সুহাদা আফরিন: আসিফ মাহমুদ খানের পরিচিত একজনের নীলফামারীতে গরুর খামার রয়েছে। সে খামার থেকে তিনি গরু ফরমাশ করেছেন। খামার থেকে হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে গরুর ছবি ও ভিডিও পাঠানো হলে একটি পছন্দ করে তিনি এ সিদ্ধান্ত নেন। দুই দিন আগে গরুও পেয়েছেন। তবে ছবি ও ভিডিও দেখে যতটা বড় মনে হয়েছিল, বাস্তবে গরুটি তেমন মনে হচ্ছে না।
করোনা মহামারি শুরু হলে অনলাইনে গরুর হাটের চাহিদা বেড়ে যায়। অনেক খামারিই নিজেদের পশুর ছবি দিয়ে অনলাইনে প্রচার চালানো শুরু করে। এ চাহিদা মাথায় রেখে সরকারও ডিজিটাল হাট করে। তবে এবার খামারি থেকে শুরু করে ডিজিটাল হাট প্ল্যাটফর্ম সবখানেই আগ্রহ কম দেখা গেল। সরকারিভাবেও প্রচারও নেই।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিশেষ পরিস্থিতিতে ডিজিটাল বা অনলাইন হাটের চাহিদা বেড়ে গেলেও এখন সে পরিস্থিতি নেই। আস্থার সংকট, মনমতো না হওয়া, হাটে গিয়ে কেনার উৎসবের আমেজ, চোখে দেখে কেনাসহ বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ রয়েছে অনলাইনে।
বছিলার সিম্বা ক্যাটেল ফার্মের উদ্যোক্তা গাজী গিয়াসউদ্দিন দুই বছর অনলাইনে গরু বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছিলেন; কিন্তু এ বছর থেকে তা করছেন না। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, অনলাইনে বিক্রি করলে গ্রাহক সন্তুষ্টির বিষয়টি সামনে আসে। কখনো বলে ছবি মেলে না, রঙের সমস্যা, ওজন ঠিক নেই, ছোট মনে হয় ইত্যাদি। তাই এসব ঝামেলায় না যেতে এখন সরাসরি খামার থেকেই গরু বিক্রি করছেন তিনি।
হাইজেনিক অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রি নামের খামারের ফেসবুকে অনেক প্রচার দেখা যায়। উত্তরাভিত্তিক এই খামারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে এর ম্যানেজার মো. মহসীন বলেন, অনলাইনে তাঁরা প্রচার চালান। তবে সেখানে ফরমাশ আসে না। গরু দেখে ক্রেতা সরাসরি খামারে এসে গরু কেনেন। কারণ, ক্রেতা গরু চোখে দেখে কিনতে চান।
সরকারি হিসাবে, ২০২১ সালে সবচেয়ে বেশি ৩ লাখ ৮৭ হাজার পশু বিক্রি হয়। এর পরের বছর তা কমে ৭০ হাজার ৫৭০টি বিক্রি হয়। সর্বশেষ গত বছর, ২০২৩ সালে ডিজিটাল হাট প্ল্যাটফর্মে ৫৬ হাজার ৮২১টি পশু বিক্রি হয়।
গত কয়েক বছর অনলাইন হাটের চাহিদার কথা মাথায় রেখে দেশের প্রতিষ্ঠিত কিছু ই–কমার্স প্ল্যাটফর্মও কোরবানির পশু বিক্রির উদ্যোগ নেয়। এ বছর আর তাদের সে ধরনের প্রচার নেই।
ক্রেতা এবং বিক্রেতা দুই পক্ষই বলছে, হাটকেন্দ্রিক একটা উৎসবের আমেজ থাকে। বছরে একবার গরুর হাটের অভিজ্ঞতা নিতে যান অনেকে। আবার গরু স্বচক্ষে দেখে ও ছুঁয়ে কিনতেও অনেকে পছন্দ করেন। এ কারণে অনলাইন হাটের চাহিদা কমেছে।
যাঁরাই অনলাইনে কিনছেন, তাঁদের বেশির ভাগ পরিচিত ক্রেতা বা আগে নিয়েছেন ও অভিজ্ঞতা ভালো এমন ক্রেতা।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর হিসেবে কোরবানির বাজারে অনলাইন বিক্রির পরিমাণ ১২ শতাংশের মতো। তবে ডেইরি ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশন বলছে, এটা ৫ শতাংশ হতে পারে।
সরকারি প্ল্যাটফর্ম ‘সক্রিয়’ না
