নিজস্ব প্রতিবেদক: সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশ উপজেলার মেরিনা খাতুনকে ‘যুদ্ধশিশু’ হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি জানিয়ে বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা প্রয়াত পচি বেগমের সন্তান মেরিনা খাতুনকে আনুষ্ঠানিক চিঠি পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। যুদ্ধশিশু মেরিনার কোথাও পিতার নাম লেখার প্রয়োজন হবে না। পিতার নাম ছাড়াই তিনি রাষ্ট্রের সব সুবিধা বা অধিকার ভোগ করতে পারবেন।

জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) ৮৯তম বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়েছে। ৫ মে স্বাক্ষরিত বৈঠকের কার্যবিবরণী থেকে এ তথ্য জানা গেছে। এর আগে ২০২২ সালে জামুকার ৮২তম বৈঠকে মেরিনা খাতুনের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের হাতে নির্যাতিত বীরাঙ্গনার সন্তানদের ‘যুদ্ধশিশু’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সে সময় এ-সংক্রান্ত প্রস্তাবটি অনুমোদনের জন্য মন্ত্রিসভার বৈঠকে পাঠানোর পর বিষয়টি আর এগোয়নি।

মেরিনা খাতুনকে যুদ্ধশিশু হিসেবে স্বীকৃতি নিয়ে জামুকার বৈঠকের বিবরণীতে বলা হয়েছে, মেরিনা খাতুনের নাম যুদ্ধশিশু হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদান বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ মতামত দিয়েছে। সে অনুযায়ী জামুকার চেয়ারম্যান ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীর কাছে এ-সংক্রান্ত নথি উপস্থাপন করা হলে তিনি ‘মন্ত্রিপরিষদের সিদ্ধান্ত মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া যায়’ মর্মে নির্দেশনা প্রদান করেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় জানায়, ‘মন্ত্রণালয়ের এলোকেশন অব বিজনেস অনুযায়ী ও আইন বিধিবিধানের আলোকে যুদ্ধশিশু হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদানের কোনো পরিপত্র, আইন ও বিধিবিধান এ মন্ত্রণালয়ে পাওয়া যায়নি।’ পরে বিষয়টি নিয়ে জামুকার বৈঠকে বিস্তারিত আলোচনা করে মেরিনা খাতুনকে যুদ্ধশিশু হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। যুদ্ধশিশু হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতির বিষয়টি জানিয়ে মেরিনা খাতুনকে চিঠি পাঠানোরও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, বীরাঙ্গনার সন্তানেরাই এখন থেকে যুদ্ধশিশু হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাবেন। গত ৫৩ বছরে যুদ্ধশিশু হিসেবে বাংলাদেশে কোনো শিশু রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পায়নি। আমরা জামুকার ৮৯তম বৈঠকে তাদের স্বীকৃতির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছি এবং বিষয়টি চিঠি দিয়ে জানিয়ে দিতে বলেছি। বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা প্রয়াত পচি বেগমের সন্তান মেরিনা খাতুন নামের একজন বীরাঙ্গনার সন্তান আমাদের কাছে আবেদন করেছিলেন। তিনি লিখেছেন, তাঁর মা বীরাঙ্গনা। কোথাও কোনো আবেদনে বাবার নাম উল্লেখ করতে পারছেন না এবং সে কারণে চাকরিও পাচ্ছেন না তিনি। তাঁর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে জামুকার বৈঠকে সর্বসম্মতিক্রমে ও মন্ত্রিসভার মতামতের পরিপ্রেক্ষিতে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

জামুকা সূত্র জানায়, সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা প্রয়াত পচি বেগমের সন্তান মেরিনা খাতুন জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে ২০২২ সালের গত ৮ সেপ্টেম্বর যুদ্ধশিশু হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি চেয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে আবেদনটি পাঠান। আবেদনে মেরিনা খাতুন উল্লেখ করেন, ‘আমার মাতা মৃত পচি বেগমকে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় রাষ্ট্রীয়ভাবে ২০১৮ সালের ৪ জুলাই বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেন। যার গেজেট নম্বর ২০৫। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আমার মাতা পচি বেগম পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসরদের দ্বারা পাশবিক নির্যাতনের শিকার হন। সে সময় আমি তাঁর গর্ভে জন্মগ্রহণ করি। উল্লেখ্য, সে সময় আমার মাতা বিধবা ছিলেন। লোকলজ্জার ভয়ে তিনি আমাকে ভ্রূণেই শেষ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ভাগ্যগুণে আমি বেঁচে যাই এবং মায়ের অন্য সন্তানদের দয়া ও ভালোবাসায় আমি বেড়ে উঠি। সম্প্রতি আমার মা পচি বেগম রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেলেও আমার কোনো পরিচয় আজও আমি নিশ্চিত করতে পারিনি।’

১৯৭১ সালে দেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে তাড়াশের উত্তর পাড়া গ্রামের মৃত ফাজিল আকন্দের স্ত্রী পচি বেওয়াকে বাড়ি থেকে স্থানীয় রাজাকাররা অস্ত্রের মুখে পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে আটক রেখে পাকিস্তানি বাহিনী তাঁর ওপর নির্যাতন চালায়। এরপর জন্ম হয় যুদ্ধশিশু মেরিনা খাতুনের।

১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনীর দানবীয় অত্যাচারের ফলে অনেক বাঙালি জীবন দিয়েছিলেন, অনেকে পঙ্গুত্ব বরণ করেছিলেন আর অনেক নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। আর এই নারী নির্যাতনের ফলে জন্ম নেয় অনেক যুদ্ধশিশু। যুদ্ধশিশুর সংখ্যা কত ছিল, তার কোনো পরিসংখ্যান কখনো করা হয়নি। এই যুদ্ধশিশুদের অবস্থান আজ কোথায়, তা-ও নির্দিষ্টভাবে বলতে পারেন না কেউ।