কাজ ফেলে, পোশাক পরে ফেসবুক-টিকটকে পুলিশ

নাজমুল হাসান সাগর: সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক, টিকটকে দেখা মিলছে পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের পোস্ট, রিল, ভিডিও, ভ্লগ। কেউ কেউ রাস্তায় দাঁড়িয়ে জ্ঞান বিতরণ করছেন, কেউ অভিযানের ভিডিও ছাড়ছেন। তাঁদের মধ্যে কনস্টেবল পদের সদস্য যেমন আছেন, তেমনি আছেন উপমহাপরিদর্শকের (ডিআইজি) মতো উচ্চ পদের কর্মকর্তাও। দায়িত্ব পালনকালে, পুলিশের পোশাক পরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের এমন আত্মপ্রচার নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

দায়িত্ব পালনকালে পুলিশ সদস্যদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যক্তিগত ব্যবহার পরিহারের নির্দেশনা রয়েছে। কর্মকর্তারা বলছেন, নির্দেশনা অমান্য করা হলেও হাতে গোনা কয়েকটি ব্যবস্থার কারণে বাহিনীর আরও অনেক সদস্য এতে উৎসাহিত হচ্ছেন।

পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত আইজিপি (প্রশাসন) মো. কামরুল আহসান বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার নিয়ে সরকারের একটা নির্দেশনা আছে। আগে যাঁরা এ ধরনের কর্মকাণ্ড করেছেন, তাঁদের অনেকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। আরও কেউ যদি এমন করে থাকেন, তাঁদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

পুলিশ বাহিনীর কতজন সদস্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে আত্মপ্রচার করছেন, তার হিসাব পাওয়া কঠিন। আজকের পত্রিকার পক্ষ থেকে ৭০টি আইডি শনাক্ত করে অনুসন্ধান করা হয়েছে। এতে দেখা গেছে, ওই ৭০টি আইডির মধ্যে ১৫ জন টিকটক করেছেন; বাকিরা ফেসবুকে আছেন। জানা গেছে, কয়েকজন সদস্য নিজের ভ্লগে বেশি প্রচারের জন্য অর্থও খরচ করেছেন। তাঁদের মধ্যে অন্তত দুজন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে টাকাও পাচ্ছেন। আইডিগুলোর মধ্যে একজন ডিআইজি, একজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, একজন ওসি, ছয়জন এসআই, চারজন সার্জেন্ট, একজন নায়েক এবং বাকিরা কনস্টেবল পদমর্যাদার। জনপ্রিয়তার দিক থেকে এগিয়ে সার্জেন্টরা। টিকটক ও রিলস বেশি কনস্টেবলদের। তিন বছরের বেশি সময় ধরে তাঁরা এতে সক্রিয়।

পুলিশ সূত্র জানায়, বাহিনীর পোশাকে আপত্তিকর, দৃষ্টিকটু টিকটক ভিডিও করার অপরাধে ২০২২ সালে শাস্তির মুখে পড়েন ১৩ পুলিশ সদস্য। একই সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুয়া তথ্য আদান-প্রদান করায় পুলিশের তিন কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পুলিশ সদস্যদের আত্মপ্রচারমূলক ভিডিওর বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শিশির মনির আজকের পত্রিকা’কে বলেন, ব্যক্তিগত আবেগ-অনুভূতি তাঁরা জানাতেই পারেন, কিন্তু দায়িত্বরত অবস্থায় বাহিনীর পোশাক পরে নয়। দায়িত্বে থাকার সময় তাঁরা পুলিশ রেগুলেশনস, বেঙ্গলের (পিআরবি) বাইরে কিছু করতে পারেন না।

বইয়ের বিজ্ঞাপন ওসির

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তেজগাঁও থানায় ধারণ করা একটি ভিডিও গত ২০ ফেব্রুয়ারি নিজের ফেসবুক পেজে পোস্ট করেন ওই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মহসীন। ‘আত্মহত্যার আত্মকথা’ নামে নিজের লেখা বই হাতে করা তাঁর ভিডিওটির ক্যাপশনে বলা হয়েছে, ‘এটা রাগ নয়; এটা রোগ।’ বইয়ের একটি চরিত্রের বর্ণনাও দেওয়া হয়। পরে বইটি ক্যামেরার সামনে তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘বইটি পাওয়া যাচ্ছে...।’

পুলিশ সদস্যদের জন্য ২০২২ সালে প্রণীত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের নির্দেশিকায় বলা আছে, ‘পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে ব্যক্তিগত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার পরিহার করতে হবে।’ এদিকে ‘সরকারি প্রতিষ্ঠানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার নির্দেশিকা’য় বলা হয়েছে, ‘আত্মপ্রচারণামূলক কোনো পোস্ট’ করা যাবে না। 

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে মোহাম্মদ মহসীন বলেন, ‘মানুষকে সচেতন করাও পুলিশ হিসেবে আমার দায়িত্ব। তাদের কাছে গিয়ে বা থানায় ডেকে এনে সচেতন করা যায় না। তাই এই প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার।’

কাজের সময়ে বিদেশিকে শুভেচ্ছা
ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগের মোহাম্মদপুর জোনের সার্জেন্ট সাদ্দাম হোসেন ২ মে মোহাম্মদপুরের একটি সড়কে ধারণ করা ভিডিও নিজের ফেসবুক পেজে আপলোড করেন। সেখানে দেখা যায়, যানবাহন নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে থাকা সার্জেন্ট সাদ্দাম জার্মানি থেকে বাইক চালিয়ে বাংলাদেশে আসা পর্যটক বেঞ্জামিনকে থামিয়ে ফুল দিয়ে বরণ করেন। নিজের ভ্লগিংয়ের জন্য এর ভিডিও ধারণ করেন তিনি।