প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, আইসিটি বিভাগ, ই–ক্যাব, ডেইরি ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশন, আইসিটি বিভাগের প্রকল্প এটুআই ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে ২০২২ সালের ৩ জুলাই ডিজিটাল হাটের উদ্বোধন করে। সে বছর থেকে ডিজিটাল হাট স্থায়ী করারও উদ্যোগের কথা জানানো হয়। অর্থাৎ সারা বছরই সেখানে পশু বিক্রি হবে।
ডিজিটাল হাট ওয়েবসাইটে দেখা যায়, তাদের সঙ্গে যুক্ত খামারের সংখ্যা ৭২। এর মধ্যে তিনটি খামার থেকে গরুর ছবি ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। এ তিনটি খামারের মধ্যে দুটি খামারের ফোন নম্বর বন্ধ। বাকি একটির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ডিজিটাল হাট প্ল্যাটফর্ম থেকে সাড়া কম।
এই প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে যুক্ত ই–ক্যাব। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক নাসিমা আক্তার নিশা বলেন, ই–ক্যাব যুক্ত থাকলেও এটুআইয়ের একশপ প্ল্যাটফর্মই ডিজিটাল হাট দেখছে।
তবে ই–ক্যাবের তথ্যসূত্র দিয়ে লিখিত বক্তব্যে এটুআই কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, সারা দেশের ৬৬৮টি হাট যুক্ত রয়েছে। তবে এ বছর প্রান্তিক হাটগুলোতে তুলনামূলক কম পশু প্রদর্শিত হয়েছে। বাংলাদেশ ডেইরি ফার্ম অ্যাসোসিয়েশন, অনলাইন প্ল্যাটফর্ম, আঞ্চলিক হাট ও ই-ক্যাব সদস্য প্রতিষ্ঠানের অনলাইন হাট মিলিয়ে গতকাল ১৫ জুন পর্যন্ত ডিজিটাল হাটে ১০ হাজার ১৩৪টির বেশি পশু বিক্রি হয়েছে। যার বাজারমূল্য প্রায় ৯৫ কোটি ৫৯ লাখ টাকা।
ডিজিটাল হাট প্ল্যাটফর্মের একটি ফেসবুক পেজ আছে, যার লাইক সংখ্যা ১৩৭ এবং অনুসারী ১৪৩ জন। সর্বশেষ গত বছরের ২৬ জুন পোস্ট দেওয়া হয়।
সরকারি–বেসরাকরি এতগুলো সংস্থা ডিজিটাল হাট প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও তা নিয়ে কারোরই কোনো প্রচার নেই। প্ল্যাটফর্মটি দেখভালের দায়িত্বে থাকা একশপ প্ল্যাটফর্মের ফেসবুক পেজ, ওয়েবসাইট কোথাও প্রচার নেই। তারা একটি মুঠোফোন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের দূরে বসে অনলাইনে পশু বিক্রি–সংক্রান্ত একটি বিজ্ঞাপন শেয়ার করেছে।
এ ব্যাপারে এটুআই লিখিত বক্তব্যে জানিয়েছে, করোনার পর মানুষ সরাসরি হাটে গিয়েই পশু কিনতে পছন্দ করছেন। এ ছাড়া সরকার বিভিন্ন হাটে ক্যাশলেস লেনদেনের সুযোগ তৈরি করায় মানুষ সরাসরি হাটে যাচ্ছেন।
ডেইরি ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশনও বলছে, ডিজিটাল হাট প্ল্যাটফর্ম আগের মতো সক্রিয় না। এতে প্রান্তিক পর্যায়ের খামারিদের যুক্ত করতে কিছু উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন ছিল।
অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক শাহ এমরান বলেন, পরিচিতজনের মধ্যে অনলাইনে বিক্রি বেশি হয় এবং এ ধরনের ক্রেতা ঢাকাকেন্দ্রিক। কোরবানির পশু যেহেতু দামি পণ্য, তাই কেনার বেলায় আস্থার বিষয়টি অনেক বড় হয়ে দাঁড়ায়। শুরুতে ডিজিটাল হাট প্ল্যাটফর্ম বেশ সাড়া ফেললেও পরবর্তী সময়ে তা আর হয়নি।