১৯৮১ সালের ১৭ মে। পরিবারের সবাইকে হারানোর পর শেখ হাসিনা ফিরলেন দেশে | ছবি: আওয়ামী লীগ ওয়েবসাইট 

মঈনুল হক চৌধুরী: বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর ছয় বছর নির্বাসিত কাটিয়ে তার মেয়ে শেখ হাসিনা যেদিন দেশে ফিরলেন, সেদিন কি তিনি নিজেও ভাবতে পেরেছিলেন, জাতির পিতার স্বপ্ন পূরণে বাংলাদেশকে তিনি কতটা এগিয়ে নিতে পারবেন?

অস্থির সেই সময়ে শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করা নজিব আহমেদের ভাষায়, উনি এ জায়গায় একদিনে আসেননি। উনি কোনোদিন নিজের জীবনের মায়া করেননি। উনার কোনো লোভ লালসা দেখিনি। উনার কোনো দিন কোনো ব্যাপারে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল না। মনোবল দৃঢ়, কোনোকিছুকে পরোয়া করতেন না। যত দুর্যোগই হোক, সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।

১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট একদল সেনাসদস্য ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িতে ঢুকে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার পরিবারের অধিকাংশ সদস্যকে হত্যা করে। তার দুই মেয়ে শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা তখন জার্মানিতে।

পরের ছয়টি বছর তাদের ভারতে নির্বাসিত জীবন কাটাতে হয়। সামরিক শাসকের রক্তচক্ষু ও নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ১৯৮১ সালের ১৭ মে মাতৃভূমিতে ফেরেন শেখ হাসিনা; হাল ধরেন আওয়ামী লীগের।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া দলটি তখন নেতাকে হারিয়ে এলোমেলো; সামরিক শাসনের নিষ্পেষণে অনেকে কারাগারে, অনেকে পলাতক।

সেই দলের সভাপতির দায়িত্ব নেওয়র পর দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে আওয়ামী লীগকে সুসংগঠিত করেন শেখ হাসিনা। ১৯৯৬ সালে প্রথম, ২০০৮ সালে দ্বিতীয়, ২০১৪ সালে তৃতীয়, ২০১৮ সালে চতুর্থ এবং ২০২৪ সালে পঞ্চমবারের মত নির্বাচনে জিতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন।

৭৭ বছরের জীবনের ৪৪ বছরই আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন শেখ হাসিনা। বাংলাদেশ সরকারের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাও ২০ বছরের বেশি।

তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে; ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশের কাতারে পৌঁছানোর স্বপ্ন দেখছে।

সেই আশির দশক থেকে দীর্ঘদিন শেখ হাসিনার নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকায় তাকে খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ হয়েছে নজিব আহমেদের। ৬৫ বছর বয়সী নজিবের বাবা ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ফুপাত ভাই।

একান্ত সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন এবং পরবর্তী বন্ধুর সময়ের নানা ঘটনা নিয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন তিনি।

নজিব আহমেদ বলেন, প্রায় সাড়ে চার দশক আগে শেখ হাসিনা যখন দেখে ফিরলেন, আওয়ামী লীগের মধ্যে তখন কোন্দল ছিল, নেতাদের মধ্যে ছিল মান-অভিমান। নেত্রী যখন দেশে ফেরেন, যে কাজটি প্রথম করলেন, আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের খোঁজ নেওয়া শুরু করলেন। দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে দিনরাত পরিশ্রম করে প্রতিটি নেতাকে ডেকে এনে, কোনো কোনো সময় নেতাদের বাড়ি গিয়ে তাদের সাথে বসে, তাদের পরিবারের সাথে বসে, উনার অবস্থান ক্লিয়ার করেন। আজকের জায়গার পৌঁছানোর পেছনে দুটো জিনিস কাজ করে- একটা সততা, নিষ্ঠা। আরেকটা হলো উনার সঠিক সিদ্ধান্ত। সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত উনি দিতে পারছেন। এ কারণে নেতাকর্মীদের উনি ঐক্যবদ্ধ করতে পারছেন। আজকে বাংলাদেশের এ অবস্থায় নিতে পেরেছেন।

নজিব আহমেদ বলেন, উনি একটা কথা প্রায় বলেন, আমি বাংলাদেশের মানুষের কাছে ফিরে গেছি, দেশের মানুষ আমার আপনজন… গৃহবন্দি দশা থেকে মুক্ত হওয়ার পর উড়ির চরে বন্যা (১৯৮৫ সালের ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস বুঝিয়েছেন) হল; উনি সন্তানের কাছে ফিরে গেলেন না। উনি আগে ছুটে গেলেন উড়ির চরে ট্রলারে করে। সেখান থেকে রিলিফ ওয়ার্ক শেষ করে তারপরে উনার ছেলে মেয়ের খোঁজ নিতে গেলেন। নানা ঘাত প্রতিঘাত পার করেছেন আজকের জননেত্রী শেখ হাসিনা। তার উপর আল্লাহর রহমত আছে। মানুষের যে ভালোবাসা উনি পেয়েছেন, মানুষ যে তাকে বিশ্বাস করে, তার প্রতি নেতাকর্মীদের যে আস্থা- সেটা উনি অর্জন করেছেন।

