মহিউদ্দিন: আবার বন্ধ হয়ে গেল দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপের শ্রমবাজার। কোনো দেশের জন্য বরাদ্দ করা সর্বোচ্চ কর্মী নিয়োগের কোটা পূর্ণ করেছে বাংলাদেশ। তাই নতুন করে কোনো কর্মী ভিসা পাচ্ছেন না। এতে ভোগান্তিতে পড়েছেন দালালের হাতে টাকা দিয়ে ভিসার অপেক্ষায় আছেন যাঁরা।
প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং মালদ্বীপের বাংলাদেশ হাইকমিশন সূত্র বলছে, বিদেশি কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করে মালদ্বীপের গত সরকার। কোনো একক দেশ থেকে এক লাখের বেশি কর্মী না নেওয়ার একটি আইন সংসদে অনুমোদন করেছে তারা। তাই বাংলাদেশ থেকে নতুন কর্মী ভিসা পাচ্ছেন না। তবে দেশটির নতুন সরকার এটি পর্যালোচনা করছে।
২২ মে একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করে মালদ্বীপের বাংলাদেশ হাইকমিশন। এতে বলা হয়, মালদ্বীপ সরকার বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য ভিসা প্রদান বন্ধ রেখেছে। তবে কোটা বাড়ানো ও ভিসা চালু করতে হাইকমিশন চেষ্টা করছে। সবাইকে সতর্ক করে বলা হয়, অনুমোদিত নিয়োগকর্তার বাইরে দেশটিতে কাজ করার সুযোগ নেই। এ আইন ভঙ্গ করার কারণে বেশ কিছু অদক্ষ কর্মীকে দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে।
বেকারত্ব দূর করতে পরিচিত একজনের মাধ্যমে মালদ্বীপ যেতে চান চট্টগ্রামের মনির হোসেন। গত মার্চে তাঁকে ভিসা দেওয়ার কথা ছিল, এখনো পাননি। তিনি বলেন, ২ লাখ ৬০ হাজার টাকা দিয়েছেন। ভিসা হলে আরও ২ লাখ টাকা দেওয়ার কথা। মালদ্বীপ আদৌ ভিসা দেবে কি না; তা বুঝতে পারছেন না। এক লাখ টাকা ঋণ করেছেন, প্রতি মাসে যার সুদ দিতে হচ্ছে।
মালদ্বীপের মোট জনসংখ্যা প্রায় সোয়া পাঁচ লাখ। দেশটির অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চালিকা শক্তি হলো পর্যটন খাত। প্রতিবছর গড়ে দুই লাখের বেশি পর্যটক দেশটিতে বেড়াতে যান। তাই হোটেল, রিসোর্ট, রেস্তোরাঁসহ পর্যটন খাতে বিদেশি কর্মীদের চাহিদা আছে। বর্তমানে দেশটিতে দুই লাখের কাছাকাছি বিদেশি কর্মী আছেন। এর মধ্যে বাংলাদেশের কর্মী সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশের বৈধ কর্মী আছেন এক লাখ। এর বাইরে আরও অন্তত ৩০ হাজার অনিয়মিত কর্মী থাকতে পারে।
বাংলাদেশের পর্যটকদের জন্য বিমানবন্দর থেকেই ভিসা দেয় মালদ্বীপ। এটির সুযোগ নিয়ে দালালেরা কর্মীদের সঙ্গে প্রতারণা করেন। এভাবে দূতাবাসের সত্যায়ন ছাড়াই কোনো কোনো কর্মী দেশটিতে গেছেন। তাঁদের শনাক্ত করা হচ্ছে। একই সঙ্গে নতুন কর্মীর চাহিদা আছে দেশটিতে। তাই দেশটির সরকার বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেওয়ার বিষয়ে ভাবছে। আগামী মাসে মালদ্বীপের সংসদ অধিবেশনে বিদেশি কর্মী নিয়োগের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হতে পারে। কোটা বাড়াতে পারে নতুন সরকার।
