শিক্ষা মন্ত্রণালয় | ফাইল ছবি |
মোশতাক আহমেদ: দুই বছর আগে ঝড়ে টিনশেড ভবন ভেঙে যায়। এরপর আর ভবন নির্মাণ করা হয়নি। পটুয়াখালীর বাউফলের উত্তর কেশবপুর বালিকা দাখিল মাদ্রাসাটি এখন কেবল কাগজে আছে, বাস্তবে এর কোনো কাঠামো নেই। ১৯৮৮ সালে মাদ্রাসাটি প্রতিষ্ঠিত। তবে এমপিওভুক্ত নয়। এই মাদ্রাসা থেকে এবার একজন দাখিল পরীক্ষা দিলেও পাস করেনি।
মাদ্রাসার শিক্ষক মোছা. লতুফা বেগম বলেন, মাদ্রাসাটিকে টিকিয়ে রাখার জন্য এ বছর একজনকে দিয়ে পরীক্ষার ফরম পূরণ করিয়েছিলেন।
তবে একই উপজেলার উত্তর দাশপাড়া দাখিল মাদ্রাসাটি এমপিওভুক্ত। কিন্তু এই মাদ্রাসা থেকে ১৪ জন পরীক্ষা দিলেও কেউ পাস করেনি।
শুধু এই দুই মাদ্রাসা নয়, গত রোববার প্রকাশিত এ বছরের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় সারা দেশ থেকে বিদ্যালয় ও মাদ্রাসা মিলিয়ে ৫১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে একজন শিক্ষার্থীও পাস করতে পারেনি। এর মধ্যে ৪২টি মাদ্রাসা, ৯টি বিদ্যালয়।
এ বছরসহ গত কয়েক বছরের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার ফল পর্যালোচনায় দেখা গেছে, প্রতিবছরই বেশ কিছুসংখ্যক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে কেউ পাস করতে পারছে না। শূন্য পাস করা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বেশির ভাগই মাদ্রাসা। এ ছাড়া এ ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগই মফস্সল এলাকার। হাতে গোনা শিক্ষার্থী নিয়ে নামকাওয়াস্তে চলে এসব প্রতিষ্ঠান। সুযোগ-সুবিধাও অপ্রতুল। এগুলোর মধ্যে কিছু প্রতিষ্ঠান ছাড়া বাকিগুলো এমপিওভুক্ত নয়। তবে কিছু এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠান থেকেও শূন্য পাস হচ্ছে।
শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, স্থানীয় বাসিন্দা ও অভিভাবকদের মূল্যায়ন হলো এসব প্রতিষ্ঠানে ঠিকমতো পড়াশোনা হয় না। তাই এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখার প্রয়োজন আছে কি না, ভাবতে হবে।
অবশ্য শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির বিপক্ষে। গত রোববার ফল প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, কোনো প্রতিষ্ঠানে যদি শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে যায়, সে ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য আরও বেশি সহযোগিতা করতে হবে। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো যদি কাম্য শিক্ষার্থী সংখ্যা ধরে রাখতে না পারে, তবে সরকারি সুযোগ-সুবিধা অব্যাহত রাখা যাবে না।
নামেই বিদ্যালয়
এবার যে নয়টি বিদ্যালয় থেকে এবার একজনও পাস করতে পারেনি, তার মধ্যে তিনটি ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের অধীন। এগুলোর সবগুলোই মফস্সলের। এর মধ্যে সোমজানি উচ্চবিদ্যালয়টি টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলায় অবস্থিত। এখান থেকে তিনজন পরীক্ষা দিয়ে সবাই ফেল করেছে। ৩০ বছর আগে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা হলেও দীর্ঘদিনেও এমপিওভুক্ত না হওয়ায় শিক্ষকেরা বিদ্যালয়ে আসেন না।
গতকাল সোমবার বেলা দুইটার দিকে বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, বিদ্যালয়ের টিনের ঘরে তালা। ছাত্র–শিক্ষক কেউ নেই। ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আবদুর রাজ্জাক মুঠোফোনে বলেন, বিনা বেতনে শিক্ষকেরা থাকতে চান না।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, বিদ্যালয়ে নিয়মিত ক্লাস হয় না। দু-চারজন শিক্ষার্থী এলেও শিক্ষকেরা আসেন না। স্থানীয় কয়েকজন যুবককে পাঠদানের জন্য নেওয়া হয়েছে।
