মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের মানুষের কেনাকাটায় ভরসা ফুটপাতের দোকানগুলো | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
আতিক হাসান শুভ: দুই দিন পরেই পালিত হবে মুসলমানদের দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎসব ঈদুল আজহা। ঈদের আনন্দকে দ্বিগুণ করতে নতুন পোশাকের জুড়ি নেই। এসময় ধনী-গরিব সবার মধ্যে নতুন পোশাক কেনার প্রবণতা দেখা যায়। ধনীদের অধিকাংশই ইতোমধ্যে কেনাকাটা সেরে নিয়েছে। আর শেষ মুহূর্তে এসে কেনাকাটা করছেন মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের মানুষেরা। এই কেনাকাটায় তাদের ভরসা ফুটপাতের দোকানগুলো।
শুক্রবার সন্ধ্যায় রাজধানীর গুলিস্তান ও পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজারের ফুটপাতে পোশাক ও প্রসাধনীসামগ্রী বেচাবিক্রির হিড়িক দেখা যায়। কম দামে এখান থেকে জামা-কাপড়, জুতা থেকে শুরু করে বাসাবাড়ির প্রয়োজনীয় অনেক জিনিসপত্র কিনছেন ক্রেতারা। একশো থেকে শুরু করে তিন-চারশো টাকায় শার্ট, প্যান্ট ও পাঞ্জাবি মিলছে ফুটপাতের দোকানগুলোতে। আবার হাজার টাকার পোশাকও মিলছে এখানে।
গুলিস্তান ও পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজারের ফুটপাতে দেখা যায় পোশাক ও প্রসাধনীসামগ্রী বেচাবিক্রির হিড়িক | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
ছেলেমেয়ের জন্য লক্ষ্মীবাজারের ফুটপাত থেকে প্যান্ট আর থ্রি-পিস কিনছেন জিনিয়া আফরিন নামে একজন গৃহিণী। তিনি বলেন, ফুটপাত বলেই যে কাপড় খারাপ বিষয়টা তা নয়। দেখে-শুনে কিনতে পারলে এখান থেকে অল্প দামে অনেক ভালো জামা-কাপড় কেনা যায়। আমার ছেলে জয়ের জন্য একটা প্যান্ট কিনেছি ৪০০ টাকায়। শপিং মলে ঢুকলে এই প্যান্টের দাম কম করে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা হতো। কারণ তাদের আবার বাড়তি খরচ আছে। মেয়ের জন্য একটা থ্রি-পিস কিনেছি ৫৫০ টাকায়। এই থ্রি-পিস দোকান থেকে নিলে আরও দুই-আড়াইশো টাকা বাড়তি দিয়ে নিতে হতো। তাহলে আমি ফুটপাতে যখন সস্তায় ভালো জিনিস নিতে পারছি শুধু শুধু শপিং মলে গিয়ে টাকা নষ্ট করার কোনও মানে নেই।
এই গৃহিণী আরও বলেন, এখন সবকিছুর দাম বাড়তি। একজনের আয় দিয়ে ঢাকা শহরে থাকাটা অনেক কষ্টের। মাসে ৩০ হাজার টাকা আয় করলেও সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয়। বাসা ভাড়া, সংসারের খরচ, ছেলেমেয়ের পড়াশোনার খরচ দিতেই সব টাকা শেষ হয়ে যায়। কিন্তু ঈদ এলে ছেলেমেয়ে নতুন জামা কাপড় না পেলে মন খারাপ করে ফেলে। এজন্য যাই কিছু হোক নতুন কাপড় কেনার চেষ্টা করি। ফুটপাত থেকে কাপড় কিনতে হলে দোকানদারের সঙ্গে একটু বেশি দামাদামি করতে হয়। মাঝেমধ্যে কটু কথাও শুনতে হয়। তবে এটা অস্বীকার করার সুযোগ নেই যে ফুটপাত আছে বলেই অন্তত আমাদের মতো পরিবারের শখ-আহ্লাদ কিছুটা পূরণ হয়।
দাম কম হওয়ায় ফুটপাতের দোকান থেকে প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করছেন সাধারণ ক্রেতারা | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