মালদ্বীপে বাংলাদেশ হাইকমিশনের শ্রম বিভাগের প্রথম সচিব মো. সোহেল পারভেজ বলেন, কোটার আইনি বাধ্যবাধকতা আছে। তাই এপ্রিল থেকে নতুন ভিসা দিচ্ছে না দেশটি। তবে সরকারের সঙ্গে আলোচনা চলছে, তারা নতুন কর্মী নেওয়ার বিষয়ে ইতিবাচক। কোটা বাড়লে আবারও নতুন কর্মী দেশটিতে যেতে পারবেন।
চালুর তিন মাস পর আবার বন্ধ
বাংলাদেশ জনশক্তি, প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থান ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য বলছে, ২০০৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত মালদ্বীপে কাজ নিয়ে গেছেন ১ লাখ ৪ হাজার কর্মী। এরপর ২০১৯ সালে দেশটিতে যান ৪ হাজার ৪১১ জন কর্মী। ওই বছরেই শ্রমবাজারটি বন্ধ হয়ে যায়। করোনাভাইরাস মহামারি শুরুর পর বৈধ কাগজ না থাকা কর্মীদের ধরে দেশে পাঠানো শুরু করে মালদ্বীপ। ২০২১ সালের মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়েই ১৬ হাজার কর্মী দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হন।
২০১৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত কার্যত বন্ধই ছিল মালদ্বীপের শ্রমবাজার। এর মধ্যে কিছু কিছু কর্মী যাওয়ার সুযোগ পেয়েছেন পুরোনো কর্মীর বদলি হিসেবে। আর কিছু কর্মী গেছেন পেশাদার ও দক্ষ কর্মী হিসেবে। এ ছাড়া গত কয়েক বছরে প্রায় ৪০ হাজার অনিয়মিত বাংলাদেশি কর্মীকে বৈধ করেছে দেশটি। এরপর গত ডিসেম্বরে শ্রমবাজার চালু করা হয়। এরপর গত জানুয়ারি থেকে মূলত অদক্ষ কর্মী পাঠানো শুরু হয় দেশটিতে। ২২ মে পর্যন্ত মালদ্বীপ যেতে বিএমইটি থেকে ছাড়পত্র নিয়েছেন ৬ হাজার ৪৩৬ জন। তাঁদের মধ্যে একটি বড় অংশ ভিসা না পেয়ে আটকা পড়েছে, যে সংখ্যাটি কেউ নিশ্চিত করতে পারেনি।
পরিচিত এক দালালের মাধ্যমে মালদ্বীপ যেতে ৩৫ হাজার টাকা দিয়েছেন চাঁদপুরের শেখ আলামিন। তিনি বলেন, বন্ধ শ্রমবাজারটি চালু করার পর মাত্র তিন মাস পর আবার বন্ধ হয়ে গেল। এর মধ্যে তাঁর মতো অনেকেই টাকা জমা দিয়ে এখন অনিশ্চয়তায় আছেন। এর চেয়ে বাজার না খোলাই ভালো ছিল। দালাল এখনো বিভিন্ন আশ্বাস দিচ্ছেন।
দরকার রাজনৈতিক যোগাযোগ
এশিয়া ফাউন্ডেশনের সঙ্গে মিলে মালদ্বীপে বাংলাদেশি কর্মীদের ওপর একাধিক গবেষণা করেছে অভিবাসন খাতের বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিট (রামরু)। এসব গবেষণা বলছে, অনিয়মিত কর্মীরা কম বেতনে দেশটিতে কাজ করেন। একজন বৈধ কর্মী বছরে তিন লাখ টাকার বেশি ও অনিয়মিত কর্মী দুই লাখ টাকার বেশি প্রবাসী আয় পাঠান দেশে। দেশটিতে যাওয়া কর্মীদের মধ্যে ৯৬ শতাংশই গেছেন স্বজন বা দালালের মাধ্যমে।
মালদ্বীপে বাংলাদেশি শ্রমিকদের নিয়ে বিভিন্ন সময় গবেষণা করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক সাহাব এনাম খান। তিনি বলেন, কোটা বাড়াতে দেশটির সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক যোগাযোগ দরকার। দুই দেশের অভিবাসন বিভাগেরও বৈঠক করা উচিত। হাইকমিশনকে আরও উদ্যোগী হতে হবে।