিশেষ প্রতিনিধি: আওয়ামী লীগকে বহুবার নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা করা হয়েছে। তবে জনগণ, দলের নেতা-কর্মী ও অগণিত সমর্থকদের কারণে তা সফল হয়নি বলে মন্তব্য করেছেন দলটির সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

আজ রোববার রাজধানীর ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আওয়ামী লীগের ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় এ মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী।

আওয়ামী লীগের ওপর বারবার আঘাত এসেছিল উল্লেখ করে দলটির সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘খুব বেশি দিনের কথা নয়। ২০০৭ সালে চেষ্টা করা হয়েছিল আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে কিংস পার্টি গড়ে তুলতে। সেটাও সফল হয়নি। তার কারণ, আওয়ামী লীগের মূল শক্তি হচ্ছে দেশের জনগণ, তৃণমূলের মানুষ, আওয়ামী লীগের অগণিত নেতা-কর্মী, মুজিব আদর্শের সৈনিক। এই সৈনিকেরা কখনো পরাজয় মানে না, মাথা নত করে না।’

 আওয়ামী লীগের ৭৫ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায় দলের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে দুপুর ১২টার পর থেকেই ঢাকা ও ঢাকার আশপাশের জেলা থেকে মিছিল নিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জমায়েত করেন আওয়ামী লীগ, সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। ভেতরে প্রবেশে কড়াকড়ির কারণে অনেকে আশপাশের সড়কে অবস্থান নেন। মাঠে উপস্থিত নেতা-কর্মীদের উজ্জীবিত করতে গান পরিবেশন করেন দেশবরেণ্য শিল্পীরা। বেলা ৩টা ৩৬ মিনিটে সভামঞ্চে আসেন দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা। এ সময় স্লোগান দিয়ে তাঁকে বরণ করে নেন উপস্থিত নেতা-কর্মীরা। জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন, জাতীয় সংগীত পরিবেশন, বেলুন ও পায়রা উড়িয়ে কর্মসূচির উদ্বোধন করেন শেখ হাসিনা। পরে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করেন দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনাসহ দলটির নেতা-কর্মীরা। বিকেল পাঁচটার কিছু পরেই সভাপতির বক্তব্য শুরু করেন শেখ হাসিনা।

আওয়ামী লীগ ছেড়ে যাওয়া নেতাদের উদ্দেশে শেখ হাসিনা বলেন, ‘হয়তো কখনো কখনো কোনো নেতারা ভুল করেছেন। কেউ মনে করেছেন, আওয়ামী লীগে থাকলে তাঁরাই বড় নেতা; দলের চেয়েও নিজেকে বড় মনে করে দল ছেড়েছেন, অন্য দল করেছেন। কিন্তু তারা ভুল করেছেন। কেন? আপনারা দেখেন, আকাশে মিটিমিটি তারা জ্বলে। তারা আলোকিত হয় সূর্যের দ্বারা। যেসব নেতারা ভুল করেছিলেন, তাঁরা ভুলে গিয়েছিলেন, তাঁরা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ছিলেন বলেই আলোকিত ছিলেন। এখান থেকে চলে যাওয়ার পর ওই তাঁরা আর জ্বলেনি, আস্তে আস্তে কিছু মিটেই গেছে।’

এ বিষয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি আরও বলেন, ‘কেউ ভুল বুঝে হয়তো ফেরত এসেছেন, আমরা নিয়েছি। আবার কেউ এখনো বিভিন্নভাবে আওয়ামী লীগের সরকার পতন, ধ্বংস—নানা জল্পনাকল্পনা করে যাচ্ছেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে বাংলার মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য। তা আমরা প্রমাণ করেছি। পঁচাত্তরের পর বারবার ক্ষমতা বদল হয়েছিল। সেটা হয়েছে অস্ত্রের মাধ্যমে, ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে। জনগণের অধিকার ছিল না। তাদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারেনি।’

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সমাবেশে পায়রা অবমুক্ত করেন দলের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

বাংলাদেশের মানুষের সব অর্জন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে হয়েছে দাবি করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বারবার আওয়ামী লীগের ওপর আঘাত এসেছে। এ দলকে খণ্ডবিখণ্ড করা হয়েছে। বারবার এ দলকে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা হয়েছিল, যার শুরু সেই আইয়ুব খানের মার্শাল ল থেকে।

আওয়ামী লীগ গণমানুষের ও জনগণের অধিকার আদায়ের সংগঠন বলে মন্তব্য করেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘জনগণের আর্থসামাজিক উন্নতি করার সংগঠন হচ্ছে আওয়ামী লীগ। বারবার আঘাত করেও এ সংগঠনের কেউ ক্ষতি করতে পারেনি। ফিনিক্স পাখির মতো...যেমন পুড়িয়ে ফেলার পরেও ভস্ম থেকে জেগে ওঠে, আওয়ামী লীগও সেইভাবে জেগে উঠেছে।’

