নওগাঁয় কৃষক-আড়তদারদের ৩৫ কোটি টাকা পরিশোধ না করে লাপাত্তা ব্যবসায়ী, মানববন্ধন

পাওনা টাকা উদ্ধার ও জড়িত ব্যবসায়ীর শাস্তির দাবিতে ব্যবসায়ী ও কৃষকদের মানববন্ধন। রোববার দুপুরে নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলা সদরের শিবগঞ্জ মোড়ে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

প্রতিনিধি নওগাঁ: নওগাঁর মহাদেবপুরে ব্যবসায়ী ও কৃষকদের কাছ থেকে বাকিতে ধান কিনে প্রায় ৩৫ কোটি টাকা পরিশোধ না করে এক ব্যবসায়ী পালিয়ে গেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনায় পাওনা টাকা উদ্ধার ও অভিযুক্ত ব্যবসায়ীর শাস্তির দাবিতে মানববন্ধন করেছেন ভুক্তভোগী ব্যবসায়ী ও কৃষকেরা।

আজ রোববার দুপুরে উপজেলা সদরের শিবগঞ্জ মোড়ে ‘ভুক্তভোগী সকল পাওনাদার’ ব্যানারে এ মানববন্ধন করেন স্থানীয় দুই শতাধিক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও কৃষক। অভিযুক্ত ব্যবসায়ীর নাম ওসমান গণি। তিনি ওসমান অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডর পরিচালক। তিনি পাওনার বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, বর্তমানে তিনি টাকা পরিশোধ করতে অক্ষম। এরই মধ্যে দেউলিয়া হওয়ার আবেদন করেছেন। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বিক্রি করে তিনি দ্রুত সবার পাওনা পরিশোধ করে দেবেন।

মানববন্ধনে ভুক্তভোগী ব্যবসায়ী ও কৃষকেরা জানান, মহাদেবপুর উপজেলা সদর ইউনিয়নের আখেরা এলাকায় ওসমান অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠানে দুটি অটো রাইস মিল আছে। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক ওসমান গণি। দুই যুগ ধরে তিনি চালকল ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। নওগাঁ, জয়পুরহাট ও দিনাজপুরের বিভিন্ন আড়তদার ও কৃষকদের কাছ থেকে ধান কিনে চাল উৎপাদন করে দেশের বিভিন্ন বাজারে বাজারজাত করতেন। গত দেড়-দুই বছর ধরে ওসমান গণি, তাঁর ছেলে রুহুল আমিন ও চালকলের ব্যবস্থাপক বকুল হোসেন প্রতিষ্ঠানের নামে স্থানীয় আড়তদার ও কৃষকদের কাছ থেকে বাকিতে প্রচুর ধান কেনেন। বেশি লাভ দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে তাঁরা ধান কেনেন। পরে বাকির টাকা চাইতে গেলে ওসমান ও তাঁর কর্মচারীরা গড়িমসি করতে থাকেন। একপর্যায়ে পাওনা পরিশোধ না করে তাঁরা আত্মগোপন করেন। পাওনা আদায়ে ভুক্তভোগীরা ওসমান অ্যাগ্রোর কার্যালয়, থানা ও প্রশাসনের কাছে ধরনা দিয়েও কিছুই করতে পারছেন না।

বেলাল হোসেন নামের এক আড়তদার বলেন, মেসার্স বেলাল ট্রেডার্স নামে মহাদেবপুরের কুঞ্জবন এলাকায় তাঁর একটি ধানের আড়ত আছে। ১০ বছর ধরে ওসমান গণির সঙ্গে তাঁর ব্যবসায়িক সম্পর্ক। তাঁর কাছে তিন বছরের ২ কোটি ৮৫ লাখ বাকি পড়ে গেছে। বাকির টাকা পরিশোধে চাপ দিলে নানা টালবাহানা শুরু করেন। এখন তো প্রতিষ্ঠানেই তালা। ওসমান ও তাঁর ব্যবস্থাপককেও পাওয়া যায় না। তিনি যেসব কৃষকের কাছ থেকে বাকিতে ধান কিনেছিলেন, তাঁরা পাওনা টাকার জন্য চাপ দিচ্ছেন। ব্যাংকের ঋণও পরিশোধ করতে পারছেন না।