জানতে চাইলে সার্জেন্ট সাদ্দাম হোসেন বলেন, ‘বেঞ্জামিনকে উৎসাহিত করতে আয়োজনটা করেছিলাম। এটা খারাপ কিছু না।’

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, দায়িত্বরত অবস্থায় ফেসবুকিং, টিকটক করলে জনগণের টাকার অপচয় হয়। অভিযানে গিয়ে ভিডিও করে ফেসবুকে আপলোড করলে আইনের নানাবিধ লঙ্ঘন হয়। যেসব ভিডিও প্রকাশিত হচ্ছে, তাতে অন্যদের সম্মতি ও প্রাইভেসির ব্যাপার আছে। এ ছাড়া অনুসন্ধানের প্রক্রিয়ায় গোপনীয়তার প্রশ্নও আছে। সেটাও লঙ্ঘিত হচ্ছে। এসব কর্মকাণ্ড তাদের (পুলিশের) নিজস্ব চাকরিবিধির মাধ্যমে নিরুৎসাহিত করা উচিত।

ভুল তথ্য দিয়ে এসআইয়ের ভিডিও
টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী থানার এসআই জাহাঙ্গীর গত এপ্রিলে ‘দুটি নম্বর থেকে আসা কল রিসিভ করলেই ফোন হ্যাক’ শিরোনামে একটি ভিডিও পোস্ট করেন। ভিডিওতে তিনি দাবি করেন, ‘দুটি নম্বর থেকে যদি কারও ফোনে কল আসে এবং সেই কল রিসিভ করা হয়, তাহলে ফোনের যাবতীয় তথ্য হ্যাকাররা জেনে যাবে।’ ভিডিওটি নিয়ে সমালোচনা হলে তিনি ফেসবুক লাইভে এসে নিজের ভুল স্বীকার করেন।

সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য প্রণীত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, ‘ভিত্তিহীন, অসত্য ও অশ্লীল তথ্য প্রচার করা যাবে না।’ এ বিষয়ে জানতে এসআই জাহাঙ্গীরকে মোবাইলে দুদিন ফোন ও এসএমএস করেও সাড়া মেলেনি।

ডিএমপির ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের (উত্তর) উপকমিশনার তারেক আহমেদ বলেন, এটা আলাদা করে নজরদারির কিছু নেই। সরকারি কর্মকর্তা ও পুলিশের জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার নির্দেশিকা আছে। এর ব্যত্যয় হলে তাঁদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

‘এসপি ডট নাদিয়া ডট ফারজানা’
বাংলাদেশ ট্যুরিস্ট পুলিশের আইন ও গণমাধ্যম শাখার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার নাদিয়া ফারজানা। টিকটকে ‘এসপি ডট নাদিয়া ডট ফারজানা’ নামের একটি আইডি থেকে তাঁর দায়িত্বরত অবস্থার ভিডিও প্রায়ই পোস্ট করা হয়। কর্মস্থলের সভাকক্ষে পুলিশের পোশাক পরে তোলা তাঁর ছবি দিয়ে ভিডিও করে পোস্ট করা হয়েছে। ভিডিওটির নেপথ্যে সংলাপ ছিল, ‘কাউরে দোষ দিয়া কোনো লাভ নাই। কারণ, ভালো থাকাটা আমার ভাগ্যেই নাই।’ সম্প্রতি দায়িত্বরত অবস্থায় বগুড়ার মহাস্থানগড় নিয়ে একটি ভ্লগ তাঁর ব্যক্তিগত ফেসবুক আইডিতে পোস্ট করা হয়েছে।

জানতে চাইলে নাদিয়া ফারজানা বলেন, ‘আমি টিকটকে সক্রিয় নই। আপনারা যেগুলো দেখতে পান, সব কটি ফেক অ্যাকাউন্ট। বিটিআরসির মাধ্যমে ভুয়া অ্যাকাউন্টগুলো বন্ধের চেষ্টা করছি। কিন্তু অনেক বেশি অনুসারী থাকায় সহজে বন্ধ করা সম্ভব হয় না।’ তাঁর ফেসবুক কার্যক্রম সরকারি নির্দেশনার পরিপন্থী কি না—এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘ব্যক্তিগত ফেসবুক আইডিতে প্রতিষ্ঠানসংশ্লিষ্ট কোনো কনটেন্ট শেয়ার করতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতির কথা বলা হয়েছে। এটা তো আমার ব্যক্তিগত।’

অভিযানের ভিডিও টিকটকে
গাজীপুর মহানগর পুলিশের সদর থানার এসআই উৎপল কুমারের নামের টিকটক আইডিতে বিভিন্ন অভিযানের ভিডিও পোস্ট হয়েছে। এসব ভিডিওতে সংযোজিত হয়েছে হিন্দি সিনেমার গান। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অপরাধ দমনের চেয়ে প্রতিকার করার ক্ষেত্রে এ ধরনের কার্যক্রম সহায়ক ভূমিকা রাখে। তাই এসব করি।’

পুলিশ সদস্যদের এভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) নূর মোহাম্মদ বলেন, ‘এগুলো তাঁদের সিনিয়র কর্মকর্তাদের দেখার কথা। একজনের ইচ্ছা হলো আর অমনি একটা কিছু বলে ফেললেন—সেটা হয় না। এ ব্যাপারে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া উচিত। এ ধরনের কোনো কর্মকাণ্ডে কেউ লিপ্ত হলে তাঁর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’