এ রকম আরেকটি বিদ্যালয় বেগম রূপবান উচ্চবিদ্যালয়। এটি মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলায় অবস্থিত। এখান থেকে ১০ জন পরীক্ষা দিয়ে সবাই ফেল করেছে। কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলায় অবস্থিত চরতেরোটেকিয়া মৌজা বালিকা উচ্চবিদ্যালয় থেকে ৯ জন পরীক্ষা দিয়েছিল।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার বলেন, শূন্য পাস করা প্রতিষ্ঠানগুলোকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হবে। জবাব সন্তোষজনক না হলে পাঠদানের অনুমতি বাতিল করা হবে।
শূন্য পাস দুটি বিদ্যালয় রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের অধীন। এগুলো রাজশাহীর মোহনপুর ও নওগাঁর আত্রাইয়ে অবস্থিত। আর দিনাজপুর বোর্ডের অধীন চারটি শূন্য পাস প্রতিষ্ঠান গাইবান্ধা, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম ও দিনাজপুরে অবস্থিত।
শূন্য পাস মাদ্রাসা বেশি
যে ৪২টি মাদ্রাসা থেকে কেউ পাস করেনি, সেগুলোর সব কটিই ঢাকার বাইরে অবস্থিত। যেমন ১৯৯৭ সালে প্রতিষ্ঠিত রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার বীরকয়া দাখিল মাদ্রাসা থেকে পরীক্ষা দিয়েছিল মাত্র একজন। গতকাল সরেজমিনে দেখা যায়, মাদ্রাসাটির পাকা ভবনের কিছু অংশে টিনের চালা; আর কিছু অংশ ফাঁকা। মাঠে আবর্জনা। শ্রেণিকক্ষে ভাঙা কয়েকটি বেঞ্চ। মূলত প্রতিষ্ঠানটির অস্তিত্ব ধরে রাখা এবং সম্পদ রক্ষার জন্য কাগজে–কলমে টিকিয়ে রাখা হয়েছে।
২০০০ সালে শিক্ষা বোর্ড থেকে মাদ্রাসাটি পাঠদানের অনুমতি পায়। তবে একপর্যায়ে এমপিওভুক্ত না হওয়ায় শিক্ষক-কর্মচারীরা অন্যত্র চলে যান। ওই এলাকার বীরকয়া নিম্নমাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রফাতুল্যা বলেন, তিনি প্রতিষ্ঠানটির নাম ও অস্তিত্ব ধরে রেখেছেন। কিছু গরিব শিক্ষার্থীর যাবতীয় খরচ বহন করে পরীক্ষা দেওয়ানো হয়। প্রতিষ্ঠানের কিছু সম্পদ রয়েছে। প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেলে সব বেহাত হবে।
ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার চারটি মাদ্রাসা থেকে কেউ পাস করেনি। এগুলোর পরীক্ষার্থী ছিল ৮ থেকে ১৮ জনের মধ্যে।
৫০ শতাংশের ওপরে পাসের হার বেশি
ফলাফলের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ১০৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাসের হার ১০ শতাংশের মধ্যে। ১৪৩টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ১০ শতাংশের ওপর থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত এবং ২০ শতাংশের ওপর থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত পাস শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ১ হাজার ৭৯৫টি। ৫০ শতাংশের ওপর থেকে ১০০ শতাংশের নিচে পাস করা প্রতিষ্ঠান ২৪ হাজার ৮০৪টি। আর ২ হাজার ৯৬৮টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে সবাই পাস করেছে।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক মু. জিয়াউল হক বলেন, যে প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে কেউ পাস করে না, সেগুলোর শিক্ষার্থী ও পরীক্ষার্থী খুবই কম। এর কারণ হলো এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে সুযোগ-সুবিধা, শিক্ষকস্বল্পতাসহ বিভিন্ন সমস্যা আছে। তাই কয়েক বছরের ফলাফল পর্যালোচনা করে যদি দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানগুলো ধারাবাহিকভাবে খারাপ করছে, তাহলে সেগুলো বন্ধ করে দেওয়াই ভালো হবে বলে মনে করেন তিনি।