মহাদেবপুরের বাদ কুজাইল গ্রাম থেকে মানববন্ধনে এসেছিলেন আখতারুন বানু (৬০) নামের এক গৃহিণী। তিনি বলেন, তাঁর স্বামী মঈন উদ্দিনের ধানের আড়তের ব্যবসা ছিল। ওসমান গণির সঙ্গে ব্যবসা করতেন। ওসমান গণির কাছে ১৬ লাখ টাকা পাবেন তাঁর স্বামী। এক বছর ধরে ঘুরলেও পাওনা টাকা পাননি। টাকার চিন্তায় তাঁর স্বামী দুই মাস আগে স্ট্রোক করেছেন। এখনো তিনি গুরুতর অসুস্থ।

ধানের আড়তদার ছামিউল আলম বলেন, ‘ওসমান গণি আমাদের টাকা পরিশোধে অপারগ জানিয়ে নিজের প্রতিষ্ঠানকে দেউলিয়া ঘোষণার আবেদন করেছেন। অথচ এলাকায় তাঁর প্রায় ৩০০ বিঘা কৃষি ও অকৃষিজমি আছে। ঢাকায় ১০টি বাড়ি আছে। তিনি ও তাঁর পরিবার আয়েশি জীবন যাপন করছেন ঠিকই। কিন্তু আমরা পথে বসার উপক্রম হয়েছি। আসলে ওসমান গণি, তাঁর ছেলে ও প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারী সবাই প্রতারক।’

টাকা উদ্ধারের জন্য সম্প্রতি উপজেলার আখেড়া এলাকায় ওসমান গণির চালকল কারখানায় যান ব্যবসায়ী ও কৃষকেরা। সেখানে গিয়ে জানতে পারেন ওসমান তাঁর দুটি চালকল নাবিল গ্রুপ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন। সম্প্রতি ওসমান গণি তাঁর প্রতিষ্ঠান ওসমান অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ (প্রা.) লিমিটেডকে দেউলিয়া ঘোষণার জন্য ঢাকার দেউলিয়াবিষয়ক আদালতে আবেদন করেন। বিভিন্ন ব্যাংক ও ব্যবসায়ীর কাছ থেকে নেওয়া ২৫২ কোটি টাকার ঋণ পরিশোধে অপারগ জানিয়ে তিনি ওই আবেদন করেন।

অভিযোগের বিষয়ে ওসমান গণি বলেন, বিভিন্ন ব্যাংক ও ব্যবসায়ী তাঁর কাছে টাকা পাবেন, তিনি অস্বীকার করছেন না। কিন্তু এই মুহূর্তে তিনি টাকা পরিশোধ করতে অক্ষম। এ জন্য ঢাকার দেউলিয়া আদালতে প্রতিষ্ঠানকে দেউলিয়া ঘোষণার আবেদন করেছেন। প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া ঘোষিত হলে প্রতিষ্ঠানের নামে থাকা সব স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের মালিক হবেন পাওনাদারেরা। এ ছাড়া তাঁর দুটি চালকল বিক্রির প্রক্রিয়া চলছে। বিক্রি হলে সেখান থেকে কিছু টাকা পাবেন। সেই টাকা দিয়ে কিছু পাওনাদারের টাকা পরিশোধ করে দেবেন।

মহাদেবপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রুহুল আমিন বলেন, ওসমান অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজের কাছে বেশ কিছু লোক টাকা পাবেন উল্লেখ করে পাওনা পরিশোধের জন্য থানা, ইউএনও ও জেলা প্রশাসকসহ বিভিন্ন দপ্তরে স্মারকলিপি দিয়েছেন। তবে এ বিষয়ে থানায় কোনো মামলা হয়নি। এরপরও বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। এ বিষয়ে ওই প্রতিষ্ঠানের মালিকের সঙ্গে কথা হয়েছে। তিনি পাওনাদারদের টাকা পরিশোধের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।