তদন্ত শেষ, তবু সিআইডিতে আটকে আছে ২০০০ মামলা

মামলা | প্রতীকী ছবি

নজরুল ইসলাম: রাজধানীর মিরপুরে নাজমুল হাসান নামের এক যুবক ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার করে পূর্বপরিচিত এক তরুণীর ব্যক্তিগত ছবি ও ভিডিও ধারণ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচার করে তাঁকে সামাজিকভাবে হেয় করেন। ওই ঘটনায় মিরপুর থানায় মামলা করেন ওই তরুণী। তিন বছরের বেশি সময় তদন্ত করে অভিযোগের সত্যতা পান তদন্ত কর্মকর্তা। অভিযোগপত্র দেওয়ার অনুমতি চেয়ে মালিবাগে সিআইডির প্রধান কার্যালয়ে সাক্ষ্য স্মারকলিপি (এমই) পাঠান তিনি। কিন্তু এমইতে সিআইডিপ্রধান স্বাক্ষর না করায় অভিযোগপত্র দিতে পারছেন না তদন্ত কর্মকর্তা।

চার বছর আগের আরেকটি মামলার অভিযোগপত্রও একই কারণে আটকে আছে বলে জানা গেছে। রাজধানীর দক্ষিণখানের সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিনের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ওই মামলা করেছিলেন ব্যবসায়ী শহীদ খান। মামলাটির অভিযোগপত্র দেওয়ার অনুমতি চেয়ে তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির প্রধান কার্যালয়ে সাক্ষ্য স্মারকলিপি জমা দেন। কিন্তু সিআইডিপ্রধান সই না করায় আদালতে অভিযোগপত্রও জমা দিতে দেরি হচ্ছে।

সিআইডির সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে গত ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত যে হিসাব পাওয়া গেছে, তাতে ওই দুই মামলাসহ সারা দেশের দুই হাজারের বেশি মামলার অভিযোগপত্র আটকে আছে। ফলে বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন ভুক্তভোগীরা।

 এ বিষয়ে সিআইডির একজন উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মামলার অভিযোগপত্র আটকে থাকায় দীর্ঘদিন ধরে মানুষ বিচার পাচ্ছেন না। এর সুবিধা নিয়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের কেউ কেউ জামিন নিয়ে বিদেশে পালিয়ে যাচ্ছেন। এতে ভুক্তভোগীরা পুলিশের ওপর আস্থা হারাচ্ছেন। অভিযোগপত্রের দীর্ঘসূত্রতার কারণে আদালতও মামলার বিচার কার্যক্রম শুরু করতে পারছেন না।

মামলার অভিযোগপত্র জমা দিতে দেরি হওয়ায় আদালত অন্তত চারজন তদন্ত কর্মকর্তাকে এক মাস করে বেতন স্থগিত রাখতে সিআইডি কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছেন বলে সিআইডির একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে।
যা বললেন সিআইডির সাবেক-বর্তমান কর্মকর্তারা

সাধারণত স্পর্শকাতর ও আলোচিত অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড এবং থানা-পুলিশ যেসব মামলার কিনারা করতে পারে না, তেমন মামলাই পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি) তদন্তের জন্য দেওয়া হয়। এ ছাড়া মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের মামলাগুলো শুধু সিআইডি তদন্ত করে থাকে।

সিআইডি সূত্র জানায়, প্রতি মাসে সারা দেশ থেকে থানায় এবং আদালতে দায়ের হওয়া কয়েক হাজার মামলা তদন্তের জন্য ঢাকায় সিআইডির প্রধান কার্যালয়ে পাঠানো হয়। এগুলো জমা না রেখে আগের সিআইডিপ্রধানেরা অভিযোগপত্র বা চূড়ান্ত প্রতিবেদনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিতেন। এর মধ্যে থানা থেকে আসা মামলাগুলোর তদন্ত শেষে সাক্ষ্য স্মারকলিপি (এমই) সিআইডিপ্রধানের কাছে পাঠানো হতো। তিনি সই করলে তদন্ত কর্মকর্তারা আদালতে অভিযোগপত্র দিতেন। আর আদালতের মামলাগুলো পদস্থ কর্মকর্তারা এমই সইয়ের মাধ্যমে অভিযোগপত্র দিতে অনুমতি দিতেন। ফলে মামলার এত জট সৃষ্টি হতো না।

