রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চল: ট্রেনের সূচি বিপর্যয় চরমে কাটতে লাগবে এক বছর

নিজস্ব প্রতিবেদক: এমনিতেই ট্রেনের গতি কম। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে একের পর এক দুর্ঘটনা। সিগন্যালিং সমস্যা তো আছেই। এদিকে যমুনা নদীর ওপর বঙ্গবন্ধু রেল সেতুর নির্মাণকাজ চলছে। এ জন্য ট্রেন চলাচলে মাত্র দুটি লাইন সচল রয়েছে। জয়দেবপুরেও নতুন লাইন নির্মাণ চলছে। এতে ট্রেন বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকছে। সব মিলিয়ে রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চলে সময়সূচি (শিডিউল) বিপর্যয় চরম আকার ধারণ করেছে। এতে ভোগান্তিতে পড়ছেন যাত্রীরা। রাজস্ব ক্ষতি হচ্ছে রেলের।

কবে নাগাদ রেল এই সূচি বিপর্যয় কাটিয়ে উঠবে, তারও স্পষ্ট জবাব নেই কারও কাছে। তবে রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক অসীম তালুকদার বলেন, ‘এক বছর লেগে যাবে। যত দিন (অটোমেটিক) সিগন্যাল ঠিক হবে না, ম্যানুয়ালি চলবে, তত দিনে সমাধান হবে না।’ তিনি বলেন, সূচি বিপর্যয় দুর্ঘটনার জন্য হয়েছে তো বটেই। এ ছাড়া পশ্চিমাঞ্চলের ট্রেন দূরপাল্লায় যায়, সেখানে অনেক স্টেশন বন্ধ। এসব কারণে ট্রেন ক্রসিংয়ে আধা ঘণ্টারও বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয়।

বগুড়ার সান্তাহার জংশন স্টেশনে ২ মে যাত্রীদের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। পরদিন জয়দেবপুরে মালবাহী ট্রেনের সঙ্গে যাত্রীবাহী ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। দুর্ঘটনাকবলিত ট্রেন দুটি উদ্ধারে লেগে যায় ৩২ ঘণ্টা। এরপর গত আট দিন ধরেই সূচি জটিলতায় পড়েছে ট্রেনগুলো। কোনো ট্রেন ছাড়ছে আধা ঘণ্টা দেরিতে, আবার কোনো ট্রেন ছাড়তে লেগে যাচ্ছে ৮ ঘণ্টা। এর মধ্যেই গতকাল বৃহস্পতিবার রাত ৩টার দিকে পাবনার ঈশ্বরদীর মুলাডুলিতে বুড়িমারী এক্সপ্রেস ট্রেন দুর্ঘটনায় পড়ে। এতে উত্তরবঙ্গের সঙ্গে ঢাকার রেল যোগাযোগ পাঁচ ঘণ্টা ব্যাহত হয়।

গতকাল কমলাপুর স্টেশনে গিয়ে দেখা যায়, সন্তান ও স্বজন নিয়ে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষায় যাত্রীরা। কেউ কেউ ট্রেন না পেয়ে টিকিট ফেরত দিচ্ছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত কয়েক দিনে টিকিট রিফান্ডের (টিকিট ফেরত) পরিমাণ বেড়ে গেছে। সূচি জটিলতার কারণে ৪ মে রাজশাহীগামী সিল্কসিটি এক্সপ্রেস

ট্রেনের যাত্রা বাতিল করতে চেয়েছিল রেল। ১ হাজার টিকিটের মধ্যে ৪০০ থেকে ৫০০টি রিফান্ডও করা হয়েছিল।

ঢাকা বিভাগীয় রেলওয়ের বাণিজ্যিক কর্মকর্তা শাহ আলম বলেন, সাধারণত দুই ঘণ্টার বেশি হলেই যাত্রীরা টিকিট ফেরত দিতে চান। গত কয়েক দিন ট্রেনের সূচি বিপর্যয়ের কারণে এটা হচ্ছে। তারপরও এটা এখন পর্যন্ত অনেক বেশি বলা যাবে না।

