ভয়ংকর এক ‘ক্রমিক ধর্ষক’

নাজমুল হোসেন যৌন নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনায় তিন মামলায় অভিযুক্ত আসামি | ছবি: সংগৃহীত

আসাদুজ্জামান: অষ্টম শ্রেণিতে পড়ুয়া এক কিশোরী গত ১১ মে মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোডের বাসা থেকে বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে যায় শ্যামলীতে। বন্ধুর সঙ্গে কথা বলে সে রিকশায় করে মোহাম্মদপুরের রিং রোডে এলে একটি কার গতি রোধ করে এবং ভয় দেখিয়ে তাকে গাড়িতে তুলে নেয় এক দুর্বৃত্ত। এরপর কিশোরীকে ওই গাড়ির ভেতরে ধর্ষণ করা হয়।

পরে ওই দুর্বৃত্ত কিশোরীর মাকে ফোন দিয়ে পাঁচ হাজার টাকা দাবি করে। টাকা না পেলে বড় ক্ষতি করবে বলে হুমকি দেয়। মা মেয়েকে উদ্ধারের জন্য তাৎক্ষণিকভাবে মুঠোফোনে দুই হাজার টাকা পাঠিয়ে দেন। টাকা পেয়ে মেয়েটিকে তাজমহল রোডে নামিয়ে দিয়ে চলে যায় ওই দুর্বৃত্ত।

এ ঘটনায় কিশোরীর মা ধর্ষণ মামলা করলে গত ১৭ মে সেই দুর্বৃত্তকে গ্রেপ্তার করে মোহাম্মদপুর থানার পুলিশ। এই দুর্বৃত্তের নাম নাজমুল হোসেন। নাজমুলের অপরাধ বৃত্তান্ত খুঁজতে গিয়ে মোহাম্মদপুর থানার পুলিশ জানতে পারে, এক যুগ আগেও দলবদ্ধ ধর্ষণের অপরাধে জড়িয়েছিলেন নাজমুল। তাঁর বিরুদ্ধে প্রথম ধর্ষণ মামলা হয় ২০১২ সালে। এক যুগের ব্যবধানে নাজমুলের বিরুদ্ধে ছয়টি মামলা হয়েছে। তিনটি ধর্ষণের মামলা। ধর্ষণ মামলায় জামিন পাওয়ার পর আবার নতুন অপরাধে জড়িয়ে পড়েন নাজমুল।

তদন্তকারী তিন পুলিশ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ধর্ষণের অভিযোগে তিনটি মামলা হলেও নাজমুলের শিকার হয়েছেন আরও অনেক নারী। জিজ্ঞাসাবাদে নাজমুল সে কথা স্বীকারও করেছেন।

ভুক্তভোগী নারীরা মামলায় অভিযোগ করেছেন, নাজমুল তাঁদের ভয় দেখিয়ে গাড়িতে তুলে নেয় এবং নির্জন জায়গায় নিয়ে গাড়ির ভেতরেই ধর্ষণ করে। এ ছাড়া অন্য দুই নারীকে পুলিশ পরিচয়ে ভয় দেখিয়ে গাড়িতে তোলে এবং টাকা ও স্বর্ণালংকার লুট করে।

তদন্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদপুর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) অনিক ভক্ত বলেন, বিকাশে টাকা নেওয়ার সূত্র ধরে নাজমুলকে শনাক্ত করেন তাঁরা। পরে খিলক্ষেত এলাকায় গাড়িসহ তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। পুলিশ জানতে পারে, এক যুগ ধরে রাজধানীতে এ ধরনের অপরাধ করে আসছেন নাজমুল। ২ জুন মোহাম্মদপুর থানা-পুলিশের পক্ষ থেকে আদালতকে জানানো হয়েছে, দীর্ঘদিন থেকে নাজমুল কার ব্যবহার করে নগরীর স্কুল ও কলেজের বিভিন্ন শিক্ষার্থীকে অপহরণ করে গাড়ির ভেতরে ধর্ষণ করে আসছেন।

পুলিশ কর্মকর্তারা জানালেন, নাজমুল এক জায়গায় বেশি দিন থাকেন না। নতুন অপরাধে জড়ানোর পরপর বাসাও পাল্টে ফেলেন। একাধিক বিয়ে করাসহ নারীঘটিত নানা কেলেঙ্কারির সঙ্গে তিনি জড়িত।

ঢাকার তিন নম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের সরকারি কৌঁসুলি মাহমুদা আক্তার বলেন, উবার কিংবা ভাড়ায় গাড়ি চালিয়ে এভাবে নারীদের তুলে নিয়ে গাড়ির ভেতরে ধর্ষণের ঘটনা অকল্পনীয়। এমন অপরাধী যদি কারাগারের বাইরে থাকেন, তাহলে যেকোনো নারী যেকোনো সময় বিপদে পড়তে পারেন। ধর্ষণের যে মামলাগুলোতে ইতিমধ্যে নাজমুল অভিযুক্ত হয়েছেন, সেই মামলা আদালতে প্রমাণ করে তাঁর শাস্তি নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রপক্ষ জোরালো পদক্ষেপ নেবে।

