পদ্মা ট্রিবিউন ডেস্ক: লাখো কণ্ঠে আল্লাহর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ।‘হে আল্লাহ আমি হাজির, তোমার কোনো শরিক নেই, সব প্রশংসা ও নিয়ামত শুধু তোমারই, সব সাম্রাজ্যও তোমার।’
‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক’—লাখো কণ্ঠে মহান আল্লাহর প্রতি আনুগত্য প্রকাশের মধ্য দিয়ে গতকাল শনিবার পালিত হলো পবিত্র হজ।
সৌদি আরবের পবিত্র মক্কা নগরীর আরাফাত ময়দানে লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসল্লি পবিত্র হজ পালনের উদ্দেশ্যে সমবেত হন। তাঁদের কণ্ঠে ছিল ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা শারিকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হাম্দা ওয়ান নি’মাতা লাকা ওয়াল মুল্ক, লা শারিকা লাক’ (আমি হাজির, হে আল্লাহ আমি হাজির, তোমার কোনো শরিক নেই, সব প্রশংসা ও নিয়ামত শুধু তোমারই, সব সাম্রাজ্যও তোমার)।
বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা লাখ লাখ মুসল্লি পাপমুক্তি ও আত্মশুদ্ধির আকুল বাসনা নিয়ে এবার পবিত্র হজ পালন করেছেন। তাঁরা গতকাল সূর্যোদয়ের পর মিনা থেকে ট্রেনে, বাসে ও পায়ে হেঁটে রওনা হন আরাফাতের ময়দানের দিকে। তাঁদের কণ্ঠে ছিল একটাই রব, ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক।’
হজের খুতবা দেন খতিব শায়েখ ড. মাহের আল মুয়াইকিলি। বিশ্বের মুসলমানদের আল্লাহকে ভয় করে চলার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, এর মধ্য দিয়ে মুসলমানরা জীবনে কল্যাণ, আল্লাহর সন্তুষ্টি ও মৃত্যু–পরবর্তী জীবনে নিয়ামতপূর্ণ জান্নাত অর্জন এবং জাহান্নামের সব ধরনের শাস্তি থেকে মুক্তিলাভ করতে পারেন।
আরাফাতের ময়দানে সমবেত হয়ে হাজিরা কেউ পাহাড়ের কাছে, কেউ সুবিধাজনক জায়গায় বসে ইবাদত করেন। কেউ যান জাবালে রহমতের কাছে। আবার কেউ যান মসজিদে নামিরায় হজের খুতবা শুনতে।
মূলত ৯ জিলহজ আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করে হজ পালন করা হয়। এ ময়দানে উপস্থিত হওয়া হজের অন্যতম ফরজ। পবিত্র হজ ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের একটি। আর্থিকভাবে সমর্থ ও শারীরিকভাবে সক্ষম পুরুষ ও নারীর জন্য হজ ফরজ।
আরাফাতের ময়দানে হাজার হাজার অস্থায়ী তাঁবু টানানো আছে। হাজিরা তাঁবুর ভেতরে নামাজ, দোয়া-দরুদ, কোরআন শরিফ তিলাওয়াতসহ অন্যান্য ইবাদত–বন্দেগি করেন। প্রতিটি তাঁবুর সামনেই খাওয়ার পানির পাত্র রয়েছে। কিছু দূর পরপর রয়েছে শৌচাগার।
আরাফাত ময়দান মিনা থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এ ময়দানে অবস্থিত মসজিদটির নাম মসজিদে নামিরাহ। মসজিদে মিনার আছে ৬টি। প্রতিটি মিনারের উচ্চতা ৬০ মিটার। মসজিদটিতে ৬৪টি গম্বুজ এবং ১০টি প্রধান দরজা রয়েছে। এই মসজিদের জামাতে অংশগ্রহণকারী হাজিরা জোহর ওয়াক্তে এক আজানে দুই ইকামতের সঙ্গে একই সময় পরপর জোহর ও আসরের নামাজ আদায় করেন। নামাজের আগে ইমাম সাহেব খুতবা দেন।
