নেপালি নাগরিক বীর বাহাদুর রায়কে টুপি ও উত্তরীয় পরিয়ে বরণ করে নেন স্বজনেরা। বৃহস্পতিবার বিকেলে পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধা ও ভারতের ফুলবাড়ী সীমান্তের শুন্যরেখায় | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
প্রতিনিধি পঞ্চগড়: ৪০ বছর আগে ভারতের সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে এসেছিলেন নেপালের নাগরিক বীর বাহাদুর রায়। এপর বিভিন্ন এলাকায় হোটেল-রেস্তোঁরায় কাজ করেছেন। একপর্যায়ে বগুড়ার দুপচাঁচিয়া পৌর এলাকায় একটি চাতালে কাজ নেন। সেখানেই কেটে যায় ৩০ বছর। সম্প্রতি তাঁকে নিয়ে ফেসবুকে একটি পোস্ট দেন স্থানীয় এক যুবক। সেই পোস্টের সূত্র ধরে অবশেষে নেপালে স্বজনদের কাছে ফিরতে পেরেছেন বীর বাহাদুর।
আজ বৃহস্পতিবার বিকেলে পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধা ও ভারতের ফুলবাড়ী সীমান্তের শুন্যরেখায় প্রশাসনের কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে বীর বাহাদুরকে স্বজনদের কাছে তুলে দেওয়া হয়। এ সময় শুন্যরেখায় আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। দীর্ঘদিন পর স্বজনেরা বীর বাহাদুরকে কাছে পেয়ে নেপালি টুপি ও উত্তরীয় পরিয়ে দেন। কেউ কেউ পা ছুঁয়ে সম্মান দেখিয়ে জড়িয়ে ধরেন বুকে। আবেগাপ্লুত বীর বাহাদুরও পা ছুঁয়ে স্বজনদের সম্মান দেখান। তাঁকে বিদায় জানাতে এসে আশ্রয় দেওয়া ব্যক্তিরা তখন কান্নায় ভেঙে পড়েন।
বাংলাবান্ধা ইমিগ্রেশন পুলিশের মাধ্যমে বীর বাহাদুর রায়কে তাঁর ভাতিজা (বড় ভাইয়ের ছেলে) রাজনের হাতে তুলে দেওয়ার সময় তেঁতুলিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফজলে রাব্বি, বাংলাদেশে নিযুক্ত নেপালের উপরাষ্ট্রদূত ললিতা সিলওয়াল, সেকেন্ড সেক্রেটারি ইউয়েজানা বামজাম, নেপাল রাষ্ট্রদূতের সচিব রিয়া ছেত্রী, বাংলাবান্ধা ইমিগ্রেশন পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা অমৃত অধিকারী, ভারতের ফুলবাড়ী ইমিগ্রেশন পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এস কে চৌধুরী, পঞ্চগড় চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সহসভাপতি মেহেদী হাসান খানসহ বিজিবি ও কাস্টমস কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। ফেরত পাঠানোর সময় দুপচাঁচিয়ার মাস্টার পাড়া এলাকার বাসিন্দারা বীর বাহাদুরকে আর্থিক সহায়তাও করেন।
বীর বাহাদুর রায় নেপালের ইলাম জেলার গোরখে বাঙ্গিনা এলাকার বাসিন্দা | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