১৯৮১ সালে দেশে ফিরে দলকে সংগঠিত করেন শেখ হাসিনা; ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় ফেরে আওয়ামী লীগ | ছবি: আওয়ামী লীগ ওয়েবসাইট 

শেখ হাসিনা
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বেগম ফজিলাতুননেছা মুজিবের প্রথম সন্তান শেখ হাসিনার জন্ম ১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর গোপালগঞ্জের টুঙ্গীপাড়ায়।

রাজনীতিবিদের ঘরে জন্ম নেওয়া শেখ হাসিনার বেড়ে ওঠা পুরোপুরি রাজনৈতিক আবহে। ষাটের দশকে ইডেন কলেজে ছাত্রলীগের কর্মী হিসেবে তার রাজনৈতিক অঙ্গনে পথচলার শুরু। ১৯৬৬-৬৭ সালে ইডেন কলেজের ছাত্র

সংসদের সহ-সভাপতি (ভিপি) নির্বাচিত হন তিনি। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ছাত্রলীগের রোকেয়া হল শাখার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭৩ সালে স্নাতক ডিগ্রি নেওয়ার আগেই শেখ হাসিনার বিয়ে হয় পরমাণু বিজ্ঞানী এম ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে। তাদের দুই সন্তান সজীব ওয়াজেদ জয় ও সায়মা হোসেন পুতুল।

১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট সেনাবাহিনীর একদল সদস্য যখন সপরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে হত্যা করে, তখন স্বামীর কর্মসূত্রে ইউরোপে ছিলেন শেখ হাসিনা। তার সঙ্গে থাকা ছোট বোন শেখ রেহানাও প্রাণে বেঁচে যান। ওয়াজেদ মিয়া তখন থাকতেন জার্মানিতে, ১৫ অগাস্ট তারা বেলজিয়ামে গিয়েছিলেন বেড়াতে।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর দীর্ঘ সময় দেশে ফিরতে পারেননি শেখ হাসিনা। ১৯৮১ সালের ফেব্রুয়ারিতে তার অনুপস্থিতিতেই আওয়ামী লীগের সম্মেলনে তাকে দলীয় সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। তারপর এখনও সেই পদে রয়েছেন তিনি।

আওয়ামী লীগ সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফিরে দলের দায়িত্ব নেন শেখ হাসিনা।

স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সেই দিন 

সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সেই সময়ের পটভূমি এবং নিজের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছেন নজিব আহমেদ।

তিনি বলেন, তখনকার প্রেক্ষাপটে (বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড) বঙ্গবন্ধুর কেবিনেটের যারা মন্ত্রী, ভাইস প্রেসিডেন্ট, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তারা চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। তারা বুঝে উঠতে পারেননি কী করা উচিত। যদিও বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে তারাই স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন; অথচ সেদিনের একটি এরকম ঘটনায় তারা হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন। কিছু বুঝে ওঠার আগেই বন্দুকের মুখে তাদের বিভিন্নভাবে প্রেশার করে ক্যু করে। তাদের আগেই চক্রান্ত ছিল। কী হয়েছে তখন জাতির সবাই জানেন।

১৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮১: বিদেশে থাকা অবস্থায় শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী নির্বাচিত, সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক

১৭ মে, ১৯৮১: শেখ হাসিনার প্রত্যাবর্তন, আওয়ামী লীগের দায়িত্বভার গ্রহণ

২ অগাস্ট, ১৯৮৩: আওয়ামী লীগ থেকে আব্দুর রাজ্জাক, মহিউদ্দিনসহ ছয়জনকে বহিষ্কার; দুই মাস পর তারা বাকশাল গঠন করেন

শেখ হাসিনার দেশে ফেরার দিন ঢাকা পরিণত হয়েছিল মিছিলের নগরীতে | ছবি: আওয়ামী লীগ ওয়েবসাইট 