রেলসূত্র বলেছে, ঢাকা থেকে প্রতিদিন পশ্চিমাঞ্চলে ২৩টি ট্রেন চলে। এর মধ্যে ১৯টি আন্তনগর, ৩টি কমিউটার ও ১টি মেইল ট্রেন। ঢাকা-জয়দেবপুর হয়ে বঙ্গবন্ধু বহুমুখী সেতুর ওপর দিয়ে যায় ১৯টি ট্রেন। এসব ট্রেনের সব কটিই আধা ঘণ্টা থেকে সর্বোচ্চ আট ঘণ্টা দেরিতে চলছে। পশ্চিমাঞ্চলের বাকি চারটি ট্রেন ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে যায়। এগুলো হলো বেনাপোল এক্সপ্রেস, মধুমতী এক্সপ্রেস, সুন্দরবন এক্সপ্রেস ও নকশীকাঁথা এক্সপ্রেস।

কমলাপুর স্টেশন সূত্র বলছে, এপ্রিলে তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে ট্রেন ধীরে চালানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়। তখন ৮০ কিলোমিটার গতির ট্রেন ৪০ কিলোমিটার গতিতে চলেছে। সূচি বিপর্যয় চরমে পৌঁছার সূচনা সেখানেই। কোনো ট্রেনই নির্ধারিত সময়ে ছাড়তে পারছিল না, গন্তব্যে পৌঁছাতে পারছিল না। এখন গরম না থাকলেও একের পর এক ট্রেন দুর্ঘটনার কারণে সূচি বিপর্যয় আরও প্রকট হচ্ছে। পশ্চিমাঞ্চলের ট্রেনগুলোর মধ্যে রাজশাহী, দিনাজপুর, রংপুরগামী প্রতিটি ট্রেনই দুই ঘণ্টা থেকে তিন ঘণ্টা পর্যন্ত বিলম্বে চলছে। গতকাল সকালে নীলসাগর ও একতা এক্সপ্রেস এবং রাজশাহী কমিউটার নির্ধারিত সময়ের তিন-চার ঘণ্টা বিলম্বে কমলাপুর স্টেশন ছেড়েছে। দিনের বাকি ট্রেনগুলোরও একই অবস্থা হয়েছে।

এ বিষয়ে ঢাকা রেলওয়ে স্টেশনমাস্টার আনোয়ার হোসেন বলেন, ট্রেনগুলো স্টেশনে আসতে দেরি হওয়ায় ছাড়তেও দেরি হচ্ছে।

এদিকে যমুনা নদীর ওপর ট্রেন চলাচলে যে দুই লাইন সচল রয়েছে, সেখানে কম্পিউটারাইজড ইন্টারলিংক সিস্টেম (সিবিআইএস) নেই। জয়দেবপুরেও নেই সিবিআইএস। আবার প্রকল্প চলমান থাকায় অনেক জায়গায় সিবিআইএস চালু করা যাচ্ছে না। এ বিষয়ে পশ্চিমাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক অসীম তালুকদার বলেন, দুটি লাইন দিয়ে কষ্ট করে ট্রেন চালাতে হচ্ছে। ইন্টারলকিং নেই, একটা গাড়ি নিলে আরেকটি নেওয়া যায় না। আগে লাগত ২০ মিনিট, এখন লাগছে ৪০ মিনিট।

এদিকে যাত্রীরা বলছেন, যেসব ট্রেন বিলম্বিত হচ্ছে, সেগুলোর কোনো তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। স্টেশনে থাকা বোর্ডে বিলম্ব লেখা ওঠে। কিন্তু ট্রেন কোথায় আছে বা কখন আসবে, সেটা কেউ জানে না। এর আগে এ বিষয়ে কমলাপুর রেলস্টেশনের ম্যানেজার মাসুদ সারওয়ার বলেছিলেন, ট্রেনের সূচিতে পরিবর্তন এলে তা গ্রাহকদের জানিয়ে দিতে হবে বলে সহজ ডটকমকে নির্দেশনা দেওয়া আছে।

তবে এ বিষয়ে জানতে সহজের প্রধান নির্বাহী সন্দীপ দেবনাথকে ফোন করা হলে তিনি সাড়া দেননি।