প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে আঞ্চলিক সড়ক দিয়ে দেদার চলছে মাটিবাহী ট্রাক্টর। গত বুধবার বাগমারার ভবানীগঞ্জ কলেজ সড়কে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

প্রতিনিধি বাগমারা: নিষিদ্ধ করে দুই দফায় গণবিজ্ঞপ্তি জারির পরও রাজশাহীর বাগমারা উপজেলায় দেদার মাটিবাহী ট্রাক্টর চলছে। এতে পাকা সড়কে মাটি পড়ে ক্ষতির মুখে পড়েছে পৌনে ৯ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত চারটি আঞ্চলিক সড়ক। হুমকিতে আছে আরও ২০০ কোটি টাকার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সড়ক। সড়কের যত্রতত্র মাটি পড়ে থাকায় চলাচল করতে গিয়ে দুর্ভোগে পড়ছেন হাজারো মানুষ।

মাটিবাহী ট্রাক্টর চলাচল বন্ধে গত বছরের ২৭ এপ্রিল প্রথমে তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এ এফ এম আবু সুফিয়ান ও চলতি বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি ইউএনও উজ্জ্বল হোসেন গণবিজ্ঞপ্তি জারি করেন। তখন উপজেলাজুড়ে মাইকিংও করা হয়। এরপর কয়েক দিন সড়কে ট্রাক্টর চলাচল বন্ধ থাকলেও ইউএনওদের বদলির পর আবার শুরু হয়েছে।

বর্তমান ইউএনও মাহবুবুল ইসলাম বলেন, সড়কগুলোয় মাটিবাহী ট্রাক্টর চলাচল বন্ধে অভিযান চলছে। শিগগিরই আবার মাইকিং করা হবে। মাটি বহন ও পুকুর খনন কোনোভাবেই বরদাশত করা হবে না।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, চার-পাঁচ বছর ধরে বিভিন্ন এলাকায় দেদার পুকুর খনন করা হচ্ছে। খননের মাটি বিভিন্ন ইটভাটা, ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করা হয়। প্রতিদিন ৩০-৪০টি ট্রাক্টরে মাটি পরিবহন করা হয়। এসব মাটিবাহী ট্রাক্টর উপজেলার বিভিন্ন সড়ক দিয়ে চলাচল করে। তখন ট্রাক্টর থেকে মাটি সড়কে ছিটকে পড়ে। পরে পানি কিংবা বৃষ্টি হলে সড়কে পড়ে থাকা মাটি ভিজে গোটা সড়কে কাদা ছড়িয়ে যায়। এতে একদিকে সড়ক পিচ্ছিল হয়ে দুর্ঘটনা ঘটে। অন্যদিকে কাদামাটিতে বিটুমিন ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে সড়ক নষ্ট হয়।

স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) সূত্র জানায়, বাগমারায় মোট ৬০৯ কিলোমিটারের মোট ৪৫টি সড়ক আছে। এর মধ্যে এলজিইডির ৪৩টি এবং সড়ক ও জনপথ বিভাগের (সওজ) দুটি। এসব সড়ক নির্মাণে অন্তত ২০০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। এলজিইডির রাজশাহী কার্যালয়ের জ্যেষ্ঠ সহকারী প্রকৌশলী শাহ নেওয়াজ বলেন, ট্রাক্টর থেকে মাটি সড়কে পড়লে ক্ষতি হয়। মাটি ভিজে থাকলে বা কোনোভাবে পানি জমলে বিটুমিন নষ্ট হয়। মাটি পড়া সড়কে সামান্য বৃষ্টি হলে সড়কগুলো নষ্ট হয়ে যায়।

২৮ এপ্রিল সরেজমিনে উপজেলার যোগীপাড়া, গণিপুর, আউচপাড়া ঝিকড়া, মাড়িয়া এলাকায় মাটিবাহী ট্রাক্টর চলাচল করতে দেখা গেছে। এর মধ্যে ভাতঘরপাড়া-আহসানগঞ্জ, তেলিপুকুর-গাঙ্গোপাড়া, গোপালপুর-আচিনঘাট, বটতলা-নারায়ণপাড়া, চকমহব্বতপুর-মাধাইমুড়ি, ঝাড়গ্রাম সড়কের অবস্থা বেহাল। তেলিপুকুর থেকে চানপাড়া পর্যন্ত তিন কিলোমিটার সড়কের বিভিন্ন স্থানে মাটির স্তূপ পড়ে থাকতে দেখা গেছে। কোথাও কোথাও মাটির কারণে সড়কের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া মুশকিল।

