নিজস্ব প্রতিবেদক: বাংলাদেশ ব্যাংক ডেকে নিয়ে একীভূত হওয়ার নির্দেশ দিলেও সরকার মালিকানাধীন বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক (বিকেবি) ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব) সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে পারছে না। কারণ, সরকারের কাছ থেকে একীভূত হওয়ার বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত পায়নি ব্যাংক দুটি। এর ফলে কৃষি অর্থায়নের জন্য গড়ে তোলা বিশেষায়িত ব্যাংক দুটিতে একীভূত হওয়া নিয়ে একধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে।

রাকাবের কর্মীরা একীভূত হওয়া ঠেকাতে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে যোগাযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন। অন্যদিকে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের কর্মীদের কেউ কেউ একীভূত হওয়ার বিরোধিতা করছেন, আবার অনেকে ব্যাংক দুটিকে দ্রুত একীভূত করার জন্য বিভিন্ন পর্যায়ে চেষ্টা করছেন। ব্যাংক দুটির একাধিক পরিচালক ও বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

বিকেবি ও রাকাব সূত্রে জানা গেছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উদ্যোগের পর ব্যাংক দুটির পরিচালনা পর্ষদ চলতি মাসের শুরুতে একীভূত হওয়া নিয়ে সরকারের সিদ্ধান্ত জানতে চেয়ে চিঠি দেয়। তবে এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো মতামত দেয়নি সরকার।

ব্যাংক দুটির কর্মকর্তারা বলছেন, একীভূত হওয়ার বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা মালিকপক্ষ তথা সরকারের। এ ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক সংস্থা একীভূত হওয়ার সিদ্ধান্ত দিয়েছে। এর ফলে ব্যাংক দুটিতে একধরনের অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়েছে। বিশেষ করে জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের অনেকে চাকরি হারানোর আশঙ্কা করছেন। কারণ, ২৫ বছর চাকরির বয়স হলে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর যে বিশেষ বিধান রয়েছে, তা এসব সরকারি ব্যাংকের কোনো কোনো কর্মকর্তার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হতে পারে বলে তাঁরা শঙ্কিত।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, গত ৩ এপ্রিল গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সভাপতিত্বে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে অনুষ্ঠিত একটি সভায় রাকাব ও বিকেবির চেয়ারম্যান এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালককে ব্যাংক দুটিকে একীভূত করার সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়। এরপর ১ মে রাকাব আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শেখ মোহাম্মদ সলিম উল্লাহর কাছে চিঠি পাঠিয়ে একীভূতকরণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে অর্থ মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানান।

এর আগে গত ১৭ এপ্রিল বাংলাদেশ ব্যাংকের মৌখিক নির্দেশনা মেনে বিকেবির সঙ্গে একীভূতকরণের বিষয়ে আলোচনার জন্য পরিচালনা পর্ষদের সভা ডাকে রাকাব। বিকেবির মতো দুর্বল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হওয়ার বিষয়ে ওই সভায় রাকাব তাদের উদ্বেগের কথা জানায় এবং এ বিষয়ে চূড়ান্ত মতামত দিতে অনুরোধ জানিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়।

রাকাবের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিরঞ্জন চন্দ্র দেবনাথ চিঠিতে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিবকে জানান, ২০২৪ সালের জুনে আর্থিক বছরের শেষ নাগাদ সমস্ত আর্থিক সূচকে উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে রাকাবের আয়-ব্যয় সমান হবে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের সুস্পষ্ট নির্দেশনা হলো রাকাব ও বিকেবিকে জরুরি বোর্ড সভা ডেকে একীভূতকরণের পক্ষে স্বপ্রণোদিত নীতিগত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে হবে এবং সেই অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংককে অবহিত করতে হবে।

চিঠিতে বলা হয়, বোর্ড পর্যবেক্ষণ করেছে যে একীভূতকরণের উদ্দেশ্যগুলো অর্জনের জন্য একটি শক্তিশালী ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হওয়া প্রয়োজন। অন্যথায় একীভূতকরণের প্রাথমিক উদ্দেশ্য বিপন্ন হতে পারে। এরপরও একীভূত হওয়ার বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্ত জানতে চায় ব্যাংকটি।

এ বিষয়ে কথা বলতে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনানুষ্ঠানিক নিষেধাজ্ঞা থাকায় ব্যাংক দুটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকেরা কোনো মন্তব্য করতে চাননি। তবে একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক হঠাৎ ডেকে একীভূত করার নির্দেশ দেওয়ায় ব্যাংক দুটিতে অস্থিরতা বেড়ে গেছে। এই অস্থিরতা আরও বেড়েছে সরকারের পক্ষ থেকে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত না আসায়।

১৯৮৭ সালে বিকেবির তৎকালীন রাজশাহী বিভাগের শাখাগুলো নিয়ে গঠন করা হয় রাকাব। বর্তমানে এটির বিস্তৃতি আছে রাজশাহী বিভাগ ভেঙে গঠিত রংপুর বিভাগের জেলাগুলোতেও। রাকাবের বিতরণ করা ঋণের ২১ শতাংশই এখন খেলাপি। গত পাঁচ অর্থবছরে রাকাবের লোকসানের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৫৮২ কোটি টাকা। আর সব মিলিয়ে পুঞ্জীভূত লোকসান ২ হাজার ৪৪৭ কোটি টাকা।

অন্যদিকে বিকেবির বিতরণ করা ঋণের ১২ দশমিক ৬৪ শতাংশই খেলাপি। পরিমাণের দিক থেকে যা ৩ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা। এখন পর্যন্ত বিকেবির পুঞ্জীভূত লোকসান দাড়িয়েছে ১২ হাজার ৭৪২ কোটি টাকায়।