স্বাস্থ্যসেবায় অবহেলাসহ নানা বঞ্চনায় মাঠপর্যায়ের পুলিশ

বাংলাদেশ পুলিশ

নুরুল আমিন: কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট নেই। আট ঘণ্টার বেশি দায়িত্ব পালন করেও পান না ‘ওভারটাইম’ ভাতা। নেই স্বাস্থ্যসম্মত থাকা–খাওয়ার ব্যবস্থা। পাওয়া যায় না নিয়মিত ছুটি। আবার জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আছে দুর্ব্যবহার করার অভিযোগ। এত সবের বাইরেও রয়েছে রাজনৈতিক বিবেচনায় ও ঘুষ দিয়ে পদোন্নতি-বদলিজনিত বঞ্চনা।

এভাবে নানামুখী চাপ ও বঞ্চনায় কাজ করতে গিয়ে মাঠপর্যায়ে দায়িত্ব পালনকারী পুলিশ সদস্যদের মধ্যে প্রায়ই ঘটছে পারিবারিক বিবাদ, বিবাহবিচ্ছেদ ও আত্মহত্যার ঘটনা।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) একাধিক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, পুলিশ কনস্টেবলদের অধিকাংশই বিভিন্ন ব্যারাকে থাকেন। সেখানে থাকা–খাওয়ার পরিবেশ অত্যন্ত খারাপ। এখানে থেকে–খেয়ে যে কারও পক্ষে ১০-১২ ঘণ্টা দায়িত্ব পালন করা কষ্টকর।

এই পুলিশ সদস্যদের অভিযোগ, সুযোগ-সুবিধার যত উদ্যোগ, সব বিসিএস পুলিশ ক্যাডারের সদস্যদের ঘিরে। সহিংসতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ বিভিন্ন প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করে যাঁরা মাঠপর্যায়ে দায়িত্ব পালন করেন, তাঁদের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো হয় না। থাকা–খাওয়া, পদোন্নতি–বদলির ক্ষেত্রে এমন বঞ্চনা কমানো না গেলে ভবিষ্যতে মাঠ পুলিশে ‘গুলশানের’ মতো অপরাধের ঘটনা বাড়বে বলে আশঙ্কা তাঁদের।

নজরের বাইরে মানসিক স্বাস্থ্য 
বঞ্চনার শিকার হওয়ার পাশাপাশি মাঠপর্যায়ের পুলিশের মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি থাকছে অবহেলিত। সম্প্রতি রাজধানীর গুলশানে এক পুলিশ কনস্টেবল দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় সহকর্মীকে গুলি করে হত্যা করার পর বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় এসেছে।

এর আগে গত বছর ঢাকার বনানীর একটি তল্লাশিচৌকিতে দায়িত্ব পালনকালে আশরাফুজ্জামান রনি (২২) নামের এক পুলিশ সদস্য বুকে গুলি করে ‘আত্মহত্যা’ করেন। একই বছর পঞ্চগড়ে স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া করে ‘আত্মহত্যা’ করেন ফিরোজ আহমেদ (২৭) নামের আরেক পুলিশ সদস্য।

পুলিশে অপরাধের ঘটনা তদন্তে কাজ করছেন এমন ২০ পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তাঁরা বলছেন, কনস্টেবল থেকে পরিদর্শক পর্যন্ত পুলিশ সদস্যদের দিনে ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা দায়িত্ব পালন করতে হয়। কাজ শেষে ব্যারাকে ফিরেও ভালো খাবার ও থাকার ব্যবস্থা পান না তাঁরা। এই যখন অবস্থা, তখন তাঁদের মানসিক স্বাস্থ্যের খোঁজ রাখবে কে?