জাহিদুল ইসলাম নামে একজন ক্রেতা বলেন, ফুটপাত থেকে সস্তায় কেনাকাটা করা যায়। তাই বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে এসেছি তাদের পছন্দের পোশাক কিনতে। বাচ্চাদের জন্যে একটা হাফপ্যান্ট আর গেঞ্জি কিনেছি। সঙ্গে নতুন জুতাও নিয়েছি। এখন বাচ্চার মায়ের জন্যও কিনবো। তার জন্য শাড়ি খুঁজছি কিন্তু পছন্দ হচ্ছে না। গত ঈদেও তাকে কিছু দেওয়া হয়নি। তাই এই ঈদে সিদ্ধান্ত নিয়েছে নতুন একটা শাড়ি দেবো। নিজের জন্য কী কিনেছেন এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, দেখি কী কেনা যায়! আগে পরিবারের সবার কেনাকাটা শেষ করি তারপর।
ঈদের কেনাকাটায় দেরির কারণ জানিয়ে এই ক্রেতা বলেন, বেশি দেরি হয় নাই। গতবছর তো একেবারে চাঁদরাতে কিনেছি। এবার বেতন-বোনাস তাড়াতাড়ি পেয়েছি। তাই ভাবলাম আগেই কেনাকাটা সেরে ফেলি। নয়তো পরে আবার অন্য কাজে টাকা খরচ হয়ে যাবে। ঈদে কোরবানি দেওয়ার প্রসঙ্গে এই ক্রেতা বলেন, আল্লাহ যদি কোরবানি দেওয়ার সামর্থ্য রাখতেন তাহলে তো ফুটপাত থেকে কেনাকাটা করতে হতো না। তবে আল্লাহ যেই সামর্থ্য দিয়েছেন তার জন্য শুকরিয়া জানাই।
কম দামির পাশাপাশি হাজার টাকার পোশাকও মিলছে ফুটপাতে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
গুলিস্তানের ফুটপাতে জামাকাপড়ের স্তূপ থেকে অনেক ঘেঁটেঘুটে নিজের জন্য ২০০ টাকা দিয়ে একটা শার্ট কিনেছেন রিকশাচালক আবুল কাশেম। তিনি বলেন, "ঈদের তিন দিন পর বাড়ি যাবো। তাই একখান জুইত মতো জামা নিয়েছি। মেয়েটার জন্যেও নিছি। আপনার চাচির জন্য গত ঈদে নিছি। তাই এবার আর নেইনি।" ফুটপাত থেকে কেনার বিষয়ে এই রিকশাচালক বলেন, ফুটপাতেও একদামে জিনিস বিক্রি করে। অনেক দোকানে দামাদামির সুযোগ নাই। আমাদের সাধ্য আছে এখান থেকে কেনার। একটু দামাদামি যদি না করতে পারি তাহলে তো পোষাবে না।
ফুটপাতের জমজমাট বেচাবিক্রিতে ব্যবসায়ীরাও বেশ খুশি। লক্ষ্মীবাজারের পোশাক বিক্রেতা আমির হোসেন বলেন, ফুটপাতে অল্প টাকায় ইচ্ছে পূরণ করা যায়। নিজের পছন্দ মতো পোশাক পাওয়া যায়। এজন্য নিম্ন আয়ের মানুষের প্রথম পছন্দ ফুটপাত। তবে শুধু নিম্ন আয়ের মানুষ ফুটপাত থেকে পোশাক কিনে বিষয়টা এমন না, অনেকে ভিআইপি গেটাপ নিয়েও ফুটপাত থেকে কেনাকাটা করেন। গত এক সপ্তাহে আমি মোটামুটি ভালো বেচাকেনা করেছি। প্রতিদিন ন্যূনতম ১০-১২ হাজার টাকার বেচাকেনা হয়েছে। গত দুই দিন একটু বেশি হয়েছে। আজকেও বেশ ভালো বেচাকেনা হয়েছে। আশা করি, ঈদের আগের দিন পর্যন্ত এমন চলবে।
লক্ষ্মীবাজারের পোশাক বিক্রেতা আমির হোসেন বলেন, ফুটপাতে অল্প টাকায় ইচ্ছাপূরণ করা যায় | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
ফুটপাতের আরেকজন ব্যবসায়ী তারেক হোসেন। সন্ধ্যা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত এক নাগাড়ে বিক্রি করেছেন। একটু দম ফেলার ফুরসত মেলেনি তার। পাঁচশ টাকার মধ্যে মেয়েদের বিভিন্ন ধরনের থ্রি-পিস ও জুতা বিক্রি করছেন। তিনি বলেন, বেচাকেনা আলহামদুলিল্লাহ ভালো। গতকাল বৃষ্টির কারণে তেমন লোকজন আসে নাই। আজকেও বিকালের দিকে আকাশ মেঘলা ছিল, অনেক বাতাস ছিল। ভেবেছি আজকেও মানুষ আসবে না। কিন্তু সন্ধ্যায় হঠাৎ করে মানুষের ভিড়। গত দুই দিনের বেচাকেনা আজ একসঙ্গে হয়েছে। ঈদের আগ পর্যন্ত বৃষ্টি না হলে অন্তত পঞ্চাশ হাজার টাকার বেচাবিক্রির আশা করছেন এই বিক্রেতা।