নজিব আহমেদ বলেন, প্রেক্ষাপটটা ছিল- আওয়ামী লীগের মধ্যে কোন্দল হল, নেতাদের মধ্যে মান অভিমান ছিল। আব্দুর রাজ্জাক, মালেক উকিল, জোহরা তাজউদ্দীনরা দলকে সুসংগঠিত করতে পারেননি। না করার পরিপ্রেক্ষিতে একমত হতে পারেনি; তারপর দলের কাউন্সিলে ১৯৮১ সালে তৎকালীন হোটেল ইডেনে… যদিও আমি ওই সময় দেশে ছিলাম না, বাগদাদে ছিলাম… জননেত্রী শেখ হাসিনাকে, উনার সম্মতি ছাড়াই আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে কাউন্সিলাররা দলের সভানেত্রী নির্বাচিত করেন। পরে আওয়ামী লীগ নেতাদের একটি প্রতিনিধি দল দিল্লি গিয়ে শেখ হাসিনাকে দলের ভার নিতে রাজি করান। তিনি দেশে ফিরে আসেন। তখন জিয়াউর রহমান ক্ষমতায়। উনাদের পাসপোর্ট ছিল না, তারা নানাভাবে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে। সে বাধা উপেক্ষা করে তিনি (হাসিনা) দেশে ফিরে আসেন।

নজিব আহমেদ বাগদাদ থেকে দেশে ফিরে আসেন ১৫ মে। তার দুদিন পর দেশে ফেরেন শেখ হাসিনা। ঢাকা সেদিন পরিণত হয় মিছিলের নগরীতে। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া আর ঝড়-বৃষ্টিও সেদিন লাখো মানুষের মিছিলকে থামাতে পারেনি।

সেদিনের কথা স্মরণ করে নজিব বলেন, ১৭ মে দেশে ফেরার দিন উনাকে আমি দূর থেকে দেখেছি। শুধু আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাই নয়, সারা দেশ থেকে স্বাধীনতার পক্ষের, যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, সমর্থন করেছেন, তারা সেদিন ঢাকায় ছুটে এসেছিলেন।

প্রথম পদক্ষেপ
দেশে ফেরার পর শেখ হাসিনা কীভাবে দল গোছানোর কাজে হাত দিয়েছিলেন, সেই বর্ণনা পওয়া যায় নজিব আহমেদের কথায়। তার ভাষায়, ১৫ অগাস্টের ব্যর্থতার কারণে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা তখন আত্মগ্লানিতে এক রকম নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছিলেন। আর কিছু হবে না।… আতঙ্ক কাজ করছিল তাদের মাঝে। জিয়াউর রহমান সরকার তাদের বিভিন্নভাবে ভয়ভীতি, জুলুম, জেল, মামলা হামলা করে তাদের দমন পীড়ন করেছে।

ওই পরিস্থিতিতের মধ্যেই কাজে নেমে পড়েন শেখ হাসিনা। নজিব বলেন, যে কাজটি তিনি প্রথম করলেন, আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের খোঁজ নেওয়া শুরু করলেন। কোন জেলার কত নেতা জেলে রয়েছে, কত কী মামলা রয়েছে, তাদের পরিবারে কে কোথায় আছেন- এদের খোঁজ নেওয়া শুরু করলেন। প্রয়োজনে কোনো কোনো নেতার বাড়িতে গেলেন, পরিবারের খোঁজ খবর নিলেন, তাদের জেল থেকে বের করার জন্য মামলা পরিচালনার করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলেন। তারপরে দলকে এভাবেই এগিয়ে নিয়ে গেলেন।

১৯৮১ সালে দেশে ফেরার পর ১৯ মে টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর কবরের পাশে শেখ হাসিনা | ছবি: আওয়ামী লীগ ওয়েবসাইট 

১৯৮১ সালে দেশে ফেরার পর বনানীতে পরিবারের সদস্যদের কবরের পাশে শেখ হাসিনা | ছবি: আওয়ামী লীগ ওয়েবসাইট 

১৭ মে দেশে ফেরার পর শেখ হাসিনা টুঙ্গিপাড়ায় যান ১৯ মে। সেখানেই দাফন করা হয়েছিল তার বাবা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে।

মে মাসের শেষ দিকে নজিব আহমেদের মা মারা যান। তখন তিনি মাদারীপুরে যান। জুনের শুরুতে ঢাকায় এসে শেখ হাসিনার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তাদের সাক্ষাৎ হয় শেখ ফজলুল করিম সেলিমের বাসায়।
 
 ফ্রিডম পার্টির হামলা, স্মৃতিসৌধে যেতে বাধা
নজিব আহমেদ জানান, তখনও আওয়ামী লীগ সভাপতির জন্য সেভাবে নিরাপত্তার আয়োজন গড়ে ওঠেনি। আওয়ামী লীগ, যুবলীগের নেতাকর্মীরাই নিজেদের উদ্যোগে তাদের নেত্রীর নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতেন। এরশাদ সাহেবের আমলে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ফ্রিডম পার্টিকে লালন পালন করা হয়। বায়তুল মোকাররমে শেখ হাসিনার জনসভায় বোমা হামলা করে প্রথম এই ফ্রিডম পার্টি, ১৯৮৪ সালের দিকে। ১৯৮৯ সালের ১১ অগাস্ট ৩২ নম্বরের বাড়িতে হামলা করে তারা, গ্রেনেড হামলা করলেও ফোটেনি।

