রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২৫ বৈশাখ ১২৬৮—২২ শ্রাবণ ১৩৪৮ বঙ্গাব্দ) | ছবি: সংগৃহীত

নিজস্ব প্রতিবেদক: আজ বুধবার ২৫ বৈশাখ কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মবার্ষিকী। এতগুলো বছর পেরিয়ে গেলেও তিনি বাঙালির মনে ও মননে সব সময় জাগরূক। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান বাঙালির নিত্যসঙ্গী। চলতে–ফিরতে, বিভিন্ন ধরনের সভা, সমাবেশ, অনুষ্ঠান, উৎসবে রবীন্দ্রসংগীতের সুর কানে আসে। সংকটে তাঁর বাণী অতীতের মতো এখনো প্রেরণার উৎস। সত্যের পথে চলতে, অন্যায়ের প্রতিবাদে কেউ পাশে না থাকলেও অভীষ্ট লক্ষ্যে দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে একাই এগিয়ে যাওয়ার সাহস জোগান তিনি। এমন আরও অনেকভাবেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাঙালির জীবনঘনিষ্ঠ হয়ে আছেন। তাঁর গান জাতীয় সংগীত হিসেবে গেয়ে ধন্য হয়েছে এ দেশের মানুষ। আজ কবিগুরুর জন্মদিন ‘রবীন্দ্রজয়ন্তী’ উৎসব হিসেবে উদ্‌যাপিত হবে দেশজুড়ে।

কলকাতার বিখ্যাত ঠাকুর পরিবারে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে কবির জন্ম ১২৬৮ বঙ্গাব্দের ২৫ বৈশাখ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সরদা সুন্দরী দম্পতির চতুর্দশ সন্তান। শৈশব থেকেই তিনি ঠাকুর পরিবারের উচ্চতর সাংস্কৃতিক ও মানবিক মূল্যবোধের পারিবারিক পরিবেশে বেড়ে ওঠেন। সেই সময়ের বহু জ্ঞানী, গুণী, খ্যাতিমান মানুষের সাহচর্য লাভ করেন। এসবই ছিল তাঁর মানস গঠনের সহায়ক। পরে জমিদারির কাজ পরিচালনার জন্য পূর্ব বাংলার পল্লি এলাকায় ব্যাপক ভ্রমণ, প্রান্তিক মানুষের জীবনযাত্রার নিবিড় পর্যবেক্ষণ ও নৌকায় নদীপথের দীর্ঘ যাত্রা প্রকৃতি সম্পর্কে তাঁর চিত্তে গভীর ও সুদূরপ্রসারী প্রভাব সঞ্চার করে। এই অঞ্চলের মানুষ, প্রকৃতি, পরিবেশ, জীবনদর্শনসহ বিভিন্ন অনুষঙ্গ পরবর্তীকালে তাঁর রচনায় বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনায় উদ্ভাসিত হয়েছে।

কবি বলেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সর্বসাধারণের কাছে পরিচিত হলেও তার প্রতিভা যে বিচিত্র ধারায় প্রবাহিত হয়েছে, তা সবারই জানা। তিনি তাঁর গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের জন্য ১৯১৩ সালে নোবেল পুরস্কার অর্জন করে বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বসভায় উপস্থাপিত করেছেন। কবিতা ছাড়াও তিনি বাংলা ভাষার মহৎ সংগীতের স্রষ্টা। উপন্যাস, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, নাটক, ছড়া, শিশুতোষ রচনা, ভ্রমণ, পত্রসাহিত্যসহ সাহিত্যের প্রতিটি ক্ষেত্র তাঁর অনন্য প্রতিভার স্পর্শে স্বর্ণময় হয়ে উঠেছে।

সাহিত্যকর্ম ছাড়াও চিত্রকলায় নতুন মাত্রা যোগ করেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। নতুন ধরনের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য প্রতিষ্ঠা করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়। প্রান্তিক কৃষকদের আর্থিক সহায়তার বিষয়ে গভীর ভাবনা ছিল, তিনি ক্ষুদ্রঋণের পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন। এসব কর্মপ্রবাহের মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রত্যক্ষভাবে সমাজ ও জনকল্যাণের কাজে সরাসরি যুক্ত থেকেছেন। প্রচুর বিদেশ ভ্রমণ তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ও চেতনাকে বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে ব্যাপ্ত করে তুলেছিল। বিশ্বকবি হয়ে উঠেছিলেন তিনি।

অন্যদিকে অন্যায়ের প্রতিবাদে থেকেছেন প্রবল সোচ্চার। অন্যায়ের প্রতিবাদে কেবল প্রেরণাই জোগাননি, জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে পরিত্যাগ করেছেন ব্রিটিশদের দেওয়া ‘নাইটহুড’ খেতাব। বৈশাখে জন্ম, ৮০ বছরের কর্মবহুল জীবন কাটিয়ে ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ২২ শ্রাবণ কবির মহাপ্রয়াণ।

বরাবরের মতোই রাজধানী ঢাকাসহ কুষ্টিয়ার শিলাইদহ, সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর, নওগাঁর পতিসরে কবির স্মৃতিবিজড়িত স্থানে সরকারি উদ্যোগে রবীন্দ্রজয়ন্তীর কর্মসূচি পালিত হবে। এ ছাড়া বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন রবীন্দ্রজয়ন্তী উপলক্ষে কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।

কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। বাসস জানায়, বাণীতে তাঁরা কবির স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন।

রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন তাঁর বাণীতে বলেছেন, মনুষ্যত্বের বিকাশ, মানবমুক্তি ও মানবপ্রেম ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনবোধের প্রধান পাথেয়। তিনি বলেন, বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অসামান্য অবদান রেখে গেছেন। কবি বিশ্ব পরিমণ্ডলে বাংলা সাহিত্যকে স্বমহিমায় উদ্ভাসিত করেছিলেন। তৎকালীন পূর্ববঙ্গের সঙ্গে ছিল কবির গভীর সম্পর্ক। পূর্ববঙ্গের দরিদ্র ও অবহেলিত মানুষের দুঃখ-দুর্দশা ও মানবসমাজ সম্পর্কে উপলব্ধি তাঁর সাহিত্যে গভীরভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের জীবন ও সাহিত্যের মধ্যেই আমরা পেতে পারি মানসিক শান্তি ও কাঙ্ক্ষিত অনুপ্রেরণা।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর বাণীতে বলেন, রবীন্দ্র দর্শনের প্রধান বিষয় হচ্ছে অসাম্প্রদায়িক চেতনা, বিশ্বমানবতাবোধ ও মানুষে মানুষে মিলন। তাঁকে জীবনমুখী শিক্ষা দর্শনের পথপ্রদর্শকও বলা যায়। বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে তাঁর রচনা আলোক শিখা হয়ে বাঙালিকে দেখিয়েছে মুক্তির পথ। মহান মুক্তিযুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গান হয়ে উঠেছিল মুক্তিকামী বাঙালির চেতনাসঞ্চারী বিজয় মন্ত্র। তিনি বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের একান্ত আপনজন। জীবনের যেকোনো সমস্যা-সংকটে তাঁর সৃষ্টি উত্তরণের অনিবার্য উপায়। আজ বিশ্বব্যাপী যে যুদ্ধ-সংঘাত, হিংসা-হানাহানি আর সাম্প্রদায়িকতার নগ্ন উল্লম্ফন, তা নিরসনে রবীন্দ্রনাথ হতে পারেন প্রধান নিয়ামক শক্তি।