ব্রিটিশ আমলে নির্মিত বগুড়া জেলা কারাগারের জরাজীর্ণ ভবন। ঝুঁকিপূর্ণ এই ভবনে গাদাগাদি করে বসবাস দুই হাজারের বেশি কয়েদির | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন 

প্রতিনিধি বগুড়া: বগুড়া প্রায় দেড় শ বছরের পুরোনো, জীর্ণ ভবনে ঝুঁকি নিয়ে বাস করছেন বন্দীরা। নেই পর্যাপ্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা। কারাগারে একটিমাত্র নিরাপত্তাদেয়াল। বাইরে তিন দিকেই চলাচলের ব্যস্ত রাস্তা।

চারদিক থেকে অনেকটা অরক্ষিত ব্রিটিশ আমলে নির্মিত কারাগারটি। দেয়াল থেকে শুরু করে ছাদ—সবকিছুই নির্মিত ইট, বালু ও চুন-সুরকি দিয়ে। কারা ভবন নির্মাণে ব্যবহৃত লালমাটির ইটের স্থায়িত্বকাল হারিয়েছে অনেক আগেই। ছাদে নেই রড-সিমেন্ট। ধাতব বস্তু দিয়ে দেয়ালে আঘাত করলে খসে পড়ে পলেস্তারা। কারাগারের সীমানাপ্রাচীর থেকে কনডেমড সেল—সবই জরাজীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ। ৭২০ বন্দী ধারণক্ষমতার এই কারাগারে গাদাগাদি করে তিন গুণের বেশি ২ হাজার ২০০ বন্দী আছেন। এমন জীর্ণ কারা ভবনেই আছেন মৃত্যুদণ্ডের সাজাপ্রাপ্ত কয়েদি ও জঙ্গিরাও।

জেলা তথ্য বাতায়ন থেকে এবং কারাগার–সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, ১৮৮৩ সালে কারাগারটি নির্মিত হয়। প্রায় ৭ দশমিক ২১ একর আয়তনের এই কারাগারে ২৪টি সিসিটিভি ক্যামেরা বসানো থাকলেও সচল নেই অর্ধেকও।

এই কারাগারের জাফলং সেলের ছাদ ফুটো করে মঙ্গলবার দিবাগত রাতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত চার আসামি পালিয়ে যান। ওই ঘটনার পর বগুড়া জেলা কারাগারের ‘দুর্বল নিরাপত্তাব্যবস্থা’র বিষয়টি আলোচনায় আসে। যে সেল থেকে চার আসামি পালিয়েছেন, সেই সেলের অবস্থানও কারাগারের উত্তর পাশে দেয়াল ঘেঁষে। ফাঁসির আসামি রাখা হয়েছিল ইট-সুরকিতে নির্মিত কনডেমড সেলে। ২৫ দিন ধরে সেই সেলের ছাদ ফুটো করে পালিয়েছিলেন তাঁরা। অবশ্য ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই তাঁরা স্থানীয় লোকজনের হাতে ধরা পড়েন।

কারা–সংশ্লিষ্ট সূত্রটি আরও জানায়, কারাগারে প্রতি অর্থবছরই সংস্কারকাজ করে গণপূর্ত অধিদপ্তর। গত দুই দশকে সংস্কারকাজে প্রায় ১০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। এর বাইরে নারী বন্দীদের নতুন ব্যারাক নির্মাণে আরও প্রায় সোয়া কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। প্রতিবছর কারাগার সংস্কারে বিপুল অর্থ ব্যয় করা হলেও নতুন কারা ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেই।

কারাগারে সংস্কারের পেছনে বছর বছর কোটি কোটি টাকা ব্যয়ের তথ্য নিশ্চিত করেছেন নাম প্রকাশ না করার শর্তে গণপূর্ত অধিদপ্তরের একজন প্রকৌশলী। তিনি বলেছেন, ‘এই টাকা পুরোটাই জলে গেছে।’

