কুকুরের ঘেউ ঘেউ শব্দে স্থানীয়দের হাতে ধরা পড়েন জেল পালানো চার কয়েদি

পালিয়ে যাওয়া মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত চার আসামি | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

প্রতিনিধি বগুড়া: বগুড়া কারাগারের মূল ফটকের সামনে ১০০ মিটার দূরেই করতোয়া নদী। কারাগারের কনডেমড সেলের ছাদ ফুটো করে করতোয়া নদীর তীর ধরে পালাচ্ছিলেন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত চার আসামি। কারাগার থেকে উত্তর দিকে প্রায় আধা কিলোমিটার পথ নদীর পাড় ধরে এগিয়ে যান তাঁরা। গন্তব্য ছিল নির্মাণাধীন শহরের ফতেহ আলী সেতুর পাশে বাঁশের সাঁকো। সাঁকো পার হয়ে সাবগ্রাম দ্বিতীয় বাইপাস সড়কে গিয়ে দূরপাল্লার বাস ধরবেন।

বাঁশের সাঁকো পার হওয়ার আগেই বাগড়া দেয় ফতেহ আলী বাজারের পাশে থাকা একদল কুকুর। রাতের অন্ধকারে মানুষের উপস্থিতি টের পেয়েই ঘেউ ঘেউ করতে থাকে কুকুরের দল। আওয়াজ পেয়ে এগিয়ে আসেন কয়েকজন যুবক। একজনের হাতে স্ক্রু ড্রাইভার, অন্যজনের পরনে জেলখানার কয়েদির ট্রাউজার। শরীর ঘামে আধভেজা। একজনের হাতে ব্যাগে সিগারেটের অনেক প্যাকেট। এসব দেখে যুবকেরা সেখানে এসে চারজনকে নানা প্রশ্ন করতে শুরু করেন। এ সময় চারজন নিজেদের রাজমিস্ত্রি বলে পরিচয় দেন।

বগুড়া জেলা কারাগার থেকে গত মঙ্গলবার দিবাগত রাত ৩টা ৫৬ মিনিটের দিকে ছাদ ফুটো করে রশির মাধ্যমে প্রাচীর টপকে পালান মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত চার আসামি। পরে পুলিশ অভিযান চালিয়ে আজ বুধবার ভোর ৪টা ১০ মিনিটের দিকে শহরের চেলোপাড়া চাষীবাজারের মাছের আড়ত এলাকা থেকে তাঁদের গ্রেপ্তার করে। এর আগে তাঁদের ধরে ফেলেন কয়েকজন যুবক। এলাকার লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় এসব তথ্য।

আবু সাঈদ বলেন, কুকুরের দল ঘেউ ঘেউ করলে তাঁরা ভাবেন, চোর এসেছে। তখন সাঁকোর কাছে চলে আসেন তাঁরা। এসে দেখেন, চারজন বাঁশের সাঁকো পার হয়ে সাবগ্রাম যেতে চাইছেন। লোকজনের জিজ্ঞাসাবাদের মুখে পড়ে তাঁরা বলেন, শহরের বনানী এলাকায় একজন ঠিকাদারের কাজ করছিলেন। বনিবনা না হওয়ায় ঠিকাদার তাঁদের মারধর করেছেন। এ জন্য রাতে পালিয়ে যাচ্ছিলেন। সাবগ্রাম বাজারে গিয়ে গাড়ি ধরবেন, কিন্তু এসব কথা সন্দেহজনক মনে হয়েছিল তাঁদের।

পরে ওই চারজনকে শহরের চাষীবাজার-সংলগ্ন পার্কে আটকে রেখে ৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পরিমল চন্দ্র দাসকে খবর দেন লোকজন। তখন পৌর কাউন্সিলর আটক ব্যক্তিদের পুলিশে দিতে বলেন। অবস্থা বেগতিক বুঝতে পেরে চারজন স্বীকার করেন, তাঁরা মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি, কারাগার থেকে পালিয়েছেন। ছেড়ে দিতে বলেন তাঁদের। বিনিময়ে ৫০-৬০ প্যাকেট সিগারেটও দেন। পরে কাউন্সিলর পরিমল চন্দ্র দাসের নির্দেশে পুলিশে খবর দেওয়া হয়। সদর ফাঁড়ি পুলিশ চারজনকে গ্রেপ্তার করে রাতেই ডিবি কার্যালয়ে নেয়।