এলজিইডির উপজেলা প্রকৌশলী খলিলুর রহমান বলেন, অতিরিক্ত ওজনের মাটিবাহী ট্রাক্টর চলাচল করায় ইতিমধ্যে উপজেলার পাঁচটি সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে ভাতঘরপাড়া-আহসানগঞ্জ সড়কটি ৮৫ লাখ, তেলিপুকুর-গাঙ্গোপাড়া সড়ক ৮৫ লাখ, বটতলা-নারায়ণপাড়া সড়ক ১ কোটি ৩ লাখ, চক মহব্বতপুর-মাধাইমুড়ি সড়ক ৩ কোটি, গোপালপুর-আচিনঘাট সড়ক নির্মাণে ৩ কোটি ৪ লাখ টাকা ব্যয় হয়। এসব সড়কের বিভিন্ন স্থানে মাটি পড়ে শুকনা মৌসুমে ধুলাবালি জমছে। আর বৃষ্টির পানিতে কাদামাটিতে বিটুমিন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

এলাকাবাসী জানান, তেলিপুকুর এলাকার স্কুলশিক্ষক আক্কাছ একটি পুকুর থেকে মাটি বিক্রি করছেন। ফজলুর রহমান ও নজরুল ইসলাম নামের দুজন কৃষিজমিতে পুকুর খনন করছেন। এ ছাড়া ঝাড়গ্রাম, যোগীপাড়া, গোবিন্দপাড়া এলাকার কয়েকটি পুকুর সংস্কারের কাজ চলছে। ওই সব পুকুরের মালিকেরা মাটি ব্যবসায়ীদের কাছে ওই মাটি বিক্রি করছেন। ওই মাটি দিনরাত পরিবহন করেন ট্রাক্টরচালকেরা।

বাগমারা গ্রামের হেলাল উদ্দিন, আবুল হোসেনসহ কয়েকজন বলেন, রাতে ট্রাক্টরের শব্দে ঘুম আসে না। বিকট শব্দ ও হর্ন বাজিয়ে ট্রাক্টরগুলো চলাচল করে। হামিরকুৎসা ও মাড়িয়া এলাকার কয়েকজন জানান, দেড় মাস ধরে তেলিপুকুর-গাঙ্গোপাড়া সড়ক দিয়ে তাঁরা চলাচল করতে পারছেন না। ধুলায় সব অন্ধকার হয়ে আসে। সামান্য বৃষ্টি হলে সড়ক চলাচলের অনুপযোগী হয়ে যায়। প্রতিদিন ছয় থেকে সাত হাজার লোক ওই পথ দিয়ে চলাচল করেন। 

মাটিবাহী ট্রাক্টরচালকদের ভাষ্য, মাটি ব্যবসায়ীরা মূলত পুকুর থেকে মাটি কেনেন। তাঁরা শুধু পরিবহনের কাজ করে ভাড়া নেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে অন্তত চারজন চালক বলেন, তাঁরা শুধু মাটি বহন করতে ভাড়ায় গাড়ি চালান। পুকুরপাড় থেকে ব্যবসায়ীরা মাটি কিনে বিক্রি করেন। এর দায়দায়িত্ব মাটি ব্যবসায়ীদের বলে তিনি জানান।

অভিযোগের বিষয়ে মাটি ব্যবসায়ীদের কেউ কথা বলতে রাজি হননি। বাড়িগ্রামের আফাজ উদ্দিন পুকুরের মাটি বিক্রির কথা স্বীকার করে বলেন, ‘খুব কম দামে আগে পুকুরের মাটি বিক্রি করেছি। তবে এখন বন্ধ রেখেছি।’

স্কুলশিক্ষক ইকবাল হোসেন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ইউএনও বদলির সঙ্গে সঙ্গে গণবিজ্ঞপ্তির কার্যকারিতা থাকছে না। বিজ্ঞপ্তি জারির এক বছরের মধ্যে দুজন ইউএনও বদলি হলো। তাঁদের বদলির পর আবার ট্রাক্টর চলাচল শুরু হয়েছে। এই ভোগান্তি থেকে কবে রক্ষা পাবেন, প্রশ্ন রাখেন তিনি।