৩২ নম্বরের সেই ঘটনায় শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত নিরাপত্তারক্ষী হিসেবে নজিবও ছিলেন। তিনি বলেন, বাহাউদ্দিন নাছিম, মানু, মৃণালসহ আমরা অনেকে ছিলাম। সেদিন আমরা প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলাম। আমাদের প্রতিরোধের সামনে তারা (হামলাকারীরা) টিকতে পারেনি, তারা ব্যর্থ হয়েছিল।
আশির দশকে মানিক মিয়া এভিনিউয়ে এক জনসভায় আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা | ছবি: আওয়ামী লীগ ওয়েবসাইট 

তার আগে ১৯৮২ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য সাভারের স্মৃতিসৌধে গিয়ে বাধার মুখে পড়তে হয় আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে।

সেই ঘটনা স্মরণ করে নজিব বলেন, কঠোর মার্শাল ল চলছে। সাভারে তাকে বাধা দেওয়া হয়। এক-দেড় ঘণ্টা পর পথ ছাড়া হয়। অন্যান্য দলের নেতারা ছিলেন, আওয়ামী লীগ নেতারা ছিলেন। খান মজলিশ (সামসুদ্দোহা খান মজলিশ) সাহেবের ওপর দায়িত্ব পড়ে মাইকের ব্যবস্থা করার।

সেখানে শেখ হাসিনা বললেন, আমি শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগ, আমার সাথে দেশের অনেক দলের নেতারা আছে। আমরা এ মার্শাল ল মানি না। আমরা মার্শাল লর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করছি, প্রতিবাদ করছি। দেশের মানুষ একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছে কোনো সামরিক শাসকের জন্য নয়।

বিরোধ মেটাতে কৌশল, ঐক্যবদ্ধ রাখতে উদ্যোগ

সে সময় আওয়ামী লীগের বিভক্তির কথা তুলে ধরে নজিব আহমেদ বলেন, ১৯৭৮-৭৯ সালে মিজানুর রহমান চৌধুরী ও দেওয়ান ফরিদ গাজী আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে যান। তাদের সঙ্গে যোগ দেন অনেকে। মূল দলের নেতৃত্বে তখন মালেক উকিল, আব্দুর রাজ্জাকরা; সেই বড় অংশই শেখ হাসিনাকে আওয়ামী লীগ সভাপতি করে। শেখ হাসিনা যখন এলেন, উনার যত কলিগ ছিলেন, প্রেসিডিয়াম মেম্বার ছিলেন, তারা কিন্তু উনার বাবার রাজনৈতিক সঙ্গী ছিলেন। কাউকে চাচা ডাকতেন, কাউকে ফুফু ডাকতেন, কাউকে চাচি ডাকতেন, কাউকে ভাই বলতেন। তাদের সাথে চলতে গিয়ে তো মত বিরোধ হয়ই। সেখানে আব্দুর রাজ্জাক, মহিউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে একদল দলত্যাগ করে, তারা বাকশাল করে।

নির্বাসন কাটিয়ে দেশে ফিরছেন শেখ হাসিনা। ১৯৮১ সালের ১৭ মের আগে ঢাকায় পড়েছিল এই পোস্টার 

শেখ হাসিনা দেশে ফেরার পর আওয়ামী লীগের মধ্যে ‘রক্তের উত্তরসূরি’ ও ‘আদর্শের উত্তরসূরি’ নিয়ে কথা তুলে ‘বিভাজন সৃষ্টির চেষ্টা’ হয়েছিল, সে কথাও নজিব বলেন। (রাজনৈতিক) দ্বন্দ্ব হয়েছিল। সে দ্বন্দ্ব থেকে আওয়ামী লীগ দ্বিধাবিভক্ত হয়।… যারা রক্তের উত্তরসূরি ও আদর্শের উত্তরসূরি নিয়ে দ্বন্দ্ব করেছিল, চলে গিয়েছিল তারা। কিন্তু রক্তের উত্তরসূরি শেখ হাসিনা ছিলেন। উনি কিন্তু এখন বঙ্গবন্ধুর আদর্শের উত্তরসূরি, শুধু রক্তের উত্তরসূরিই না। এখন কিন্তু আওয়ামী লীগের মধ্যে ওই রকম কিছু (দ্বন্দ্ব) নেই।

নজিব আহমেদ বলেন, উনার রাজনৈতিক (অগ্রযাত্রা) কঠিন ছিল। দিনরাত পরিশ্রম করে প্রতিটি নেতাকে ডেকে এনে, কোনো কোনো সময় নেতাদের বাড়ি গিয়ে তাদের সাথে বসে, তাদের পরিবারের সাথে বসে, উনার অবস্থান ক্লিয়ার করতেন। মালেক উকিল সাহেব চলে যাওয়ার চেষ্টা করলেও মিসেস মালেক উকিলের হস্তক্ষেপে ফেরত আসেন।