বর্তমানে পুলিশের অন্য একটি ইউনিটে কর্মরত একজন ডিআইজি আগে সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (এসএস) ছিলেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এমই আটকে দেওয়ায় সিআইডিতে এখন মামলার পাহাড় জমেছে। তিনি যখন বিশেষ পুলিশ সুপার ছিলেন, তখন মামলার এমই আটকে রাখা হতো না। তদন্ত শেষে মামলাটি তদন্ত তদারক কর্মকর্তার হাত ঘুরে এমই সিআইডিপ্রধানের কাছে নেওয়া হলে তিনি তাতে অভিযোগপত্র বা চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য সম্মতি দিতেন।

কিন্তু বর্তমান সিআইডিপ্রধানের টেবিলে যাওয়ার পর মামলাগুলো আটকে যাচ্ছে বলে জানান একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা। তিনি বলেন, ‘সিআইডিপ্রধানের মূল কাজ হলো মামলা নিষ্পত্তি করা ও দ্রুত তদন্ত শেষ করার নির্দেশ দেওয়া। তিনি সিদ্ধান্ত দিলেই মামলার বিষয়ে আর ঝামেলা থাকে না। আর আদালতে দায়ের করা মামলাগুলোর সিদ্ধান্তের জন্য সিআইডির কোনো ডিআইজিকে দায়িত্ব দিতে পারতেন। কিন্তু সেটা করা হচ্ছে না, আবার নিজেও দ্রুত সিদ্ধান্ত দিতে পারছেন না।’

এ বিষয়ে সিআইডির প্রধান কার্যালয়ে গতকাল রোববার সিআইডিপ্রধান পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মোহাম্মদ আলী মিয়ার সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। তিনি দাবি করেন, তাঁর কারণে মামলা আটকে আছে, ঠিক নয়। গত শুক্রবারও তিনি মামলার এমইতে সই করেছেন। ওই দিন পর্যন্ত ৮৯৭টি মামলার এমই স্বাক্ষরের অপেক্ষায় ছিল।

ঢাকা মহানগর পুলিশের সাবেক কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম ২০১৯ সালের ১৮ মে থেকে ওই বছরের ১২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সিআইডিপ্রধানের দায়িত্বে ছিলেন। বর্তমানে তিনি সরকারি কর্মকমিশনের সদস্য। তাঁর সঙ্গে সম্প্রতি প্রথম আলোর কথা হয়। তিনি বলেন, সিআইডিপ্রধানের পক্ষে হাজার হাজার মামলা দেখা সম্ভব হয় না। মূলত তদন্ত তদারক কর্মকর্তা হিসেবে বিশেষ পুলিশ সুপার মামলার বিষয়ে যে মতামত দেন, সিআইডিপ্রধান সেভাবে সিদ্ধান্ত নেন।

মোহা. শফিকুল ইসলাম বলেন, মূলত সংশ্লিষ্ট বিশেষ পুলিশ সুপারই নথিপত্র দেখেন, তদন্ত কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেন। বিধিতে আছে, সিআইডিপ্রধান চূড়ান্ত মতামত দেবেন। সেই অনুযায়ী সিআইডিপ্রধানের চূড়ান্ত মতামতের পর অভিযোগপত্র বা চূড়ান্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা হয়। এর বাইরে জেলা পর্যায়ে মামলাগুলোর নিষ্পত্তিতে চূড়ান্ত মতামত দেন সংশ্লিষ্ট পুলিশ সুপার। আর মহানগরে সেই কাজটা করেন উপকমিশনাররা।

মিরপুর থানায় হওয়া ওই মামলাটির বাদী বলেন, একজন প্রতারক তাঁর ব্যক্তিগত ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার করে তাঁকে সামাজিকভাবে ভয়ানক ক্ষতির মুখে ফেলেছেন। চার বছরেও এর বিচার হলো না, এটা কেমন কথা?