বিষপানে দিনে ১৭৫ জন হাসপাতালে ভর্তি হয় | প্রতীকী ছবি |
শিশির মোড়ল: খুলনা জেলার সুন্দরবন–সংলগ্ন দাকোপ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৬ এপ্রিল দুপুরের পর বিষ খাওয়া একজন রোগী ভর্তি হন। এই রোগীর চিকিৎসায় একটি জরুরি ওষুধ হাসপাতালে ছিল না। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রোগীর আত্মীয়দের ওষুধ জোগাড় করার কথা বলেন।
রোগীর আত্মীয়রা খুলনা শহর থেকে ওষুধটি আনেন সন্ধ্যার পর। সেই ওষুধ দেওয়ার পরও রোগীর অবস্থা খারাপ হতে থাকে। গভীর রাতে ওই রোগীকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। ৮ এপ্রিল ভোরে তিনি মারা যান।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত প্রকাশনা হেলথ বুলেটিন (সর্বশেষ ২০২০) বলছে, সারা দেশে বছরে বিষক্রিয়ায় ৬৪ হাজার মানুষ চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি হন। অর্থাৎ দৈনিক ১৭৫ জন বিষপানে হাসপাতালে আসছেন। বিষক্রিয়ার রোগীর সংখ্যা হাসপাতালে ভর্তি হওয়া মোট রোগীর ২ শতাংশ। মৃত্যুও অনেক বেশি।
খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দাকোপের ওই ব্যক্তির মৃত্যুর কারণ হিসেবে বলেছে, ‘এইচ/ও প্যারাকোয়াট পয়জনিং’। অর্থাৎ ওই ব্যক্তির আগাছানাশক বিষক্রিয়ার ইতিহাস আছে। তাঁর পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আগাছানাশক বাড়িতে ছিল। অসচ্ছল পরিবার। পরিবারে আছে বিধবা মা, স্ত্রী ও দুই শিশুসন্তান।
৬ এপ্রিল দাকোপ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা সুদীপ বালা মুঠোফোনে বলেন, বিষপানের রোগী নিয়মিত হাসপাতালে আসছেন। অনেকে মারাও যাচ্ছেন।
বহু মানুষ বিষের শিকার
২ মে এই প্রতিবেদক গিয়েছিলেন দাকোপ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত প্রায় চার মাসে বিভিন্ন গ্রাম থেকে ৩৪ জন বিষপানের রোগী উপজেলা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এ ছাড়া ভেজাল মদের বিষক্রিয়ায় পাঁচজনের চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। এর অর্থ প্রতি তিন দিনে একজন বিষক্রিয়ার রোগী এই হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসছেন।
আত্মহত্যা, আত্মহত্যার চেষ্টা—এসব নিয়ে যাঁরা গবেষণা করেন, তাঁদের ধারণা, ঝিনাইদহ এলাকায় বিষপানের ঘটনা বেশি ঘটে। এর মধ্যে ঝিনাইদহ জেলার শৈলকুপা উপজেলার নাম সবার আগে আসে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমের (এমআইএস) তথ্য বলছে, এ বছর জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত শৈলকুপা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বিষপানের রোগী ভর্তি হয়েছেন ১৪ জন। কিন্তু একই সময়ে দেখা যাচ্ছে, দাকোপে ভর্তি রোগী বেশি।
শৈলকুপা উপজেলা হাসপাতালে গত বছর ৭৭ জন রোগী ভর্তি হন, সেখানে দাকোপ উপজেলা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১৫৯ জন রোগী।
এমআইএসের পরিসংখ্যান বলছে, ২০২২ সালে দেশের ৪৯৫টি উপজেলা হাসপাতালে ২২ হাজার ১১০ জন বিষক্রিয়ার রোগী ভর্তি হন। ২০২৩ সালে রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ২৪ হাজার ৪৪২ জনে দাঁড়ায়। ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত ভর্তি হয়েছেন ৭ হাজার ৩৬৭ জন। উপজেলা হাসপাতালে সাধারণত গ্রামের রোগী ভর্তি হন। এর বাইরে রয়েছে জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ের হাসপাতাল। সেখানেও বিষক্রিয়ার অনেক রোগী ভর্তি হন।
সরকারি কর্মকর্তা ও বিষক্রিয়ার গবেষকেরা বলেছেন, বিষপানের অনেক রোগীকে হাসপাতালে আনাই হয় না। অনেক রোগীকে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। আবার অনেকে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে চিকিৎসা নেন। তাদের মোট সংখ্যা সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর চেয়ে কয়েক গুণ বেশি।
বিষক্রিয়ায় মৃত্যুর হিসাব ঠিকভাবে রাখা হয় না বলে এমআইএসের কাছে এ বিষয়ে পৃথক পরিসংখ্যান নেই। তবে এমআইএস বলছে, হাসপাতালে মৃত্যু হওয়া রোগীর ৯ শতাংশ জখম ও বিষক্রিয়ার।