তার ভাষায়, শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে যেমন সম্পর্ক রাখতেন, নেতাদের পরিবারের সাথেও সম্পর্ক রাখতেন। এ কারণে উনার জন্য এটা সহজ হয়েছিল। ফিরিয়ে আনতে বেশিদিন লাগেনি।… আওয়ামী লীগ প্রথমবার যখন ভাঙে, তার সপ্তাহ-দশ দিনের মাথায় শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রতি আস্থা রেখে অনেকেই দলে ফিরে আসেন।

তবু যে কারণে নির্বাচনে
এরশাদবিরোধী আন্দোলনের মধ্যে সিদ্ধান্ত পাল্টে আওয়ামী লীগের ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়ে এখনও সমালোচনা করেন বিরোধীরা। কেন সে সময় শেখ হাসিনা ভোটে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, সে বিষয়ে নিজের উপলব্ধির কথা বলেন নজিব আহমেদ।

তিনি বলেন, নির্বাচনে যাওয়ার পেছনে শেখ হাসিনার ‘রাজনৈতিক কৌশল’ ছিল। নেতাকর্মীদের তিনি চাঙ্গা রাখতে চেয়েছিলেন। আওয়ামী লীগ যে একটি গণতান্ত্রিক দল; আন্দোলন সংগ্রামের পাশাপাশি নির্বাচনের মধ্য দিয়েই ক্ষমতায় যাওয়ার চেষ্টা করেছে, তা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন।

নজিব আহমেদ মনে করেন, দলকে সাহস যোগাতেই ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন শেখ হাসিনা | ছবি: আওয়ামী লীগ ওয়েবসাইট 

এরশাদ সেই নির্বাচন কীভাবে করেছিলেন, সেই বিবরণ তুলে ধরে নজিব বলেন, বিশটা গুন্ডা, দশটা হোন্ডা দিয়ে ইলেকশন ঠান্ডা করা যায়- এ নির্বাচন করে জাতির কাছে যেমন দেখিয়েছিলেন, সারা বিশ্বকেও দেখিয়েছিলেন সামরিক শাসকদের নির্বাচন কীভাবে করে। পরবর্তীতে এক-দেড় বছরের মাথায় শেখ হাসিনা সংসদ থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। আমি যেটা উপলব্ধি করেছি, এ নির্বাচনী প্রচার প্রচারণার মধ্য দিয়ে সারাদেশে উনার নেতাকর্মীদের কাছে পৌঁছতে পেরেছেন। নেতাকর্মীদের শক্তি শাহস যুগিয়েছেন। তাদের স্ট্রেংথ ধরে রাখতে পেরেছেন।

২৮ নভেম্বর, ১৯৮৩: ১৫ ও ৭ দলের অবরোধ কর্মসূচিতে দেশজুড়ে উত্তেজনা, শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া গৃহবন্দি

৭ মে, ১৯৮৬: তৃতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণ, সংসদে বিরোধীদলের আসন লাভ, ভোটে অংশ নেওয়া নিয়ে বিতর্কে ১৫ দলে ভাঙন

৩ জানুয়ারি, ১৯৮৭:
শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সভাপতি পদে পুনর্নির্বাচিত, সাধারণ সম্পাদক সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী

৯০ এর দশকের শুরুর দিকে আওয়ামী লীগের এক দলীয় অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা |  ছবি: সিআরআই

সেই সময়ের কথা স্মরণ করে নজিব আহমেদ বলেন, ১৯৮৪ সালে যখন নেত্রী হাউজ অ্যারেস্ট। তখন চার পাঁচ দিন বাচ্চারা স্কুলে যেতে পারল না। ওয়াজেদ সাহেব বিভিন্ন জায়গায় যোগাযোগ করে তাদের স্কুলে যাওয়ার ব্যবস্থা করলেন। কিন্তু বাচ্চারা স্কুলে গিয়ে সাংঘাতিক বিড়ম্বনার মধ্যে পড়ে। একটা রাজনৈতিক পরিবার কতটা নিগৃহীত হতে পারে, তার একটা জ্বলন্ত উদাহরণ। যখন তাদেরকে স্কুলে নিয়ে যেতাম, তখন সাদা পোশাকের পুলিশ স্কুলের ব্যাগ চেক করে মানসিক হয়রানি, মানসিক নির্যাতন করত। আবার যখন স্কুল থেকে ফেরত নিয়ে আসতাম, তখন এভাবে খাড়া করে রেখে ব্যাগ তল্লাশির নামে তাদের উপরে এক ধরনের মানসিক নির্যাতন করা হত।

জয় তখন পঞ্চম শ্রেণিতে, আর পতুল তৃতীয় শ্রেণিতে। ধানমন্ডির স্কলাস্টিকায় তারা পড়ে।

