উইলসন্স রোগের জিন বিশ্লেষণ করে গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। বিসএমএমইউ, ঢাকা, ১৪ মে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

বিশেষ প্রতিনিধি: উইলসন্স রোগের জিন বিশ্লেষণ করতে এ গবেষণাদেশে উইলসন্স রোগের সম্পূর্ণ নতুন জিনগত পরিবর্তন শনাক্ত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) চিকিৎসা নিতে আসা উইলসন্স রোগীর জিন বিশ্লেষণ করে গবেষকেরা নতুন এই পরিবর্তন শনাক্ত করেন। গবেষকেরা বলছেন, এই গবেষণার ফলাফল দেশের উইলসন্স রোগীদের চিকিৎসায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

বিএসএমএমইউর নিউরোলজি ও জেনেটিকস অ্যান্ড মলিকিউলার বায়োলজি বিভাগের গবেষক ও চিকিৎসকেরা উইলসন্স রোগের জিন বিশ্লেষণ করতে এ গবেষণা করেছেন। ‘জেনেটিক মিউটেশন অ্যান্ড নিউরোলজিক্যাল ম্যানিফেস্টেশন অব বাংলাদেশি উইলসন্স ডিজিজ পেশেন্টস’ শীর্ষক এই গবেষণার ফলাফল প্রকাশের জন্য আজ মঙ্গলবার বিশ্ববিদ্যালয়ের মিল্টন হলে সেমিনারের আয়োজন করা হয়। সেখানে বলা হয়, নতুন জিনগত যে দুটি পরিবর্তন তাঁরা শনাক্ত করেছেন, তা বিশ্বে আর কোথাও দেখা যায়নি।

সেমিনারে চিকিৎসকেরা বলেন, উইলসন্স রোগের কারণ ত্রুটিযুক্ত জিন। সন্তান এই ত্রুটিযুক্ত জিন পায় বাবা ও মায়ের কাছ থেকে। ত্রুটিযুক্ত জিনের কারণে মানুষের মস্তিষ্ক, যকৃত, চোখসহ বেশ কিছু অঙ্গে মাত্রাতিরিক্ত তামা জমা হয়। উইলসন্স রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁটাচলা কিছুটা ভারসাম্যহীন, হাত কাঁপে, কথা বলতে অসুবিধা হয়, ঢোক গিলতে সমস্যা হয়, আচরণগত কিছু জড়তা থাকে। প্রতি ৩০ হাজারের মধ্যে ১ জন উইলসন্স রোগী দেখতে পাওয়া যায়। এটি একটি বিরল রোগ।

অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ও বিএসএমএমইউর উপাচার্য অধ্যাপক দীন মোহাম্মদ নুরুল হক বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা হয়। জিনগত পরিবর্তন শনাক্ত করা তারই উদাহরণ। তিনি আরও বলেন, উইলসন্স রোগের ঝুঁকি বাড়ায় নিকটাত্মীয়ের মধ্যে বিয়ে। ঝুঁকি কমাতে খালাতো-ফুফাতো ভাই–বোনের মধ্যে যেন বিয়ে না হয়, সে ব্যাপারে সচেতন হতে হবে।

কাদের নিয়ে গবেষণা
বিশ্ববিদ্যালয়ে এ পর্যন্ত ২০০ উইলসন্স রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২২ সালের আগস্ট পর্যন্ত চিকিৎসা নেওয়া ৫০ রোগীর ওপর এ গবেষণা হয়েছে।

রোগের উপসর্গ ও চিকিৎসা বিষয়ে বক্তব্য উপস্থাপন করেন বিএসএমএমইউর স্নায়ুরোগ বিভাগের অধ্যাপক আহসান হাবিব হেলাল। তিনি বলেন, ২৫ জনকে এই রোগের কারণে স্কুল ছাড়তে হয়েছিল; ২১ জনের হাত-পা শক্ত হওয়া, ২৮ জনের হাত-পা কাঁপা ও ১৪ জনের অনিয়ন্ত্রিত ঘাড় মোচড়ানোর সমস্যা ছিল। এ ছাড়া ১১ জনের ছিল অনিয়ন্ত্রিত হাত-পা মোচড়ানোর সমস্যা।

৫০ জন রোগী ত্রুটিযুক্ত জিনের কারণেই উইলসন্স রোগে ভুগছেন। তাঁদের রক্তের নমুনা থেকে প্রথমে ডিএনএ সংগ্রহ করা হয়, তারপর উইলসন্স রোগের জন্য দায়ী নির্দিষ্ট জিন (এটিপি৭বি) বিশ্লেষণ করা হয়। এসব রোগীর জিন বিশ্লেষণের ফলাফল উপস্থাপন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিকস অ্যান্ড মলিকিউলার বায়োলজি বিভাগের অধ্যাপক লায়লা আনজুমান বানু।

লায়লা আনজুমান বানু বলেন, তিনটি ক্ষেত্রে জিনের রূপান্তর দেখা গেছে। এর মধ্যে দুই রূপান্তর এই প্রথম শনাক্ত হলো। আর একটি রূপান্তর আগেই বিশ্বের অন্য কোথাও শনাক্ত হয়েছিল।

এ গবেষণায় কী লাভ
অনুষ্ঠান শেষে অধ্যাপক লায়লা আনজুমান বানু প্রথম আলোকে বলেন, এই অভিজ্ঞতা থেকে অল্প ব্যয়ে উইলসন্স রোগ শনাক্তের উদ্যোগ নেওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। বেশি মানুষের রোগ পরীক্ষার সুযোগ তৈরি হলে রোগ প্রতিরোধও সহজতর হবে।

চিকিৎসকেরা বলেছেন, কোনো শিশু স্কুলে ভালো করছিল, হঠাৎ যদি সে খারাপ করতে শুরু করে এবং পাশাপাশি যদি তার হাত-পা কাঁপার সমস্যা চোখে পড়ে, তবে প্রাথমিকভাবে ধরে নিতে হবে, উইলসন্স রোগে আক্রান্ত। ওই শিশুকে অবশ্যই চিকিৎসকের কাছে নিতে হবে।

সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে চিকিৎসকেরা বলেন, উইলসন্স রোগ চিকিৎসা আছে। একজন রোগীকে মাসে প্রায় দেড় হাজার টাকার ওষুধ খেতে হয়। নিয়মিত ওষুধে এই রোগ নিয়ন্ত্রণে থাকে। তবে জিনের রূপান্তর শনাক্ত করে যদি সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা দেওয়া যায়, তাহলে রোগের উপসর্গ অনেক কমে আসে।

অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক মোহাম্মদ আতিকুর রহমান, সহ-উপাচার্য (গবেষণা) অধ্যাপক মনিরুজ্জামন খান, স্নায়ুরোগ বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবু নাসার রিজভী বক্তব্য দেন।