চেলোপাড়ার বাসিন্দা নয়ন মোল্লা বলেন, ‘কারাগার থেকে পালানো চারজনের কাছ থেকে প্রায় ৫০ প্যাকেট সিগারেট পাওয়া যায়। সিগারেটগুলো তাঁরা আমাদের দিয়ে দেন। বিনিময়ে ছেড়ে দিতে বলেন। একজনের হাতে স্ক্রু ড্রাইভার ও একজনের পরনে কয়েদির ট্রাউজার দেখেই অপরাধী সন্দেহ হয়েছিল আমাদের।’

চার কয়েদি আবার কারাগারে
কারাগারের কনডেমড সেলের ছাদ ফুটো করে চার আসামি পালানোর ঘটনায় বগুড়া কারাগারের জেলার ফরিদুর রহমান বাদী হয়ে বগুড়া সদর থানায় মামলা করেছেন। সেই মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে কয়েদিদের আজ সন্ধ্যায় আবার বগুড়া জেলা কারাগারে পাঠানো হয়েছে।  

ওই কয়েদিরা হলেন কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী উপজেলার দিয়াডাঙ্গা এলাকার নজরুল ইসলাম (কয়েদি নম্বর ৯৯৮), নরসিংদীর মাধবদী উপজেলার ফজরকান্দি এলাকার আমির হোসেন (কয়েদি নম্বর ৫১০৫), বগুড়ার কাহালু পৌরসভার মেয়র ও উপজেলা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আবদুল মান্নানের ছেলে মো. জাকারিয়া (কয়েদি নম্বর ৩৬৮৫) ও বগুড়ার কুটুরবাড়ি পশ্চিম পাড়া এলাকার ফরিদ শেখ (কয়েদি নম্বর ৪২৫২)। 

মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত চার আসামিকে বগুড়া জেলা কারাগারের জাফলং সেলের ২ নম্বর ওয়ার্ডে রাখা হয়েছিল। মঙ্গলবার রাত ৩টা ৫ মিনিটে  কারারক্ষী স্বপন মিয়া কারাগারের উত্তর পাশের কারাপ্রাচীরে বিছানার চাদর গিঁট দিয়ে তৈরি রশি ঝুলতে দেখেন। বিষয়টি সঙ্গে সঙ্গে দায়িত্বপ্রাপ্ত সহকারী প্রধান রক্ষী দুলাল ও জেল সুপারকে জানানো হয়। পরে প্রধান কারারক্ষী আমিনুল হক জানান, জাফলং সেলে মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া চারজন বন্দী নেই।

সেলে গিয়ে দেখা যায়, কারাগারের জাফলং সেলের ২ নম্বর ওয়ার্ডের ছাদ ফুটো করা। পরে বগুড়ার পুলিশ সুপারকে বিষয়টি জানানো হয়। তাৎক্ষণিকভাবে পুলিশ পলাতক কয়েদিদের গ্রেপ্তারে অভিযান পরিচালনা করে। ভোর অনুমান ৪টা ১০ মিনিটে চাষীবাজার এলাকা থেকে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় কয়েদি ফরিদ শেখের কাছ থেকে ৪ দশমিক ৩ ইঞ্চি লম্বা একটি স্টিলের পাত, ৭ ইঞ্চি লম্বা একটি স্ক্রু ড্রাইভার উদ্ধার করা হয়।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও সদর ফাঁড়ির ইনচার্জ সুজন মিঞা বলেন, চার কয়েদিকে নতুন মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডের আবেদন করা হবে কি না, এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।