ঢাকার ‘ক্রমিক ধর্ষক’ নাজমুল
মোহাম্মদপুরে কিশোরীকে ধর্ষণের আগে গত মার্চে আরও এক নারীকে (২৫) গাড়িতে তুলে নানাভাবে হেনস্তা করেন নাজমুল। এ ঘটনায় মিরপুর থানায় গত ১৯ মার্চ মামলা হয়। পুলিশ প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ওই নারী পরিবারের সঙ্গে রাজধানীর কল্যাণপুরে বসবাস করেন। ১ মার্চ ওই নারী যখন কল্যাণপুর মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনের সড়কে আসেন, তখন একটি গাড়ি তাঁর গতিরোধ করে। গাড়ি থেকে নেমে আসা দুই লোক নিজেদের গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সদস্য পরিচয় দেন এবং ওই নারীকে গাড়িতে তুলে নেন। তাঁরা নারীর জামাকাপড় খুলে ভিডিও করার হুমকি দেন। পরে তরুণীর কাছে থাকা ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা কেড়ে নিয়ে তাঁকে আদাবরে নামিয়ে দিয়ে চলে যান তাঁরা।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মিরপুর মডেল থানার উপপরিদর্শক (এসআই) বায়েজীদ মোল্লা বলেন, আদালতের অনুমতি নিয়ে তিনি দুই দিন নাজমুল হোসেনকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। জিজ্ঞাসাবাদে নাজমুল স্বীকার করেন, বহুদিন থেকে তিনি ভুয়া ডিবি পরিচয়ে অনেক নারীকে গাড়িতে তুলে যৌন হেনস্তা করেছেন।

এর আগে ২০২২ সালে রাজধানীর ভাষানটেক এলাকা থেকে এক নারীকে গাড়িতে তুলে নিয়ে দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায়ও নাজমুলের জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়েছে পুলিশ। আদালতে জমা দেওয়া অভিযোগপত্রের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের ১১ জুলাই এক তরুণী (২২) ভাষানটেকের নেভি মার্কেটের সামনে আসেন। তখন নাজমুল ও তাঁর দুজন সহযোগী ওই তরুণীকে তুলে নিয়ে গাড়ির ভেতরে ধর্ষণ করেন। পরে তরুণীর বাবার কাছ থেকে মুঠোফোনে ১০ হাজার টাকা নিয়ে রামপুরায় নামিয়ে দেন।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ভাষানটেক থানার পরিদর্শক আবুল হাসনাত খন্দকার বলেন, ঢাকায় বেড়ে ওঠা নাজমুল একজন ক্রমিক ধর্ষক (সিরিয়াল রেপিস্ট)। নগরীতে গাড়ি চালানোর আড়ালে সুযোগ পেলেই তিনি বহু তরুণীকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করেছেন। থানায় মামলা করেছেন কয়েকজন ভুক্তভোগী তরুণী। অনেকে মামলা করেননি।

পুলিশ কর্মকর্তা আবুল হাসনাত খন্দকার বলেন, নাজমুলকে তিনি নিবিড়ভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। নাজমুল একজন পেশাদার অপরাধী। অপরাধের তথ্য লুকিয়ে তিনি নতুন নতুন গাড়ি ভাড়া নিয়ে চালান।

নাজমুলকে গাড়ি ভাড়া দিয়ে বিপদে পড়েছিলেন আমিনুল এহসান নামের এক ব্যক্তি। তিনি বলেন, তিন মাস আগে তাঁর কারটি ভাড়া নিয়ে উবারে চালাতেন নাজমুল। লিখিত চুক্তিও হয়। পরে ওই গাড়ির ভেতরে ধর্ষণের অভিযোগে নাজমুলকে গ্রেপ্তারের পাশাপাশি গাড়িটিও জব্দ করেছে পুলিশ। এখন গাড়িটি পুলিশি হেফাজতে রয়েছে।

২০২০ সালে দারুসসালাম থানায় করা মামলার এজাহারের ভাষ্য অনুযায়ী, নাজমুল ও তাঁর সহযোগী সাইফুলসহ অন্যরা ২৫ বছর বয়সী এক নারীকে গাড়িতে তুলে তাঁর কাছ থেকে ১৫ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেন। তবে আসামিপক্ষের আইনজীবী আরিফুর রহমান খান বলেন, সাইফুল ও নাজমুল নিরপরাধ।

বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি সালমা আলী বলেন, এক যুগ ধরে যে ব্যক্তি গাড়িতে তুলে নিয়ে নারীদের ধর্ষণ করেছেন, তিনি অবশ্যই একজন ‘সিরিয়াল রেপিস্ট’। যাঁর বিরুদ্ধে তিনটি ধর্ষণের মামলা, প্রতিটির অভিযোগই হচ্ছে, গাড়িতে তুলে ধর্ষণ করেছেন তিনি। এমন অপরাধীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।