নিজস্ব প্রতিবেদক: দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও মূল্যস্ফীতির চাপে দিশাহারা মানুষ। এর মধ্যেই জনগণের ব্যয়ের বোঝা আরও বাড়াবে ঢাকা ওয়াসা কর্তৃপক্ষ। সংস্থাটি এক লাফে পানির দাম ১০ শতাংশ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আগামী ১ জুলাই থেকে পানির এই নতুন দাম কার্যকর হবে। 

বুধবার কয়েকটি পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে পানির দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেয় ঢাকা ওয়াসা কর্তৃপক্ষ। তবে এই পানির দাম বাড়ানোর বিষয়ে যথাযথ প্রক্রিয়া মানা হয়নি বলে প্রশ্ন উঠেছে। ওয়াসা বোর্ডের একাধিক সদস্য জানিয়েছেন, পানির দাম ১০ শতাংশ বাড়ানোর বিষয়ে তাঁরা অবগত নন। ওয়াসা কর্তৃপক্ষ এই বিষয়ে বোর্ডের সঙ্গে আলোচনা করেনি। 

বিজ্ঞপ্তিতে ওয়াসা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, আবাসিক গ্রাহকদের জন্য প্রতি ১ হাজার লিটার পানির দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১৬ টাকা ৭০ পয়সা, যা এখন আছে ১৫ টাকা ১৮ পয়সা। আর বাণিজ্যিক গ্রাহকদের জন্য একই পরিমাণ পানির দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৪৬ টাকা ২০ পয়সা, যা বর্তমানে আছে ৪২ টাকা। ওয়াসা আইন ১৯৯৬-এর ২২ ধারা অনুযায়ী, মূল্যস্ফীতি সমন্বয়ের লক্ষ্যে পানির দাম বাড়ানো হয়েছে।

■ পানির দাম এক লাফে ১০ শতাংশ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত। 

■ আগামী ১ জুলাই থেকে এই নতুন দাম কার্যকর হবে।

■ এই বিষয়ে বোর্ডে আলোচনা হয়নি।

পানির দাম বাড়ানো বিষয়ে ঢাকা ওয়াসার বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপক উত্তম কুমার রায় বলেন, ২০২১ সালের পর পানির দাম সমন্বয় হয়নি। ঢাকা ওয়াসা কর্তৃপক্ষ পানির দাম সমন্বয়ের জন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে একাধিকবার চিঠি দিয়েছে। ওয়াসা কর্তৃপক্ষ যতটুকু চেয়েছিল, মন্ত্রণালয় তার চেয়ে অনেক কম বাড়িয়েছে। 

এবার নিয়ে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ১৬ বছরে ঢাকা ওয়াসার পানির দাম বাড়ল ১৬ বার। এর আগে করোনাকালে ঢাকা ওয়াসা দুই বছরে দুবার আবাসিক ও বাণিজ্যিক পর্যায়ে পানির দাম বাড়িয়েছিল। সবশেষ ২০২১ সালের জুলাইয়ে ঢাকা ওয়াসা পানির দাম বাড়িয়েছিল।

আইন অনুযায়ী, প্রতিবছর ৫ শতাংশ হারে পানির দাম বাড়াতে পারে ঢাকা ওয়াসা ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ। এ ক্ষেত্রে ওয়াসা বোর্ডের অনুমোদন নিতে হয়। আর ৫ শতাংশের বেশি বৃদ্ধি করতে চাইলে নিতে হয় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন। এবার ১০ শতাংশ পানির দাম বাড়ানোর বিষয়টি নিয়ে ঢাকা ওয়াসা বোর্ডে আলোচনা হয়নি বলে জানিয়েছেন দুজন বোর্ড সদস্য। 

ঢাকা ওয়াসার বোর্ড সদস্য ও বিএফইউজে—বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের মহাসচিব দীপ আজাদ বলেন, ‘পানির দাম বাড়ানোর বিষয়ে বোর্ডের সভায় আলোচনা হয়নি। বোর্ডের সঙ্গে আলোচনা ছাড়া কীভাবে ১০ শতাংশ দাম বাড়ানো হয়েছে, বিষয়টি আমার জানা নেই। এটি কোন প্রক্রিয়ায় হয়েছে, এটার ব্যাখ্যা আমি পাইনি। পরবর্তী বোর্ড সভায় এটি জানতে চাইব।’

২০২২ সালেও পানির দাম বাড়াতে চেয়েছিল ঢাকা ওয়াসা। কিন্তু তখন ওয়াসা কর্তৃক পানির দাম বাড়ানোর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট হয়। বিধি প্রণয়ন না করে ওয়াসার পানির মূল্যবৃদ্ধি কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল দেন হাইকোর্ট। এরপর এত দিন পানির দাম বাড়ানো নিয়ে সেভাবে আলোচনা হয়নি।

এর আগে পানির দাম বাড়ানোর বিষয়ে মন্ত্রণালয়ে দেওয়া চিঠিতে ওয়াসা কর্তৃপক্ষ জানায়, সংস্থাটির পরিচালনা ব্যয় এবং বৈদেশিক ঋণের কিস্তি (ডিএসএল) পরিশোধের টাকার পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমান পানির দামে ওয়াসার পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ এবং ডিএসএল পরিশোধ দুরূহ হয়ে পড়েছে। ঋণের টাকা পরিশোধ এবং ব্যয়ভার বহন করতে পানির বিশেষ মূল্যবৃদ্ধি প্রয়োজন।

মূলত ঢাকা ওয়াসার প্রকল্প বাস্তবায়নের ধীর গতির কারণে সংস্থাটির ব্যয় বাড়ছে। সংস্থাটির অধিকাংশ প্রকল্প বৈদেশিক ঋণের টাকায় করা হচ্ছে। বিপুল ঋণ নিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নের কারণে ঢাকা ওয়াসাকে ঋণের সুদ ও আসলের কিস্তি পরিশোধে বড় অঙ্কের অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। বর্তমানে বিভিন্ন প্রকল্পে ঢাকা ওয়াসার বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ প্রায় ১৯ হাজার কোটি টাকা।

এ ছাড়া ঢাকা ওয়াসা দৈনিক যত পানি উৎপাদন করে, তার ২০ শতাংশের বেশি গ্রাহক পর্যন্ত পৌঁছায় না। কাগজে-কলমে ওয়াসার এই সিস্টেম লসের (কারিগরি অপচয়) আর্থিক পরিমাণ ২৮০ কোটি টাকার বেশি। শুধু এ অপচয় কমাতে পারলেই বছর বছর ওয়াসাকে পানির দাম বাড়াতে হতো না। 

পানির দাম বাড়িয়ে ঢাকা ওয়াসা কর্তৃপক্ষ নিজেদের অব্যবস্থাপনা ও অনিয়মের দায় জনগণের ঘাড়ে চাপাতে চাইছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। নগরবিদদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, বিদেশি ঋণের টাকায় নেওয়া এসব প্রকল্পের সুফল জনগণ কতটা পাচ্ছে, সেটি নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। ওয়াসার অদক্ষতার দায় জনগণকে কেন টানতে হবে? জবাবদিহি না থাকায় ওয়াসা কর্তৃপক্ষ অন্যায্যভাবে পানির দাম বাড়িয়েছে।