হাজিদের জন্য পরবর্তী কাজ ছিল, সূর্যাস্তের পর মুজদালিফার উদ্দেশে রওনা দেওয়া। আরাফাত থেকে মুজদালিফা যাওয়ার পথে মাগরিবের নামাজের সময় হলেও নামাজ পড়া নিষিদ্ধ। সেখানে পৌঁছানোর পর মাগরিব ও এশার নামাজ একসঙ্গে পড়েন হাজিরা। মুজদালিফার খোলা প্রান্তরে খোলা আকাশের নিচে রাত কাটাতে হয়। কারণ, এই মুজদালিফার খোলা প্রান্তরে খোলা আকাশের নিচে রাত কাটান আদি পিতা হজরত আদম (আ.) ও আদি মাতা হজরত হাওয়া (আ.)।
শয়তানের উদ্দেশ্যে পরপর তিন দিন ছুড়তে ৭০টি পাথর সংগ্রহ করতে মুজদালিফায় অবস্থান করা ওয়াজিব। ফজরের নামাজ পড়ে দোয়া–দরুদ পড়ে সূর্যোদয়ের কিছু আগে মিনার উদ্দেশে রওনা দেওয়া ও পরে বড় জামারায় গিয়ে শয়তানের উদ্দেশ্যে পাথর নিক্ষেপ করা হাজিদের পরবর্তী কাজ। জামারা হলো মিনা ময়দানে অবস্থিত তিনটি স্তম্ভ। এগুলোর নাম জামারাতুল উলা বা ছোট জামারা, জামারাতুল উসতা বা মধ্যম জামারা ও জামারাতুল কুবরা বা বড় জামারা।
পাথর নিক্ষেপ–পরবর্তী কাজ হলো কোরবানি করা। হাজিরা কোরবানির টাকা নির্ধারিত ব্যাংকে আগেই জমা দেওয়ায় কোরবানির জন্য নির্ধারিত স্থানে যেতে হবে না। জামারা থেকে বেরিয়ে পুরুষ হাজিদের মাথা মুণ্ডন করতে হয়।
পবিত্র মসজিদুল হারামের চত্বরের এক প্রান্ত থেকে একটা পায়ে চলা পথ জামারার দিকে চলে গেছে। রাস্তাটির বেশির ভাগ অংশ পাহাড়ের বুক চিরে তৈরি করা টানেল। এই রাস্তার নাম আল রাহমাহ স্ট্রিট বা সহজে চেনার জন্য পায়ে হাঁটার পথ। টানেলের ভেতর পর্যাপ্ত আলো ও বাতাসের ব্যবস্থা আছে। মাথার ওপর বিশাল আকারের ফ্যান। সেগুলো থেকে বাতাস ছড়িয়ে পড়ে। এ টানেল ছাড়াও গাড়িতে যাতায়াত করা যায়।
হাজিরা মিনায় দুই দিন অবস্থান করে নিজ তাঁবুতে সময়মতো নামাজ আদায় করবেন। হজের অন্য আনুষঙ্গিক কাজ, যেমন প্রতিদিন জামারায় তিনটি (ছোট, মধ্যম, বড়) শয়তানকে সাতটি করে পাথর নিক্ষেপ করবেন। মিনার কাজ শেষে আবার পবিত্র মক্কায় বিদায়ী তাওয়াফ করে নিজ নিজ দেশে ফিরবেন। যাঁরা পবিত্র মদিনায় যাননি, তাঁরা সেখানে যাবেন।
হজের খুতবায় মুসলিম উম্মাহর উদ্দেশে শায়েখ ড. মাহের আল মুয়াইকিলি বলেন, ‘আজকের এই দিন আমাদের ইসলামের পূর্ণতাদানের মাধ্যমে আমাদের ওপর আল্লাহ তাআলার পূর্ণ নিয়ামতের বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দেয়।’ তিনি বলেন, ‘আল্লাহ তাআলা এই উম্মতকে পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহ মুখস্থ, আত্মস্থ ও আয়ত্ত করার এমন শক্তি দান করেছেন, যা আগের কোনো জাতি পায়নি—প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর। কারণ, হজরত মুহাম্মদ (সা.)–এর পর আর কোনো নবী আসবেন না।