বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান |
এমরান হোসাইন শেখ: দেশভাগের পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কলকাতা থেকে ঢাকায় চলে আসেন। এর ঠিক ৫ মাসের মাথায় ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ছাত্রলীগ (পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ)। এর কার্যালয় করা হয় ১৫০ মোগলটুলি। এর আগে বঙ্গবন্ধু সতীর্থ-সহযোদ্ধাদের নিয়ে এই ১৫০ মোগলটুলিতে ‘ওয়ার্কার্স ক্যাম্প’ সংগঠিত করেন। ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠার দেড় বছর পর ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন গঠিত হয় আওয়ামী লীগ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী এ রাজনৈতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠার সামনের সারিতে ছিলেন বঙ্গবন্ধু। এর কার্যালয়ও করা হয় ১৫০ মোগলটুলিকে।
বঙ্গবন্ধু তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র। বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের অধিকার আদায়ের আন্দোলন করতে গিয়ে ১৯৪৯ সালের ১৯ এপ্রিল গ্রেফতার হওয়ার কারণে আওয়ামী লীগ গঠনের দিনটাতে উপস্থিত থাকতে পারেননি তিনি। তবে, বঙ্গবন্ধু বন্দি অবস্থায় সবার সঙ্গে যোগাযোগ রাখার পাশাপাশি আওয়ামী লীগের সাথে যুক্ত থাকতে চান বলেও তার সিদ্ধান্ত আগেই জানিয়ে দেন।
বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার বিষয়ে বেশকিছু তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। বাংলাদেশের প্রাচীন এ রাজনৈতিক সংগঠনটি গঠনে ওই সময় টাঙ্গাইলের একটি উপনির্বাচনেরও ভূমিকা রয়েছে বলে সেখানে উঠে এসেছে। ওই সময় (১৯৪৯ সালে) মুসলিম লীগের প্রার্থী করোটিয়ার বিখ্যাত জমিদার খুররম খান পন্নীকে হারিয়ে উপনির্বাচনে জয়ী হন শামসুল হক (আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক)। সেটাই ছিল পাকিস্তানে মুসলিম লীগের প্রথম পরাজয়। নির্বাচনে জিতে ঢাকায় আসার পর শামসুল হককে জনগণ সংবর্ধনা দেয় এবং কর্মী সম্মেলনের সিদ্ধান্ত হয় বলে বঙ্গবন্ধু আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেছেন। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, শামসুল হক সাহেব ইলেকশনে জয়লাভ করে ঢাকায় আসলে ঢাকার জনসাধারণ ও ছাত্রসমাজ তাঁকে বিরাট সংবর্ধনা জানালো। বিরাট শোভাযাত্রা করে তাঁকে নিয়ে ঢাকা শহর প্রদক্ষিণ করলো। আমি জেলে বসে বিজয়ের আনন্দ উপভোগ করলাম। শামসুল হক সাহেবের ফিরে আসার পরই পুরানা লীগ কর্মীরা (আগে মুসলিম লীগের সঙ্গে ছিল এমন) মিলে এক কর্মী সম্মেলন ডাকলো ঢাকায় ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা ঠিক করার জন্য। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন সে সভা ডাকা হয়েছিল (পৃষ্ঠা ১১৯)।
বঙ্গবন্ধু আত্মজীবনীর ১২০ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘কর্মী সম্মেলনের জন্য খুব তোড়জোড় চলছিল। জেলে বসে খবর পাচ্ছিলাম। ১৫০ মোগলটুলিতে অফিস হয়েছে’ বলেও তিনি লিখেছেন। লিখেছেন, শওকত মিয়া সকলের থাকা-খাওয়ার বন্দোবস্ত করছেন। ঢাকার পুরানা লীগ কর্মী ইয়ার মোহাম্মদ খান সহযোগিতা করছিলেন। এছাড়া অ্যাডভোকেট আতাউর রহমান খান, আলী আমজাদ খান, আনোয়ারা খাতুন এমএলএ।
জেলখানায় তার কাছ থেকে নতুন দল এবং তাতে সম্পৃক্ত থাকার বিষয়ে মতামত নেওয়া হয়েছিল বলেও বঙ্গবন্ধু লিখেছেন। বঙ্গবন্ধু সম্মেলনের ফলাফল সম্বন্ধে চিন্তায় দিন কাটাচ্ছিলেন বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, আমার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল, আমার মত নেওয়ার জন্য। আমি খবর দিয়েছিলাম, “আর মুসলিম লীগের পিছনে ঘুরে লাভ নাই, এ প্রতিষ্ঠান এখন গণবিচ্ছিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এরা আমাদের মুসলিম লীগে নিতে চাইলেও যাওয়া উচিত হবে না। কারণ এরা কোটারি করে ফেলেছে। একে আর জনগণের প্রতিষ্ঠান বলা চলে না। এদের কোনও কর্মপন্থাও নাই।” আমাকে আরও জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, আমি ছাত্র প্রতিষ্ঠান করবো, না রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গঠন হলে তাতে যোগদান করবো? আমি উত্তর পাঠিয়েছিলাম, ছাত্র রাজনীতি আমি আর করবো না, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানই করবো। কারণ বিরোধী দল সৃষ্টি করতে না পারলে এ দেশে একনায়কত্ব চলবে। (পৃষ্ঠা ১২১)।