এ প্রসঙ্গে বগুড়া কারাগারের জেলার মোহাম্মদ ফরিদুর রহমান গতকাল শুক্রবার বলেন, জরাজীর্ণ কারা ভবন নিয়ে গণপূর্তকে একাধিকবার লিখিতভাবে জানানো হয়েছে। এ বিষয়ে গণপূর্ত বলতে পারবে। এটি কারা অধিদপ্তরের বিষয় নয়।

বগুড়া কারাগারের সাবেক একজন তত্ত্বাবধায়ক বলেন, দেশে এখন যেসব কারা ভবন নির্মিত হচ্ছে, সেখানে একাধিক স্তরে কারাপ্রাচীর থাকে। কিন্তু বগুড়া কারাগারে সীমানাপ্রাচীর খুবই জরাজীর্ণ।

সরেজমিনে দেখা যায়, বগুড়া জেলা কারাগারের তিন দিকেই চলাচলের রাস্তা। একদিকে করতোয়া নদী। পশ্চিমে সীমানাপ্রাচীরের বাইরে জনাকীর্ণ সড়ক। সড়কের আরেক পাশে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর এবং কয়েক শ গজ অদূরে জেলা পুলিশ, ডিবি ও সিআইডি কার্যালয়। এ ছাড়া কারাগারের উত্তর প্রাচীর ঘেঁষে নাটাইপাড়া সড়কে করতোয়া নদীর ওপর নির্মিত জেল সেতু পারাপার হয়ে রাতবিরাতে মানুষের অবাধ চলাচল। স্থানীয় লোকজন জানান, এই সড়কের কারণেও বিঘ্নিত হয় কারাগারের নিরাপত্তা।

একটি হত্যা মামলায় সম্প্রতি ওই কারাগারে ছিলেন বগুড়া পৌরসভার ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আমিনুল ইসলাম। মাস দেড়েক আগে তিনি জামিনে বেরিয়েছেন। তিনি বলেন, কারাগারের পরিবেশ অত্যন্ত ঘিঞ্জি। একেকটি ওয়ার্ডে শতাধিক বন্দী থাকেন। তাঁদের জন্য শৌচাগার মাত্র দুটি।

বগুড়ার সাবেক এক পুলিশ সুপার বলেন, রাজধানীর হোলি আর্টিজান হামলার অন্যতম আসামি জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব গান্ধী ছাড়াও শতাধিক জঙ্গিকে গ্রেপ্তারের পর বগুড়া কারাগারে রাখা হয়। ২০১৯ সাল পর্যন্ত তাঁরা এই কারাগারেই ছিলেন। অবশ্য এসব জঙ্গির অনেকেই জামিনে বেরিয়ে গেছেন। তবে এখনো বেশ কয়েকজন জঙ্গি বগুড়া কারাগারে আছেন। চার কয়েদি সেলের ছাদ ফুটো করে পালানোর পর জঙ্গিদের অনেককে এখনো এই কারাগারে রাখায় তাদের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

তদন্তসংশ্লিষ্টরা যা বললেন
কারাগার থেকে ফাঁসির চার আসামি পালানোর ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির এক কর্মকর্তা বলেন, ছাদ ফুটো করার ধরন দেখে মনে হয়েছে, শাবল বা হাতুড়িজাতীয় কোনো বস্তু এ কাজে ব্যবহৃত হয়েছে। সেটি কীভাবে কয়েদিদের কাছে পৌঁছাল, সেটিই মূলত অনুসন্ধান করে দেখা হচ্ছে।

প্রশাসনের তদন্ত কমিটির প্রধান ও বগুড়ার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট পি এম ইমরুল কায়েস বলেন, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা পালানোর সময় কারারক্ষীদের দায়িত্ব পালনে অবহেলা ছিল কি না, ছাদ ফুটো করার কাজে ব্যবহৃত উপকরণ কেউ সরবরাহ করেছিলেন কি না, সেসব অনুসন্ধান করে দেখা হচ্ছে। এ ছাড়া চুন-সুরকিতে নির্মিত জীর্ণ কারাগারে বন্দী রাখা কতটা ঝুঁকিপূর্ণ, সে বিষয়ও খতিয়ে দেখা হবে।