সুন্দরবনের অর্ধশতাধিক স্থানে শনিবার সন্ধ্যায়ও বিক্ষিপ্তভাবে আগুন জ্বলতে দেখা যায়। আমোরবুনিয়ার লতিফের ছিলা এলাকায় | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন 

প্রতিনিধি বাগেরহাট: সুন্দরবনের পূর্বাংশে লাগা আগুনে এরই মধ্যে পুড়ে গেছে কিছু এলাকা। গতকাল শনিবার আগুন লাগার বিষয়টি নজরে আসার পর দুপুর থেকেই বন বিভাগ, স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক ও বাসিন্দারা মিলে আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ শুরু করেন। তবে দুর্গম এলাকা এবং পানির উৎস দূরে থাকায় গতকাল বিকেলে ফায়ার সার্ভিস সেখানে পৌঁছালেও আগুন নির্বাপণে আর কাজ শুরু করতে পারছিল না। আজ রোববার সকাল সাড়ে ১০টায় শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত আগুন জ্বলছিল।

সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের জিউধারা স্টেশনের আমোরবুনিয়া টহল ফাঁড়ির লতিফের ছিলা এলাকায় লাগা আগুন এরই মধ্যে অন্তত ২ কিলোমিটার এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে বলে দাবি স্থানীয় মানুষের। বনাঞ্চলের ঝুঁকি বিবেচনায় রাতে অগ্নিনির্বাপণের কাজ স্থগিত ছিল। আজ সকাল থেকে আবারও কাজ শুরু করেছে বন বিভাগ, ফায়ার সার্ভিস, স্থানীয় বাসিন্দা ও স্বেচ্ছাসেবকেরা। তাদের সহযোগিতায় যোগ দিয়েছে কোস্টগার্ড ও নৌবাহিনীর দুটি পৃথক দল।

এদিকে অগ্নিকাণ্ডের কারণ ও ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) রানা দেবকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগ। কমিটিকে আগামী সাত কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।

সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) কাজী মুহাম্মদ নুরুল করিম গতকাল সকালে মুঠোফোনে বলেন, আগুন নির্বাপণে সকাল থেকে সবাই সম্মিলিতভাবে আবারও কাজ শুরু করেছে। অগ্নিকাণ্ডের কারণ ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানতে এসিএফ চাঁদপাইকে প্রধান করে তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। স্টেশন কর্মকর্তা ধানসাগর ও স্টেশন কর্মকর্তা জিউধারাকে নিয়ে গঠিত তিন সদস্যের ওই কমিটিকে সাত কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। আগুন নির্বাপণের কাজ শেষ হলে তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করবে।

আগুন নিয়ন্ত্রণে আজ সকাল থেকে ফায়ার সার্ভিসের বিভিন্ন স্টেশনের অর্ধশত কর্মী কাজ শুরু করেছেন। ঘটনাস্থলে এসেছেন ফায়ার সার্ভিসের বিভাগীয় কর্মকর্তারাও।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মোরেলগঞ্জ স্টেশনের স্টেশন কর্মকর্তা আবুল ফারুখ বলেন, ‘আগুন নির্বাপণে আমাদের বিভিন্ন স্টেশনের ৫০ জন কর্মী এবং ২৫০ জন স্বেচ্ছাসেবক সকাল থেকে কাজ শুরু করেছে। পাম্প মেশিন, ফায়ার হোজ পাইপসহ সব মালামাল নিয়ে আসা হয়েছে। কাছের পানির উৎস ভোলা নদী থেকে আগুনের এলাকা প্রায় দুই কিলোমিটার ভেতরে। সবকিছু স্থাপন করে পানি ছিটানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে।’

গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত আগুন যেখানে ছিল, তা আরও নতুন এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে বলে জানাচ্ছেন স্থানীয় লোকজন। তাঁরা বলছেন, রাতে আরও নতুন এলাকা পুড়ছে। আগুন যে পর্যন্ত ছিল, আশপাশে তা আরও ছড়িয়েছে। বেশ কিছু গাছপালা, লতাগুল্ম পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। আগুন লাগা বনাঞ্চলের ওই এলাকায় মূলত বলা, সুন্দরী, বাইন, গেওয়া, জিন, সিংড়াসহ বিভিন্ন ধরনের লতাগুল্ম–জাতীয় গাছ রয়েছে। আগুন যাতে ছড়িয়ে পড়তে না পারে, এ জন্য স্থানীয় লোকজন নিয়ে বন বিভাগ কিছুটা পাতার স্তূপ সরালেও গভীর ফায়ার লাইন কাটতে পারেনি।

কোস্টগার্ড পশ্চিম জোনের অপারেশন কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট মুনতাসীর ইবনে মহসীন মুঠোফোনে  বলেন, আগুন নির্বাপণের কাজে সহযোগিতার জন্য সকাল থেকে কোস্টগার্ড ও নৌবাহিনীর দুটি দল ঘটনাস্থলে পৌঁছে কাজ শুরু করেছে।

স্থানীয় বাসিন্দা ও চাঁদপাই রেঞ্জের পূর্ব আমোরবুনিয়া ভিলেজ কনজারভেশন ফোরামের (ভিসিএফ) সাধারণ সম্পাদক মহিদুল হাওলাদার বলেন, ‘রাতে আগুন আরও বাড়ছে, সন্ধ্যা পর্যন্ত যতটুকু ছিল পাশের নতুন এলাকাও পুড়েছে। বেশ কিছু এলাকা একেবারে ছাই হইয়ে গেইছে। বাতাসের গতিতে কিছু কিছু এলাকায় আগুন লম্বা হয়ে ছোটছে। সকালে একটা হেলিকপ্টার এসে আগুনের এলাকার ওপর দিয়ে ঘুরে গেছে। এখন পানি দেওয়া শুরু হলে হয়তো আগুন দমবে।’

স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, বনের ওই এলাকায় বন্য প্রাণীর চাপ বেশি। বাঘ, হরিণ, বানরসহ অনেক প্রাণীর বাস এখানে। বন থেকে লোকালয় কাছে হওয়ায় এবং সহজে বনে প্রবেশের সুযোগ থাকায় এখানে চোরা শিকারিদের বনে প্রবেশ সহজ। বনের ওই এলাকায় বর্ষা মৌসুমে মাছ শিকারের জন্য এর আগে আগুন দেওয়ার অভিযোগও আছে।

সর্বশেষ ২০২১ সালের ৩ মে পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের দাসের ভারানি এলাকায় আগুন লেগেছিল। এ নিয়ে গত ২৩ বছরে সুন্দরবনের ভোলা ও মরা ভোলা নদীসংলগ্ন ওই এলাকায় অন্তত ২৫ বার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটল।