ঘরের উঠানের জায়গায় এখন পশুর নদ। সেখানে বসে মাছের পোনা আলাদা করছেন নার্গিস বেগম। বুধবার বাগেরহাটের মোংলা উপজেলার দক্ষিণ কানাইনগর গ্রাম  | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

প্রতিনিধি বাগেরহাট: চোখের সামনে নিজের চেনা উঠান, প্রশস্ত রাস্তার পুরোটাই পশুর নদে বিলীন হতে দেখেছেন নার্গিস বেগম। কাঠ ও টিনের চালার বসতঘরটি কোনো রকম দাঁড়িয়ে থাকলেও ঘূর্ণিঝড় রিমালে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসের তোড়ে একাংশের মাটি ভেঙে পড়ছে নদে। গতকাল বুধবার দুপুরেও জোয়ারের উঁচু ঢেউ আছড়ে পড়ছিল নার্গিসের জীর্ণ ঘরের বারান্দায়; ছুঁয়ে যাচ্ছিল তাঁর পা। আর ইট বিছানো বারান্দায় বসে একটি বড় পাত্র থেকে মাছ ও চিংড়ির পোনা আলাদা করছিলেন তিনি।

‘পোনা আমার ছেলেতে ধরিছে, তাই বাছতিছি। কী করব? ভাঙার মধ্যি আছি, যাব কোআনে (কোথায়)? সবই তো ভাইসা গ্যাছে। শুধু এই ঘরখানই আছে দাঁড়ায়ে। তা–ও যানি কহন (কখন) যান (যায়) নদীতি (নদীতে)।’ মাছ বাছতে বাছতেই কথাগুলো বলছিলেন মধ্যবয়সী নার্গিস। ভাঙা ঘর আর ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়া সংসারের শোক পালনের ফুরসত নেই নার্গিসদের। এরই মধ্যে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফেরার সংগ্রাম করছেন তাঁর মতো উপকূলের বাসিন্দারা।

নার্গিসের বসবাস বাগেরহাটের মোংলা উপজেলার দক্ষিণ কানাইনগর গ্রামে পশুর নদের তীরে। ঘূর্ণিঝড় রিমাল আঘাত হানার আগে নার্গিসের সংসারে একটি ছোট্ট উঠান ছিল। আর উঠানঘেঁষা রাস্তার ওপারে ছিল পশুর নদ। ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবে রাস্তাটি নদে বিলীন হয়ে নার্গিসের ঘরের কোনা পর্যন্ত এসে ঠেকেছে।

ঘরটির কাছাকাছি হঠাৎ একটি ট্রলার এসে দাঁড়াল। নৌযানটিতে দুই কিশোর ও দুই শিশুর সঙ্গে মধ্যবয়সী এক পুরুষকে দেখা গেল। নৌকা থেকে নার্গিসকে কিছু মাছ ও পোনা দিয়ে নৌযানটি আবার হারিয়ে গেল উত্তাল নদের বুকে। নার্গিস বলেন, তাঁর তিন ছেলের একজন অন্তর সরদার এসব মাছ-পোনা ধরে। ছোট দুজন ঘরে থেকে আর কী করবে। ঘরে-বাইরেও দাঁড়ানোর জায়গা নেই। তাই ওরাও গেল নদীতে।

নার্গিস আরও জানান, গতকাল দুপুরে তিন দিনের মধ্যে প্রথমবার ভাত খেয়েছেন তাঁরা। ঘূর্ণিঝড়ের কারণে গত কয়েক দিন তাঁদের চুলা জ্বলেনি।

গত রোববার ঘূর্ণিঝড় রিমাল আঘাত হানে। কয়েক দিন পেরিয়ে গেলেও পশুর নদ এখনো উত্তাল। আছে বাতাসের তীব্রতাও। তবে এসবের পরোয়া নেই স্থানীয় মানুষের। নারী–পুরুষ–শিশুনির্বিশেষে সবাই নদে নেমেছে জাল দিয়ে মাছ ধরতে। সুন্দরবনসংলগ্ন কানাইনগর গ্রামটির অধিকাংশ বাসিন্দাই বনজীবী কিংবা জেলে।

পশুর নদের পারের এই গ্রামের প্রায় সব কটি ঘরেই এখন জলোচ্ছ্বাসের ক্ষতচিহ্ন। এখানে এমন কোনো ঘর নেই, যা ঘূর্ণিঝড়ের রাতে প্লাবিত হয়নি। সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্তও হয়েছে এগুলোর কয়েকটি। তারপরও নানাভাবে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন বাসিন্দারা। তাঁদের একজন ষাটোর্ধ্ব মনিরা বেগম। পুত্রবধূকে সঙ্গে নিয়ে নদে নেমে জোয়ারে ভেসে আসা ক্ষতিগ্রস্ত বাড়ি ও স্থাপনার কাঠ-টিন সংগ্রহ করছিলেন।

আরেকটু এগোতেই ভেজা কাঁথা-কাপড় রোদে শুকাতে দেখা গেল রানী বেগমকে। তবে আকাশে মেঘ দেখে সেগুলো আবার ঘরে নিয়ে যান তিনি। প্রথম আলোর প্রতিবেদককে দেখে রানী বলেন, ‘আসেন, দেখেন, সব ভাসি গেছে। ঘরডা শুধু আছে। মাচার ওপর মেয়ে তিনডের বই রাহিলাম, এট্টার তা পাচ্ছি না।’

রানী বেগম আরও বলেন, ‘আমরা কেউ সাইক্লোনে (শেল্টারে) গেছিলাম না। ভাবছিলাম না, এত বড় ঝড় হবে। কিন্তু রাতি যখন পানি আসা ধরল, মুহূর্তের মদ্দি দেহি মাজাসমান হয়ে গেছে। তহন সবাই দৌড়ায়ে বের হইছি। আর এট্টু হলি তো মনে হয় ডুবে মরতাম।’

স্বামী আর তিন মেয়ে নিয়ে পাঁচজনের সংসারে ঝড়ের তিন দিন পরও রান্না করতে পারেননি রানী বেগম। তিনি বলেন, ‘পাশের বাড়ি তে খাবার দিছে, না হলি শুকনো খাবার খেয়ে থাকতি হতো। চুলো ঠিক করলাম আইজ। ওর বাপ মাছ ধরে আনলি তা দিয়ে চাইল কিনতি হবে। রাতি হয়তো রানতি পারব।’

এসব বিষয়ে ব্র্যাকের জেলা সমন্বয়ক ইদ্রিস আলম বলেন, ‘এই মানুষগুলো যে কী পরিমাণ সংগ্রামী, তা বলে বোঝানো যাবে না। এখনো কিন্তু নদী উত্তাল, এর মাঝে তারা নদীতে নেমে গেছে জীবিকার তাগিদে। এখানে ৭৫০টি পরিবারকে শুকনা খাবার দিয়েছি। এখনো অনেকে পানিবন্দী, তাই তাৎক্ষণিকভাবে মানবিক সহায়তার ব্যবস্থা করছি আমরা।’

জেলায় প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ আক্রান্ত হয়েছে বলে জানান বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক মোহা. খালিদ হোসেন। তিনি বলেন, কৃষি-মৎস্যসহ সব খাতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের জন্য প্রয়োজনীয় সহযোগিতার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।