তবে আত্মহত্যা নিয়ে গবেষণা ও কাজ করেন, এমন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে প্রতিবছর আত্মহত্যায় ১০ থেকে ১৪ হাজার মানুষ মারা যান। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয় বিষ খেয়ে। এই সংখ্যা সাড়ে পাঁচ হাজার থেকে ছয় হাজার হওয়ার কথা।
কারণ জানা দরকার
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, যাঁদের মধ্যে বিষণ্নতা বেশি, তাঁদের আত্মহত্যার প্রবণতা বিষণ্নতা নেই এমন মানুষের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি। উপকূলীয় এলাকা দাকোপে মানুষের বিষ খাওয়ার সঙ্গে বিষণ্নতার একটি সম্পর্ক হয়তো আছে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ ও বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচের এক যৌথ গবেষণায় দেখা গেছে, উপকূলের প্রায় ২৩ শতাংশ মানুষ মাঝারি থেকে তীব্র বিষণ্নতায় ভুগছেন। বিষণ্নতার এই হার জাতীয় হারের চেয়ে অনেক বেশি। এই গবেষণার ফলাফল ৩০ এপ্রিল রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়।
দাকোপ উপজেলার চালনা এম এম কলেজের অধ্যক্ষ অসীম কুমার থান্দার বলেন, ‘বিষ খাওয়ার বিষয়টি বেদনাদায়ক, একই সঙ্গে উদ্বেগের। এর সঠিক কারণ জানতে সামাজিক গবেষণা দরকার। পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষের মানুষদের আরও দায়িত্বশীল আচরণ করা দরকার।’
বিষ উপেক্ষিত বিষয়
বিষ খাওয়ার ঘটনা বা বিষ খেয়ে আত্মহত্যার ঘটনার তাৎপর্য ও প্রতিক্রিয়া অনেক বেশি। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা বলেন, বিষক্রিয়ায় শরীরের ক্ষতি হয়, স্নায়ু দুর্বল হয়। যার মানসিক সমস্যা নেই, বিষ খাওয়ার পর তা দেখা দিতে পারে। বিষ খাওয়ার পর হঠাৎই চিকিৎসা ব্যয়ের চাপের মধ্যে পড়তে হয়। প্রচলিত আইনে বিষ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা অপরাধ। বিষ খাওয়া মানুষকে সমাজ এড়িয়ে চলে, মানুষ একা হয়ে পড়ে। এটি স্পর্শকাতর বিষয়। বিষ খাওয়ার ঘটনা লুকিয়ে রাখার বা চেপে যাওয়ার একটি প্রবণতা সমাজে আছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির পরিচালক অধ্যাপক মো. রোবেদ আমিন বলেন, ‘বিষক্রিয়ার ঘটনা অনেকটাই উপেক্ষিত বিষয়। এ বিষয়ে মনোযোগের ঘাটতি আছে। সব হাসপাতালে এসব রোগী শয্যায় রাখা হয় না। এদের মেঝেতে বা মাটিতে রাখা হয়। এদের তথ্যও ঠিকমতো লিপিবদ্ধ করা হয় না।’ তিনি আরও বলেন, স্নাতক পর্যায়ের চিকিৎসাশিক্ষার পাঠ্যসূচিতেও বিষক্রিয়ার বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব পায়নি।
মানুষ যেন বিষ না খায় বা কীটনাশক-আগাছানাশক থেকে মানুষ যেন দূরে থাকে—এমন প্রচারের বিষয়ে তেমন কোনো সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ চোখে পড়ে না। তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্র জানিয়েছে, বিষ খেয়ে আসা রোগীর চিকিৎসা দেওয়ার ব্যাপারে তাদের একটি কর্মসূচি আছে। সেই কর্মসূচি থেকে চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও জার্মান সরকারের সহায়তায় বছরখানেক আগে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বিষক্রিয়া তথ্যকেন্দ্র বা পয়জন ইনফরমেশন সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে। গত শুক্রবার ওই কেন্দ্রের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেছেন, কেন্দ্রটির ‘শৈশবকাল’ চলছে, মাত্র কাজ শুরু করেছে।
বিষ খাওয়ার ঘটনাকে ‘অত্যন্ত ভয়াবহ’ বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ও বিষবিদ্যাবিষয়ক নাগরিক সংগঠন টক্সিকোলজি সোসাইটি অব বাংলাদেশের সভাপতি অধ্যাপক এম এ ফয়েজ। তিনি বলেন, ‘অতি ক্ষতিকর কীটনাশক বিশ্বের অনেক দেশই নিষিদ্ধ করেছে। কিন্তু আমাদের দেশে সেগুলোর ব্যবহার চলছে। অচিরেই তা বন্ধ করতে হবে। আবার চিকিৎসা নিতে এসে অনেক আইনের মারপ্যাঁচে পড়ে। সেই কারণে অনেকে চিকিৎসা নেওয়া থেকে বিরত থাকে। মনে রাখতে হবে, বিষক্রিয়া একটি রোগ, অপরাধ নয়।’