প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা | ফাইল ফটো

শেখ শাহরিয়ার জামান: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আসন্ন ভারত সফরের পূর্ণ প্রস্তুতি চলছে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী ২১-২২ জুন দিল্লি সফর করবেন তিনি। আনুষ্ঠানিকভাবে দ্বিপক্ষীয় এই সফরে দুই দেশের সম্পর্ক আরও দৃঢ় করার লক্ষ্যে বিভিন্ন সহযোগিতার বিষয়ে সমঝোতা ও আলোচনা, অমীমাংসিত বিষয়ের সমাধান, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে দুই দেশের অবস্থানসহ বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে আলোচনা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

প্রধানমন্ত্রীর দিল্লি সফরে এবার আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট, ভূ-রাজনীতি, বিশেষ করে চীনের অবস্থান নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হতে পারে বলে মনে করেন সাবেক কূটনীতিকরা। তাদের মতে, দিল্লি ও বেইজিংয়ের মধ্যে অস্বস্তিকর সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ ও চীনের সম্পর্কের মাত্রা কী হতে পারে—সে বিষয়ে ভারত তাদের অবস্থান পরিষ্কার করবে।

এ বিষয়ে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ও দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ার মো. শহীদুল হক বলেন, ‘আমার মতে, প্রধানমন্ত্রীর এবারের দিল্লি সফরকে বৃহৎ ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট থেকে বিবেচনা করা দরকার। বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক শুধু দ্বিপক্ষীয় উপাদানের ওপর নির্ভর করে না। বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের সম্পর্কের ব্যাপ্তি ও গভীরতাও ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কে বড় ধরনের প্রভাব ফেলে।’

সাবেক রাষ্ট্রদূত মো. সুফিউর রহমান বলেন, ‘এশিয়ার মধ্যে ভারত ও চীন দুটি বৃহৎ শক্তি। উভয়ই তাদের প্রভাব বলয় (স্ফিয়ার অব ইনফ্লুয়েন্স) বাড়াতে চায়। ফলে দক্ষিণ এশিয়া, প্রতিবেশী এবং অন্যান্য অঞ্চলেও প্রভাব বাড়ানোর জন্য উভয়ের প্রতিযোগিতা রয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যে বৈশ্বিক কাঠামো গড়ে উঠেছিল, সেটি ভেঙে পড়ছে। ফলে নতুন যে বহু শক্তির (মাল্টিপোলার) বৈশ্বিক ব্যবস্থা তৈরি হচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে, সেখানে গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে চীন প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে এবং ভারত আবির্ভূত হচ্ছে।’

উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় পানি, কানেক্টিভিটি, বিদ্যুৎসহ বিভিন্ন বিষয়ের পাশাপাশি আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক পরিস্থিতি নিয়েও কথা হয়। এবারে ভারতের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দ্বিপক্ষীয় বেইজিং সফরের কথা রয়েছে। জুলাই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে ওই সফরকে অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে সরকার।

প্রভাব বলয়
২০১৩ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং উচ্চাভিলাষী বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ ঘোষণা করে। এর বিপরীতে ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র তাদের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল ঘোষণা করে। যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলে ‘চীন ঠেকাও’ (চায়না কনটেইনমেন্ট) বিষয়টি পরিষ্কারভাবে প্রকাশ্যে উল্লেখ করা হয়েছে এবং এ বিষয়ে মিত্রদের সঙ্গে তারা কাজ করবে বলে ঘোষণা দেয়।

এ বিষয়ে শহীদুল হক বলেন, ‘পৃথিবীতে দুটি বৃহৎ মতাদর্শ রয়েছে। একটি ওয়াশিংটন কনসেনসাস এবং অপরটি বেইজিং কনসেনসাস।’

