নিহত শিশুর খণ্ডিত মাথার খোঁজে পুলিশ শিশুটির বাবা আজিজুল হককে সঙ্গে নিয়ে করতোয়া নদীতে তল্লাশি অভিযান পরিচালনা করে। সোমবার দুপুরে বগুড়া শহরের চেলোপাড়া রেলওয়ে সেতু এলাকায় | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
প্রতিনিধি বগুড়া: বগুড়ায় এক নারী ও তাঁর এক বছর বয়সী ছেলের মাথাবিহীন লাশ উদ্ধারের ঘটনায় গ্রেপ্তার ওই নারীর স্বামী সেনাসদস্য আজিজুল হক (২৩) আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। আজ সোমবার বিকেলে বগুড়ার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সাদিয়া আফসানা রিমার আদালতে তিনি এই স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। বগুড়া আদালতের পরিদর্শক মোসাদ্দেক হোসেন ও শাজাহানপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শহিদুল ইসলাম এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
নিহত নারীর নাম আশামণি (২০)। তিনি বগুড়া শহরের আকাশতারা এলাকার আসাদুল ইসলামের মেয়ে। আশামণির স্বামী অভিযুক্ত আজিজুল হক বগুড়ার ধুনট উপজেলার হেউতনগরের হামিদুর রহমানের ছেলে। তিন বছর আগে আশামণিকে বিয়ে করেন আজিজুল। এ দম্পতির সংসারে ছিল এক বছরের ছেলে আবদুল্লাহ আল রাফি। গতকাল রোববার রাতে বগুড়ার শাজাহানপুরের বনানীতে শুভেচ্ছা আবাসিক হোটেলের কক্ষে স্ত্রীকে হত্যার পর শিশুসন্তানকেও হত্যা করেন আজিজুল।
এ হত্যার ঘটনায় সেনাসদস্য আজিজুল হককে প্রধান আসামি করে শাজাহানপুর থানায় হত্যা মামলা করেন নিহত আশামণির বাবা আসাদুল ইসলাম। ওই মামলায় আজিজুল হকের বাবা হামিদুর রহমানকেও আসামি করা হয়েছে। ইতিমধ্যে আজিজুল হক ও তাঁর বাবা হামিদুর রহমানকে মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠানো হয়। আদালতে আজ আজিজুল হক স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। আজিজুল ও তাঁর বাবা হামিদুর রহমানকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
হত্যার শিকার আশামণি ও তাঁর এক বছরের ছেলে আবদুল্লাহ আল রাফি | ছবি: সংগৃহীত |
আজিজুল হক আদালতকে জানিয়েছেন, তাঁর মা-বাবার সঙ্গে স্ত্রী আশামণির বনিবনা হতো না। ঝগড়াবিবাদ লেগেই থাকত। সাংসারিক অশান্তির কারণে তিনি স্ত্রীকে হত্যা পরিকল্পনা করেন। পরিকল্পনা মোতাবেক কেনাকাটা করে দেওয়ার কথা বলে শনিবার বিকেলে শ্বশুরবাড়ি থেকে স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে শহরে বের হন। একফাঁকে বগুড়া শহর থেকে গরু জবাই করার চাকু কেনেন। এরপর স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে শুভেচ্ছা হোটেলে ওঠেন। সাড়ে আটটার দিকে পারিবারিক নানা বিষয়াদি নিয়ে বিতণ্ডার একপর্যায়ে স্ত্রীকে বাথরুমে নিয়ে গলা কেটে হত্যা করেন। এরপর লাশ বস্তায় ভরেন। স্ত্রীকে