রোজ গার্ডেনে আওয়ামী লীগের জন্ম সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, যাহোক, কোথায়ও হল বা জায়গা না পেয়ে শেষ পর্যন্ত হুমায়ুন সাহেবের রোজ গার্ডেন বাড়িতে সম্মেলনের কাজ শুরু হয়েছিল। শুধু কর্মীরা না, অনেক রাজনৈতিক নেতাও সেই সম্মেলনে যোগদান করেন। শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, আল্লামা মওলানা রাগীব আহসান, এমএলএদের ভিতর থেকে জনাব খয়রাত হোসেন, বেগম আনোয়ারা খাতুন, আলী আহমদ খান ও হাবিবুর রহমান চৌধুরী ওরফে ধনু মিয়া এবং বিভিন্ন জেলার অনেক প্রবীণ নেতাও যোগদান করেছিলেন। সকলেই একমত হয়ে নতুন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গঠন করলেন; তার নাম দেওয়া হলো— ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ।’ মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সভাপতি, শামসুল হক সাধারণ সম্পাদক এবং আমাকে করা হলো জয়েন্ট সেক্রেটারি। খবরের কাগজে দেখলাম, আমার নামের পাশে লেখা আছে ‘নিরাপত্তা বন্দি’। আমি মনে করেছিলাম, পাকিস্তান হয়ে গেছে সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের দরকার নাই। একটা অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হবে, যার একটা সুষ্ঠু ম্যানিফেস্টো থাকবে। ভাবলাম, সময় এখনও আসে নাই, তাই যারা বাইরে আছেন তারা চিন্তাভাবনা করেই করেছেন (পৃষ্ঠা ১২১)।
১৯৪৯ সালের ১৯ এপ্রিল গ্রেফতার হওয়ার পর আওয়ামী লীগ গঠিত হওয়ার পাঁচদিনের মাথায় ২৭ জুন মুক্তি পান। জেলগেটে মুক্তিপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগ নেতা বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা দেওয়া হয়। এ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, জেলগেটে গিয়ে দেখি বিরাট জনতা আমাদের অভ্যর্থনা করার জন্য এসেছে মওলানা ভাসানী সাহেবের নেতৃত্বে। সাথে সাথে ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ জিন্দাবাদ, ছাত্রলীগ জিন্দাবাদ’ ধ্বনি উঠলো। জেলগেটে এই প্রথম ‘আওয়ামী লীগ জিন্দাবাদ’ হলো। শামসুল হক সাহেবকে কাছে পেয়ে তাঁকে অভিনন্দন জানালাম এবং বললাম, ‘হক সাহেব, আপনার জয়, আজ জনগণের জয়।’ হক সাহেব আমাকে জড়িয়ে ধরলেন এবং বললেন, ‘চল, এবার শুরু করা যাক।’ পরে আওয়ামী মুসলিম লীগ, আওয়ামী লীগ নামে পরিচিত হয়।
বঙ্গবন্ধু ছাত্রনেতা হয়ে কারাবন্দি হয়ে আওয়ামী লীগের একজন শীর্ষ নেতা হিসেবে জেল থেকে বের হন। পরে পুরোদমে মন দেন আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রসারে। মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এই সংগঠনের সভাপতি ও শামসুল হক সাধারণ সম্পাদক হলেও, দেশজুড়ে কর্মী সংগ্রহ ও দলীয় প্রচারণার কাজ করতে হয় শেখ মুজিবকে।
বঙ্গবন্ধু আত্মজীবনীতে আওয়ামী লীগ সম্পর্কে আরও লিখেছেন, আওয়ামী লীগের প্রথম ওয়ার্কিং কমিটির সভা হয় ১৫০ নম্বর মোগলটুলিতে। শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক সাহেব তাতে যোগদান করেছিলেন। একটা গঠনতন্ত্র সাব-কমিটি ও একটা কর্মপন্থা সাব-কমিটি করা হলো। আমরা কাজ করা শুরু করলাম। শওকত মিয়া বিরাট সাইনবোর্ড লাগিয়ে দিলো। টেবিল, চেয়ার সকল কিছুই বন্দোবস্ত করলো।
জেল থেকে মুক্তি পেয়ে বঙ্গবন্ধু ছাত্রলীগের বার্ষিক সম্মেলন করে নিজে আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায় নেওয়ার পাশাপাশি ছাত্রলীগের নতুন কমিটি গঠন করে দেন বলে আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেছেন। মওলানা সাহেব, শামসুল হক সাহেব ও তিনি ময়মনসিংহ জেলার জামালপুর মহকুমায় প্রথম সভা করতে যান। সেখান থেকে ফিরে এসে ঢাকার আরমানিটোলা ময়দানে এক জনসভা ডাকেন। তিনিসহ অন্যরা মিলে দেশের বিভিন্ন জেলায় কমিটি গঠনসহ সংগঠনে মনোনিবেশ করেন।
১৯৫৩ সালে সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক থেকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘মওলানা ভাসানী আমি ও আমার সহকর্মীরা সময় নষ্ট না করে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠান গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করলাম। পূর্ব বাংলার জেলায়, মহকুমা, থানায় ও গ্রামে গ্রামে ঘুরে এক নিঃস্বার্থ কর্মীবাহিনী সৃষ্টি করতে সক্ষম হলাম। (পৃষ্ঠা ২৪৩)।’