নজিব বলেন, এরকম যখন চলত, উপরের বারান্দা থেকে শেখ হাসিনা মাঝে মাঝে দেখতেন। বারান্দার কাছে দৌড়ে এসে এসে প্রটেস্ট করতেন- ‘স্কুল থেকে আসছে, ওদের ব্যাগ রেখে দেন, ওদের ছেড়ে দেন। ওরা গোসল করবে, খাবে।’ কিন্তু কে কার কথা শোনে। একটা পর্যায়ে শেখ হাসিনা একটা চরম সিদ্ধান্ত নিলেন। উনি গৃহবন্দি থাকা অবস্থায় উনার বোন শেখ রেহানা, উনার (শেখ হাসিনার) হাজবেন্ড ওয়াজেদ মিয়া, আরেকজন লোকের সহযোগিতায় (তার বাচ্চারা ভারতের নৈনিতালে পড়ত) নৈনিতালে একটা মিশনারি স্কুলে, সেখানে তাদের (জয় ও পুতুল) নিয়ে যায়।

নজিব বলেন, আমার মনে হয়, আমার দেখা শেখ হাসিনা যতগুলো সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তার মধ্যে খুব কষ্টের, দুঃখের, ত্যাগের চরম সিদ্ধান্ত ছিল এটা।

২৮ অক্টোবর, ১৯৮৭: এরশাদবিরোধী আন্দোলন এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে ৮ দলীয় জোটনেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ৭ দলীয় জোটনেত্রী খালেদা জিয়ার বৈঠক

১১ নভেম্বর, ১৯৮৭: ঢাকা অবরোধ কর্মসূচি নিয়ে সহিংসতার মধ্যে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া গৃহবন্দি

১৮ নভেম্বর, ১৯৯০: এরশাদবিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে; ক্ষমতা হস্তান্তরে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ৮ দলসহ তিনদলীয় জোটের রূপরেখা প্রকাশ

৪ ডিসেম্বর, ১৯৯০: তিন জোটের আন্দোলনের জয়, ক্ষমতা ছাড়ার ঘোষণা এইচ এম এরশাদের

১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে এইচ এম এরশাদের পতনের পরদিনের পত্রিকা

১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে এইচ এম এরশাদের পতনের পরদিনের পত্রিকা

জেনারেল এরশাদ তার সামরিক শাসনকে বেসামরিক রূপ দেওয়ার চেষ্টায় পূর্বসূরি জেনারেল জিয়ার পথ অনুসরণ করেন। ১৯৮৩ সালের ১ এপ্রিল তিনি ‘ঘরোয়া রাজনীতি’ চর্চার অনুমতি দেন। পরে দেন প্রকাশ্যে রাজনৈতিক চর্চার অনুমতি।

নজিব আহমেদের ভাষায়, ঘরোয়া রাজনীতি নামের ‘আজব’ সেই রাজনৈতিক চর্চার সুযোগটা কাজে লাগিয়েছিলেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। উনি যখনই সুযোগ পেতেন, কোনো সময় আওয়ামী লীগ নেতার উঠানে, কোনো সময় আওয়ামী লীগ অফিসে, কোনো কোনো জায়গায় কমিউনিটি সেন্টারে, সিনেমা হলে; ঘরের মধ্যে বক্তৃতা দেওয়ার সুযোগ ছিল। উনি ওইসব জায়গায় গিয়ে… ভেতরে জায়গা কম থাকলেও বাইরে মাইকের ব্যবস্থা করা হত। মাঠে হাজার হাজার নেতাকর্মী, জনগণ যেত।

ঘরোয়া সভা করতে গিয়েও পুলিশের হাতে নির্যাতিত হতে হত, লাঠিপেটা, টিয়ারশেলের শিকার হতে হত; সেসব কথাও বলেন নজিব।

বার বার আঘাত, মানব ঢাল গড়ে রক্ষা

নজিব আহমেদের কথায় ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রামের লালদীঘি হত্যাকাণ্ডের প্রসঙ্গও আসে।

সেদিন লালদীঘি ময়দানে আওয়ামী লীগের জনসভা ছিল। বেলা ১টার দিকে শেখ হাসিনাকে বহনকারী ট্রাক আদালত ভবনের দিকে আসার সময় গুলিবর্ষণ শুরু হয়। বিভিন্ন সময় এই মামলার সাক্ষীরা আদালতে বলেছেন, ওইদিন পুলিশের গুলিতে মোট ২৪ জন মারা যান।

