২৮ বছর আগের এক বিচারকের প্রতি সম্মান জানাতে মঙ্গলবার বিকেলে নিজস্ব মিলনায়তনে জড়ো হন শতাধিক আইনজীবী। ওই বিচারক উপস্থিত না থাকলেও উপস্থিত ছিলেন তাঁর মেয়ে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

প্রতিনিধি নাটোর: নাটোরের আইনজীবীদের জন্য আজকের (মঙ্গলবার) বিকেলটা ছিল একটু অন্য রকম। কাজ শেষে পড়ন্ত বিকেলে অন্য দিনের মতো আজ তাঁরা বাড়িতে ফেরেননি। দলবেঁধে আইনজীবী সমিতির মিলনায়তনে জড়ো হন তাঁরা। সেখানে তিলধারণের ঠাঁই ছিল না। আগন্তুক এক অতিথিকে ঘিরে তাঁদের যতটা না আগ্রহ ছিল, তার চেয়ে বেশি উচ্ছ্বাস ছিল অতিথির বাবার স্মৃতিময় কর্মজীবন নিয়ে।

অতিথি শারমিন ফারজানার (৪৩) বাবা ফজলুল করিম ২৮ বছর আগে নাটোরের জেলা ও দায়রা জজ ছিলেন। নাটোরের বিচারপ্রার্থীদের কাছে তিনি ছিলেন একজন ন্যায়পরায়ণ ও বিচক্ষণ বিচারক। তিনি আসেননি। তাঁর মেয়ে এসেছেন। শুধু এই খবর শুনে মেয়ের সঙ্গে দেখা করার জন্য, কথা বলার জন্য ছুটে এসেছেন শত আইনজীবী।

জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি আবু আহসানের সভাপতিত্বে মতবিনিময় সভায় বক্তব্য দেন সরকারি কৌঁসুলি আসাদুল ইসলাম, সমিতির সাবেক সভাপতি রুহুল আমীন তালুকদার, জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মোশররফ হোসেন, মৃণাল কান্তি, বিশেষ কৌঁসুলি আনিসুর রহমান, লোকমান হোসেন, খগেন্দ্র নাথ প্রমুখ।

সরকারি কৌঁসুলি আসাদুল ইসলাম বলেন, ‘স্যার কখনো অন্যায়কে প্রশ্রয় দিতেন না। এক কর্মচারীর ঘুষ চাওয়া নিয়ে আমার এক অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি তাৎক্ষণিক ওই কর্মচারীকে বরখাস্ত করেছিলেন। পরে ওই কর্মচারী দোষ স্বীকার করে চাকরি ফিরে পেয়েছিলেন।’

আইনজীবী মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘একটি হত্যা মামলায় কয়েকজন আসামি ছিলেন। বিচার শেষে স্যার শুধু আসামি আক্কেল আলীকে যাবজ্জীবন দিয়েছিলেন। পরে ওই আসামি আমাকে বলেছিলেন, খুনটা আমি একাই করেছিলাম। ঘটনাস্থল ছিল একটা শ্মশানঘাট। তাঁর মতে ওই শ্মশানের গাছপালা, পাখি আর জিন ছাড়া কেউ ঘটনাটি দেখেনি। অথচ বিচারক তাঁকেই শাস্তি দিয়েছেন।’

আইনজীবী মৃণাল কান্তি বলেন, ফজলুল করিম স্যার সব সময় বলতেন, স্ত্রীর মূল্যায়ন নিতে হবে স্বামীর কাছে, আর স্বামীর মূল্যায়ন নিতে হবে তাঁর স্ত্রীর কাছে। তাহলেই প্রকৃত সত্যটা জানা যাবে। এভাবে প্রত্যেক বক্তাই বিচারক ফজলুল করিমের ন্যায়পরায়ণতা ও বিচক্ষণতার বর্ণনা দেন। তাঁর প্রতি অশেষ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার কথা জানান। তাঁকে আরেকবার শুধু মুখোমুখি দেখতে চান।

বাবা সম্পর্কে শুনতে শুনতে মেয়ে শারমিন ফারজানার চোখে আনন্দের জলধারা বইতে শুরু করে। তিনি দাঁড়িয়ে বলেন, ‘আমার বাবা ১৯৯২ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত নাটোরের জেলা ও দায়রা জজ ছিলেন। আমি তখন নাটোর বালিকা বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি। একটানা পাঁচ বছর আমার বাবা একই পদে কর্মরত ছিলেন। এখান থেকে বদলি হওয়ার পর তিনি অবসরে গেছেন। তখন আমি বিচারক বাবাকে অতটা বুঝতাম না। তবে তাঁর নাটোরকে ঘিরে আগ্রহের শেষ ছিল না। এটা বুঝলাম কদিন আগে আমি যখন রাজশাহীতে আসি। তখন আমার বাবা আমাকে বলেছেন, তুমি নাটোরে গিয়ে আমার সময়কার আইনজীবীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এসো। তাঁদের আমার সালাম জানিও। বাবার আদেশ পালন করতে আমি এখানে এসেছি। এখানে এসে আপনাদের মুখে আমার বাবার সম্পর্কে যা শুনলাম, তাতে আমি আমার বাবাকে নতুন করে আবিষ্কার করলাম। এত দিন জানতাম, তিনি একজন সৎ ও ন্যায়পরায়ণ বিচারক ছিলেন। আজ বুঝলাম তিনি এর চেয়েও বেশি কিছু ছিলেন। আপনারা আমার বাবাকে এত বেশি ভালোবাসেন, তা ধারণাও করতে পারিনি।’

কান্নাজড়িত কণ্ঠে শারমিন বলেন, ‘বাবার জন্য আমি গর্বিত।’ পরে তিনি বাবার সে সময়ের সহকর্মীদের সঙ্গে আদালত চত্বর ঘুরে দেখেন।