অনুমানিক ৬০ বছর বয়সী বীর বাহাদুর রায় নেপালের ইলাম জেলার গোরখে বাঙ্গিনা এলাকার বাসিন্দা। তাঁর বাবার নাম বাম খুট্টা বুধা বলে জানা গেছে। তবে বীর বাহাদুরের কথাবার্তায় অসংলগ্নতা রয়েছে। তিনি এলাকার নাম ছাড়া অন্য কিছু জানাতে না পারায় পরিচয় শনাক্ত করতে বেশ সময় লেগেছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বগুড়ার দুপচাঁচিয়া পৌরসভার মাস্টার পাড়া এলাকায় অলক বসাক নামে এক ব্যক্তির চাতালে কাজ নিয়েছিলেন বীর বাহাদুর রায়। সেখানে অলক বসাকের পরিবারের সঙ্গেই থাকতেন তিনি। তবে নিজেকে তিনি নেপালের নাগরিক বলেও পরিচয় দিতেন। বাংলাদেশে থেকে ভাঙা ভাঙা বাংলা বলাও শিখেছিলেন। তবে তাঁর কথাবার্তা কেউ ভালোভাবে বুঝতে পারতেন না। বছর দেড়েক আগে মেহেদি হাসান খান নামে স্থানীয় এক যুবক বীর বাহাদুরকে নিয়ে ফেসবুকে একটি পোস্ট করেন। ওই পোস্টে তিনি বীর বাহাদুরের ছবি দিয়ে তিনি নেপালে ফিরতে চান বলে সহযোগিতা চান। এরপর বিষয়টি স্থানীয় প্রশাসনের নজরে এলে নেপালের দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। এরপর নেপাল দূতাবাস বীর বাহাদুরের দেওয়া ঠিকানা অনুযায়ী খোঁজখবর নিয়ে তাঁর পরিবারের সন্ধান পায়।
নেপালের রাষ্ট্রদূতের সচিব রিয়া ছেত্রী বলেন, মূলত ফেসবুকে একটি ছবি ও ভিডিও দেখে তাঁরা বীর বাহাদুর রায় সম্পর্কে জানতে পারেন। পরে দুপচাঁচিয়া উপজেলা প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। বীর বাহাদুর যে ভাঙা ভাঙা তথ্য দিয়েছিলেন, তা দিয়েই নেপালের ইলাম জেলা প্রশানের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁর পরিবারকে শনাক্ত করা হয়। তাঁর ছবি দেখে তাঁর বড় ভাবি তাঁকে চিনতে পেরেছিলেন। পরিবারের লোকজন জানান যে তিনি ৪৫ বছর আগে বাড়ি থেকে হারিয়ে যান। ওই সময় তিনি কিছুটা মানসিক ভারসাম্যহীন ছিলেন। পরে বাংলাদেশ সরকারের আইন অনুযায়ী পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করেন তাঁরা। প্রায় ছয় মাসের প্রক্রিয়া শেষে আজ তাঁকে স্বজনদের হাতে তুলে দেওয়া হয়।
বীর বাহাদুরকে স্বজনদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার সময় প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
নেপালে ফিরে যাওয়ার সময় বীর বাহাদুর রায় বলেন, ১৫-১৬ বছর আগে কাজ করতে করতে এখানে চলে এসেছিলেন। কয়েকজনের সঙ্গে ধান কাটার কাজ করতে করতে এসেছিলেন। এখন বাড়ি যাবেন, ভালো লাগছে।
বীর বাহাদুর রায়কে ফেরত পাঠানোর সময় নেপাল দূতাবাসের সেকেন্ড সেক্রেটারি ইউয়েজানা বামজাম ভারতের ফুলবাড়ী ইমিগ্রেশনে গিয়ে তাঁকে নেপাল পাঠানোর বিষয়ে সাহায্য করেন। পরে তিনি আবার বাংলাদেশে ফিরে আসেন।
দুপচাঁচিয়া পৌরসভার মাস্টার পাড়া এলাকার চাতালমালিক অলক কুমার বসাকের ভাই পলক কুমার বসাক এসেছিলেন বীর বাহাদুরকে বিদায় জানাতেন। তিনি বলেন, ‘বীর বাহাদুর আমাদের চাতালে ৩০ বছর ধরে ছিলেন। তিনি আমাদের পরিবারের সদস্যের মতো। তিনি গুছিয়ে সবকিছু বলতে পারেন না। তবে বলতেন যে তাঁর বাড়ি নেপালে। তিনি খুব কর্মঠ মানুষ ছিলেন। অত্যন্ত সৎ মানুষ ছিলেন। কেউ তাঁকে টাকাপয়সা দিতে চাইলে তা কখনোই নিতেন না। আজকে তাঁকে বিদায় দিতে এসেছি। এত দিন একটা মানুষকে রেখে এখন বিদায় দিতে খুব খারাপ লাগছে।’