সেদিনের কথা স্মরণ করে নজিব আহমেদ বলেন, এয়ারপোর্ট থেকে উনার পেছনে লক্ষাধিক লোক হয়ে গেছে। লালদীঘির ময়দানে ঢুকতে যাবে, মাঠে উনাকে ঢুকতে দেবে না। পুলিশ কর্ডন করে রয়েছে।কোতোয়ালি থানা থেকে ব্যারিকেড দিয়ে রাখা হয়েছে। এখানে আসার আগেই উনাকে বিনা উসকানিতে, কোনো ধরনের সতর্কতা, মাইকিং না করেই পুলিশ ঝাঁপিয়ে পড়ল। উনি একটা ট্রাকের মধ্যে ছিলেন। ওই ট্রাকের মধ্যে সামনের দিকে হাত উঁচিয়ে হাজার হাজার নেতাকর্মী, জনগণের হাত নাড়ার জবাব দিচ্ছিলেন। তখন গুলি হয়।

শেখ হাসিনার তখনকার নিরাপত্তা কর্মকর্তা নজিব বলেন, ওই ট্রাকের মধ্যে শ্রমিক লীগ কর্মী নুরুল ইসলাম, শামীম মহিউদ্দিন মারা যান। ওরা গাড়িতে ঝুলছিল। ব্যাপক লোক হতাহত হয়। পুলিশ টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে। টিয়ার শেলে তার দুই হাত পুড়ে গেছে। এরই মধ্যে আমরা আদালত চত্বরে চলে গেলাম। এক ঝাঁক উকিল দেবদূতের মত এসে উনার গাড়ি ঘিরে ধরলেন। তখন আমাদের বহু নেতাকর্মীকে মারধর করে পুলিশ রাস্তায় ফেলে রাখে। সাংবাদিকরা আহত হয়। কেউ বাদ যায়নি।

সেদিনের সেই নৃশংসতায় ‘রাষ্ট্রীয় মদদ’ ছিল মন্তব্য করে তিনি বলেন, পূর্ব নির্ধারিত মিটিং পুলিশ বিনা নোটিসে বন্ধ করে দেয়। কোনো ধরনের বাধা না দিয়ে প্রথমেই তারা গুলিতে গেল। আমি সেই ট্রাকে ছিলাম। শেখ হাসিনাসহ জাতীয় নেতৃবৃন্দ ট্রাকে। ট্রাক লক্ষ্য করে টিয়ার শেল মারে। সেখানে ব্যাপক জনপ্রতিরোধ গড়ে উঠে। সন্ধ্যা পর্যন্ত এখানে পুলিশ, বিডিআর এর গাড়ি পুড়িয়ে দেয়। পরে শেখ হাসিনাকে ঢাকায় ফিরে আসতে বাধ্য করা হয়।

সেসব দিনে শেখ হাসিনা যেখানেই গেছেন, ‘পরিকল্পিতভাবে’ তার ওপর হামলা করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেন নজিব। তিনি বলেন, শেখ হাসিনার ওপর হামলা… কত বলব; নাটোরে, সুধাসদনে, ৩২ নম্বর, কোটালীপাড়ায়, বঙ্গবন্ধু এভিনিউ…। জনগণ যেদিন সচিবালয় ঘেরাও করে, সেদিনও লোক মারা গেছে। সেবার প্রথমবারের মত শেখ হাসিনাকে মানব ঢাল (জাসদ অফিসের নিচে মানববন্ধন করে) দিয়ে আল্লাহর রহমতে রক্ষা করতে পেরেছিলাম আমরা। ১৯৮৪ সালের ২৮ অক্টোবর সম্ভবত, সচিবালয় ঘেরাও, অবস্থান ধর্মঘট ছিল। ওইদিনও সেনাবাহিনী গুলি চালিয়েছিল। সেদিন জনগণ হোম মিনিস্ট্রির দেয়াল ভেঙে ফেলেছিল। একই দিন এ ঘটনার প্রতিবাদে রাজারবাগে গ্রিল ভেঙে ফেলেছিল জনগণ।

১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর শেখ হাসিনার গাড়ির সামনেই ছিলেন নূর হোসেন।

১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনে নূর হোসেনের আত্মদানের দিনটির স্মৃতিও ফিরিয়ে আনেন নজিব। নূর হোসেনের খোলা বুকে আর পিঠে সেদিন লেখা ছিল- ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক’ ও ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’।

নজিব বলেন, নূর হোসেন সেদিন তো শেখ হাসিনার গাড়ির সামনেই ছিল। আমি উনার জিপের পেছনে, উনি সামনে। শেখ হাসিনা তাকে ডেকে মাথায় হাত দিয়ে বলছিলেন, ‘তুমি জামা গায়ে দাও। তোমারে মেরে ফেলবে।’ (নূর হোসেন) বলে, ‘না, আপনি আমাকে দোয়া করে দেন।’ ঠিক তখন বিনা উসকানিতে সেদিন গুলি শুরু হল।