ওয়াশিংটন কনসেনসাস উদার মূল্যবোধ, গণতন্ত্র, নিয়মতান্ত্রিক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাকে সমর্থন করে বলে দাবি করে। পশ্চিমা বিশ্ব, ভারত, জাপান, অস্ট্রেলিয়াসহ পৃথিবীর অনেক দেশ এটি মেনে চলে। অপরদিকে বেইজিং কনসেনসাস গণতন্ত্রের ভিন্ন ব্যবস্থা, সমাজতান্ত্রিক মূল্যবোধ, স্থিতিশীলতাকে সমর্থন করে বলে তিনি জানান।

এ বিষয়ে সুফিউর রহমান বলেন, ‘দুই বৃহৎ শক্তির এই দ্বন্দ্ব কোনও গোপন বিষয় নয়। তাদের মধ্যে যে গ্যাপ রয়েছে, সেটি ক্রমশই কমছে।’

‘এশিয়া পাওয়ার ইনডেক্স ২০২৩’-কে উদ্ধৃত করে তিনি বলেন, র‌্যাঙ্ক অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র এবং তার পয়েন্ট হচ্ছে ৮০ দশমিক ৭। দ্বিতীয় বৃহৎ শক্তি হচ্ছে চীন এবং তার পয়েন্ট হচ্ছে ৭২ দশমিক ৫। তৃতীয় ও চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে জাপান ও ভারত এবং তাদের পয়েন্ট হচ্ছে যথাক্রমে ৩৭ দশমিক ২ এবং ৩৬ দশমিক ৩। পঞ্চম অবস্থানে রাশিয়া এবং তার পয়েন্ট হচ্ছে ৩১ দশমিক ৬।

তিনি বলেন, ‘এই ইনডেক্স দেখলে বোঝা যায় চীন দ্রুত এগিয়ে আসছে।’

রুপি, রেনমিনবি, ইউরো নাকি ডলার
বিভিন্ন শক্তির সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ প্রাধান্য দেয় অর্থনৈতিক বিষয়। কিন্তু বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারত, চীন বা যুক্তরাষ্ট্র প্রাধান্য দেয় নিরাপত্তা ও কৌশলগত বিবেচনা। ওইসব দেশ বাংলাদেশকে বঙ্গোপসাগরের একটি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচনা করে এবং ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল ও বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের কারণে নিরাপত্তার বিষয়টি তাদের কাছে প্রাধান্য পায়। ফলে বাংলাদেশের সঙ্গে ওইসব দেশের দৃষ্টিভঙ্গির সামঞ্জস্যহীনতা আছে।

এ বিষয়ে শহীদুল হক বলেন, ‘বঙ্গোপসাগর অঞ্চলে বাংলাদেশের গুরুত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক সহযোগিতার পাশাপাশি নিরাপত্তা সহযোগিতাও বাড়াতে হবে। কারণ ভারত মহাসাগর অঞ্চলে রুলবুক হচ্ছে ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল এবং চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ।’

আন্তর্জাতিক ও বঙ্গোপসাগরের নিরাপত্তার বিষয়টিকে বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতিতে অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়োজনীয়তা আছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এটিকে একদম পৃথকভাবে দেখাটা বাংলাদেশের স্বার্থের জন্য এখন মনে হয় ঠিক হবে না।’

এ বিষয়ে সুফিউর রহমান বলেন, ‘বিভিন্ন অর্থনৈতিক সূচক পর্যালোচনা করলে বোঝা যায়—বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, অভ্যন্তরীণ ভঙ্গুরতা এবং বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আরও শক্তিশালী হওয়া দরকার।’

বাংলাদেশের সহযোগিতার প্রয়োজন এবং এই সহযোগিতা রুপি, ইয়েন, রেনমিনবি, ইউরো বা ডলার—কোন মুদ্রায় আসবে, কখন আসবে এবং কোন শর্তে আসবে, সেটি এখন দেখার বিষয় বলে তিনি জানান।

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে—যেখান থেকেই সহযোগিতা আসুক, অন্য পক্ষগুলোকে বোঝানো যে এই সহযোগিতা বাংলাদেশের দরকার এবং এটি অন্য কোনও দেশের ক্ষতির কারণ হবে না।’