এই পুলিশ সদস্যরা আরও বলেন, এখন রাজনৈতিক বিবেচনা ও ঘুষ ছাড়া পদোন্নতি, ভালো জায়গায় বদলি হওয়া যায় না। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা দুর্ব্যবহার করেন। সব মিলিয়ে শারীরিক–মানসিক সমস্যায় ভোগা মাঠ পুলিশ সদস্যরা ভালো নেই।

সংস্কারে নানা প্রস্তাব, বাস্তবায়ন কত দূর
২০২০ সালে পুলিশ সদর দপ্তর পুলিশ বাহিনীতে সংস্কারের একটি উদ্যোগ নেয়। সেখানে ‘রূপকল্প ২০২১ ও রূপকল্প ২০৪১ বাস্তবায়ন’ ও ‘জনগণের পুলিশ’ গঠনে নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি, ছুটি, আবাসন, চিকিৎসা, সন্তানদের শিক্ষা, আচরণ, দুর্নীতি ও নারী সদস্যদের সমস্যা সমাধানে একটি গবেষণা করা হয়।

গবেষণায় পুলিশের স্বাস্থ্য ও কল্যাণে ১৩ ধরনের মতামত দেন এতে অংশ নেওয়া পুলিশ সদস্যরা। সেখানে স্বাস্থ্যসম্মত থাকা–খাওয়ার ব্যবস্থা, কর্মঘণ্টা নির্ধারণ ও ওভারটাইম ভাতা প্রদান, বার্ষিক ছুটি বাড়ানো, শহীদ পুলিশ সদস্যদের পরিবারের জন্য আজীবন রেশন–ব্যবস্থা চালু, রোগতত্ত্ব ইউনিট তৈরি, চিকিৎসাব্যবস্থার আধুনিকায়ন, শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা নিশ্চিতকরণের মতো বিষয়গুলো উঠে এসেছে।

গবেষণায় উঠে এসেছে পুলিশের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের দুরবস্থার চিত্রও। এর পরিপ্রেক্ষিতে গবেষণায় চিকিৎসাব্যবস্থার আধুনিকায়ন এবং শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে ১৩টি প্রস্তাব করা হয়। উল্লেখযোগ্য প্রস্তাবের মধ্যে ছিল ২৪ ঘণ্টায় তিন শিফটে আট ঘণ্টা কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করা, স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে ছুটি, বিনোদন, খেলাধুলার সময় নির্দিষ্ট করা।

কিন্তু চার বছর পরও মাঠপর্যায়ে পুলিশের বঞ্চনার অবসান, বিশেষ করে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করায় তেমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

ওই গবেষণায় যুক্ত একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘সামগ্রিকভাবেই সারা দেশের মানুষের মধ্যে অস্থিরতা কাজ করছে। পুলিশ সদস্যরাও এ সমাজের একটি অংশ। তাই এর প্রভাব পুলিশের মধ্যে রয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘পুলিশ বাহিনীতে ইতিবাচক পরিবর্তনে অনেক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। অনেক বিষয় বাস্তবায়ন হয়েছে, কিছু বাস্তবায়নের কাজ চলছে। তবে মাঠ পুলিশ সদস্যদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যসেবার বিষয় এখনো অনেকাংশেই অবহেলিত রয়ে গেছে।’

এ বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্র সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) ইনামুল হক সাগর বলেন, ‘যখন পুলিশ সদস্যদের নিয়োগ দেওয়া হয়, তখন মৌলিক প্রশিক্ষণে স্ট্রেস ম্যানেজমেন্টের বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকে। এরপর দীর্ঘ চাকরিজীবনে ইনসার্ভিস প্রশিক্ষণেও কীভাবে মানসিক চাপ মোকাবিলা করা যায়, সেটা শেখানো হয়, কাউন্সেলিং করা হয়।’

গুলশানের ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা উল্লেখ করে পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘যাতে এ ধরনের ঘটনা না ঘটে, সে জন্য প্রয়োজনে স্ট্রেস ম্যানেজমেন্টের চর্চা আরও বাড়ানো হবে।’

জানতে চাইলে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘পুলিশ সদস্যদের সব সময় মানসিক চাপের কাজ করতে হয়। তাই নিয়োগের সময় শারীরিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি মানসিকভাবে তিনি পুলিশের চাকরির জন্য ফিট (সক্ষম) কি না, সেটা বিবেচনায় নিতে হবে।  চাকরিকালে কোনো পুলিশ সদস্যের মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটল কি না, সেটা নিয়মিত পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে।’