তিনি জানান, শেখ হাসিনার গাড়ি জিরো পয়েন্ট পর হয়ে গোলাপ শাহর মাজার পর্যন্ত যেতেই নূর হোসেনের ওপর গুলি হয়। আমরা দৌড়ে নূর হোসেনকে উদ্ধারে গেলাম। উনি (শেখ হাসিনা) আমাদের নির্দেশ দিলেন ‘মেডিকেলে নিয়ে যা’। তখন আমাদের নেতাকর্মীরা রিকশা করে নিতে গেলে টেনে হিঁচড়ে তারা পুলিশের ভ্যানে ফেলে তাকে নিয়ে গেল। নূর হোসেনের বড় ভাই পরে আওয়ামী লীগ সভাপতির গাড়ি চালক ছিলেন। তাদের পরিবারের পুনর্বাসনে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেন শেখ হাসিনা। দলের পক্ষ থেকেও সহযোগিতা করা হয়।

২০০৪ সালের ২১ অগাস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে শেখ হাসিনার ভাষণ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় গ্রেনেড হামলা | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

সবশেষ ২০০৪ সালের ২১ অগাস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে ভয়ংকর সেই গ্রেনেড হামলার প্রসঙ্গও আসে নজিব আহমেদের কথায়। সেদিনের হামলা আর মানব ঢাল তৈরি করে শেখ হাসিনাকে রক্ষার ঘটনাগুলো এখনও তার স্মৃতিতে জ্বলজ্বলে। সে দৃশ্য ভুলবার নয়। বালির বস্তা দিয়ে যেভাবে বাংকার করা হয়, সেদিন আমরা নিজেদের শরীর দিয়ে মানববর্ম তৈরি করেছিলাম। তখন তো বালির বস্তা পাওয়া যায়নি। আমরাই মনে করেছিলাম, নিজেরা বালির বস্তা। যা হবে আমাদের ওপর দিয়ে যাবে। উনাকে আল্লাহ যাতে রক্ষা করেন।আল্লাহই রক্ষা করেছেন। আমরা কম বেশি আহত হয়েছি। আমাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব আল্লাহর রহমতে উনাকে উঠিয়ে নিয়ে নিরাপদে সরে আসতে পেরেছি।

‘মানুষের জন্য’

কেবল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন নয়, দুর্যোগে-দুর্বিপাকে শেখ হাসিনা যেভাবে মানুষের পাশে থাকার ব্রত নিয়ে এগিয়ে গেছেন, সেসব ঘটনাও বলেন নজিব আহমেদ। চর জব্বার, নোয়াখালী, হাতিয়া, টেকনাফ, মনপুরা- শেখ হাসিনা সেখানে চলে গেছেন। অনেক সময় আমরা বলেছি- আমাদের তো সামর্থ্য খুবই কম। আমরা কী নিয়ে যাচ্ছি? আমরা কতটুকু কী করতে পারছি? উনি বলতেন- যা পেয়েছ, আশপাশের এলাকা থেকে খাবার কিনে ট্রাকে করে নিয়ে তুমি যাও। তোমরা আগে চলে যাও। অনেক সময় পুরনো কাপড় চোপড় ট্রাকে ভরে উনি পাঠাতেন। উনার একটা যুক্তি ছিল- ‘কী দিতে পারলাম, কী পারলাম না- এটা বড় কথা নয়। আমি যে তাদের পাশে আছি, এটাই বড় কথা।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তার বড় মেয়ে শেখ হাসিনা

নজিব আহমেদের বিশ্বাস, মানুষের ভালোবাসা অর্জন করতে পেরেছেন বলেই বহু বিপদ কাটিয়ে শেখ হাসিনা এ অবস্থানে পৌঁছাতে পেরেছেন। তখন বয়স কত, আর আজ বয়স কত? নানা ঘাত প্রতিঘাত পার হয়ে আজকে…উনার উপর রহমত আছে। মানুষের যে ভালোবাসা উনি পেয়েছেন, মানুষ যে তাকে বিশ্বাস করে, নেতাকর্মীদের তার প্রতি যে আস্থা, সেটা উনি অর্জন করেছেন। উনি এ জায়গায় এক দিনে আসেননি। উনি (শেখ হাসিনা) একটা জিনিসে প্রাউড ফিল করেন, অহংকার করেন, সেটা হল উনি বঙ্গবন্ধুর কন্যা। উনি এবং উনার বোন শেখ রেহানা।… দুই বোনের একমাত্র সম্বল, ঠিকানা, বঙ্গবন্ধুর বাড়ি তারা মানুষের জন্য ট্রাস্ট করে বিলিয়ে দিয়েছেন। তারা কোনোদিন নিজেদের জন্য কিছু করেননি।

নজিব আহমেদ মনে করেন- কোনো মানুষ যদি লোভ, লালসা, চোখ রাঙানি এবং সর্বোপরি মৃত্যুর উপর উঠতে পারে, আর কোনো ভয় থাকে না; শেখ হাসিনার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। সংকটে উনি সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। এ কারণে আজকে বাংলাদেশের এ অবস্থায় নিতে পেরেছেন, দলকে নিতে পেরেছেন, দেলের নেতাকর্মীদের নিতে পেরেছেন।