হত্যার সময় তাঁর এক বছর বয়সী শিশুসন্তান আবদুল্লাহ আল রাফি বিছানায় ঘুমিয়ে ছিল। স্ত্রীকে হত্যার পর তিনি হোটেলের নিচে নামেন। কিছুক্ষণ পরে আবার হোটেলের কক্ষে ফিরে যান। এ সময় ঘুমন্ত শিশুসন্তানের কাছে কিছুক্ষণ বসে ছিলেন। মাকে হত্যা করায় শিশুটি কার কাছে থাকবে, এ নিয়ে চিন্তায় পড়েন। আরও কিছুক্ষণ পর শিশুটি ঘুম থেকে জেগে উঠে মাকে না পেয়ে কান্নাকাটি শুরু করে। জানাজানির ভয়ে নিজের শিশুসন্তানকে গলা কেটে হত্যা করেন। ধারালো চাকুর আঘাতে দেহ থেকে শিশুর মাথা আলাদা হওয়ার পর দেহের খণ্ডিত অংশ খাটের নিচে লুকিয়ে রাখেন। এরপর ব্যাগে শিশুসন্তানের মাথা ভরে হোটেল কক্ষ থেকে বেরিয়ে করতোয়া নদীতে ফেলে দেন।
ভাড়া পরিশোধ করতে গিয়ে ধরা
পুলিশের একটি সূত্রে জানা যায়, শনিবার বিকেলে ৭০০ টাকায় বনানীর শুভেচ্ছা হোটেলের ৩০১ নম্বর কক্ষ ভাড়া করেন সেনাসদস্য আজিজুল হক। স্ত্রী-সন্তানকে হত্যার পর আজিজুল হক শ্বশুরবাড়ির লোকজনকে জানান, আশামণি ও রাফিকে শহর থেকে ইজিবাইকে বাসায় পাঠিয়েছেন। এরপর তাঁদের খোঁজ মিলছে না। শ্বশুরবাড়ির লোকজন আজিজুলের কথা বিশ্বাস করে খোঁজাখুঁজি শুরু করেন। রাতভর খুঁজে না পেয়ে আজিজুলকে নিয়ে তাঁর শ্বশুর সদর থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করতে যান। আজিজুল চাকরিতে সমস্যা হবে অজুহাতে জিডি করতে রাজি না হলে গতকাল সকালে শহরে মাইকিং করা হয়।
হোটেল ব্যবস্থাপক রবিউল ইসলাম বলেন, গতকাল সকাল ১০টার দিকে আজিজুল হোটেলের ভাড়া পরিশোধ করতে হোটেলের অভ্যর্থনা কক্ষে আসেন। কথাবার্তায় সন্দেহ হলে থানায় খবর দেওয়া হয়। পুলিশ এসে আজিজুলকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদের পর হোটেলের কক্ষ তল্লাশিকালে আজিজুলের স্ত্রী আশামণি ও সন্তান রাফির লাশ উদ্ধার হয়। পুলিশের জেরার মুখে আজিজুল জানান, স্ত্রী-সন্তানকে নিজেই গলা কেটে হত্যা করেছেন তিনি।
শিশুর দেহের খণ্ডিত অংশের সন্ধান মেলেনি
শিশু আবদুল্লাহ আল রাফির দেহের খণ্ডিত অংশের (মস্তক) সন্ধানে দ্বিতীয় দিনের মতো বগুড়ার করতোয়া নদীতে তল্লাশি অভিযান চালানো হলেও কোনো সন্ধান মেলেনি। আজ সকাল ১০টা থেকে বেলা আড়াইটা পর্যন্ত রাজশাহী থেকে আসা ডুবুরি দল বগুড়া শহরের রেলসেতু এলাকায় নদীতে সাড়ে চার ঘণ্টার অনুসন্ধান চালায়। তবে ওই শিশুর খণ্ডিত মাথার কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। পরে ডুবুরি দল উদ্ধার অভিযান সমাপ্ত ঘোষণা করে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে।
এর আগে গতকাল দুপুর ১২টা থেকে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত শিশুটির মাথার খোঁজে প্রথম দফায় করতোয়া নদীতে তল্লাশি অভিযান চালিয়েছিল ফায়ার সার্ভিসের কর্মী ও ডুবুরিরা।