আওয়ামী লীগ জনগণের শক্তিকে বিশ্বাস করে বলেও উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ১৯৯৬ সালে দেশকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়েছিল তাঁর সরকার। তখন বাংলাদেশের মানুষ প্রথম উপলব্ধি করেছিল, একটি দলের কাজ হলো জনগণের সেবা করা।

 

আওয়ামী লীগের ৭৫ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে রোববার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দলের সমাবেশে সভাপতি শেখ হাসিনাকে শুভেচ্ছা জানান সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

দলের নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে দলকে সংগঠিত করার আহ্বান জানান আওয়ামী লীগ সভাপতি। তিনি বলেন, ‘প্রত্যেক নেতা-কর্মীকে এই প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে বলব, আপনারা একবার চিন্তা করে দেখেন, এই আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা কত কষ্ট করেছেন। বারবার আঘাত এসেছে। পরিবারগুলো কষ্ট করেছে। কিন্তু এই সংগঠন ধরে রেখেছেন। কাজেই যেমন সংগঠন করতে হবে। সেইভাবে জনগণের আস্থা-বিশ্বাস, যেটা আমাদের মূল শক্তি, সেই আস্থা-বিশ্বাসটা অর্জন করতে হবে।’

আওয়ামী লীগ জনগণের আস্থা-বিশ্বাস অর্জন করতে পেরেছে বলেই বারবার জনগণ ভোট দিয়েছে বলেও জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে ২০০৯ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত আছে। আর গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত আছে বলেই আজকে আর্থসামাজিকভাবে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, বাংলাদেশের উন্নতি হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ আজকে বিশ্বদরবারে রোল মডেল হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। বিশ্বে আজকে মাথা উঁচু করে চলার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। কাজেই তা ধরে রেখেই সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।

২০৪১ সালে স্মার্ট বাংলাদেশ ও ২১০০ সালের ডেলটাপ্ল্যানের কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘অনেক বয়স হয়েছে, তত দিন হয়তো বেঁচে থাকব না। কিন্তু আজকে যারা নবীন, যারা আমার স্মার্ট বাংলাদেশের মূল সৈনিক হবে। আমরা স্মার্ট জনগোষ্ঠী গড়ে তুলব, স্মার্ট সরকার, স্মার্ট অর্থনীতি, স্মার্ট সোসাইটি গড়ে তুলব; এই বাংলাদেশ বিশ্বে মাথা উঁচু করে এগিয়ে যাবে—প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে প্লাটিনাম জুবিলিতে এটাই আমাদের প্রতিজ্ঞা।’

আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে তিন দিনের আয়োজনের শেষ দিন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সমাবেশে বক্তব্য পর্ব ছাড়াও ছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

এ সময় শেখ হাসিনা উপস্থিত নেতা-কর্মীদেরও প্রতিজ্ঞা করার আহ্বান জানান। তাঁরাও হাত উঁচিয়ে, চিৎকার করে সাড়া দেন।

মৃত্যুকে পরোয়া করেন না জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘হ্যাঁ, মৃত্যু যেকোনো সময় সবার হতে পারে। যেকোনো সময় মৃত্যু আসতে পারে। তার জন্য আমি কোনো দিন ভীত নই। কখনো ভয় পাইনি, পাব না। কিন্তু যতক্ষণ শ্বাস, ততক্ষণ আশ। বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে আমার বাবার যে চিন্তাচেতনা, তা বাস্তবায়ন করে এ দেশের মানুষকে একটা উন্নত জীবন দেব, এটাই আমাদের লক্ষ্য।’

কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ছুটি কবিতা থেকে উদ্ধৃত করে বক্তব্য শেষ করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘...যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ/ প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,/ এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি/ নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।’

এর আগে আওয়ামী লীগের ইতিহাস, এ দলের প্রতিষ্ঠাতাদের শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন শেখ হাসিনা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সংগ্রামের ইতিহাস তুলে ধরেন। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট মা–বাবাসহ পরিবারের সদস্যদের হারানো এবং বিদেশে শরণার্থী হিসেবে থাকার কথা উল্লেখ করে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন প্রধানমন্ত্রী। এ সময় তাঁর গলা ধরে আসে।

আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক আবদুস সোবহান গোলাপ ও উপপ্রচার সম্পাদক আবদুল আউয়াল শামীমের সঞ্চালনায় আরও বক্তব্য দেন সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের আওয়ামী লীগের সমাবেশে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন শেখ হাসিনা, দলীয় পতাকা উত্তোলন করেন ওবায়দুল কাদের | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

আওয়ামী লীগের আলোচনা সভায় উপস্থিত ছিলেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও বিরোধীদলীয় নেতা গোলাম মোহাম্মদ কাদের, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনুসহ ১৪–দলীয় জোটের শরিক বিভিন্ন দলের নেতারা। এ ছাড়া বাংলাদেশে নিযুক্ত বিভিন্ন বিদেশি মিশনের কূটনীতিকেরাও উপস্থিত ছিলেন।