বারঘরিয়ার সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠন হৃথিবী রথের পাঠচক্রে সিয়াম আলী (দ্বিতীয় সারিতে সাদা–কালো টিশার্ট পরা)। সম্প্রতি মহানন্দা নদীর তীরে বারঘরিয়া নন্দন পার্কে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

প্রতিনিধি চাঁপাইনবাবগঞ্জ: কারিগরি শিক্ষা বোর্ড থেকে এসএসসি পাসের পর আয়রোজগারের জন্য রাজমিস্ত্রির কাজ শুরু করেন সিয়াম। ভালো ফুটবল ও ক্রিকেট খেলোয়াড় হিসেবে এলাকায় সুনাম ছিল। এর মধ্যে ১৮৫ গ্রাম গাঁজাসহ পাশের এলাকার নাসির উদ্দিনের সঙ্গে র‍্যাবের হাতে ধরা পড়েন সিয়াম। এরপর কেটে গেছে প্রায় আট মাস। দীর্ঘ শুনানি শেষে অপরাধ স্বীকারের পর শোধরানোর জন্য ‘বিশেষ শর্তে’ তাঁদের মুক্তি দিয়েছেন আদালত।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের জ্যেষ্ঠ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. হুমায়ূন কবীর সম্প্রতি এক রায়ে তাঁদের বিশেষ শর্তে মুক্তি দেন। শর্তানুযায়ী তাঁদের ৫০টি গাছ লাগিয়ে পরিচর্যা করতে হবে। কাজটি ঠিকমতো করতে পারলে এক মাস পর তাঁদের মামলা থেকে অব্যাহতি দেবেন আদালত।

‘ভুল’ শোধরানোর এই সুযোগ কাজে লাগাতে চান কারামুক্ত হওয়া চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার বারঘরিয়া ইউনিয়নের বারঘরিয়া বিশ্বাসপাড়ার বাসিন্দা নাসির উদ্দীন ও বারঘরিয়া জামাদারপাড়া এলাকার বাসিন্দা সিয়াম আলী।

সম্প্রতি বারঘরিয়া জামাদারপাড়া এলাকায় সিয়ামের বাড়িতে গিয়ে জানা যায়, সিয়াম বাড়িতে নেই। বারঘরিয়া নন্দন পার্কের মাঠে ক্রিকেট খেলতে গেছেন। বাবা প্রবাসী শ্রমিক। মা সীমা বেগম (৩৮) বাড়িতে ডেকে নিয়ে চেয়ার এগিয়ে দিলেন। নিজে বসেন মেঝেতে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘রোজ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করতাম, আল্লাহ যেন ছেলেকে বিপদমুক্ত করেন। আল্লাহ আমার দোয়া কবুল করেছেন। আদালতের মাধ্যমে ছেলেকে শোধরানোর এমন রায় দিয়েছেন। আমরা ভাবতেই পারিনি এভাবে ছেলে জেল থেকে মুক্ত হবে।’

সীমা বেগম বলেন, ‘ছেলে যেন ভালোভাবে কাজটা (বৃক্ষরোপণ ও পরিচর্যা) করে, সেটার তদারকি আমি নিজেই করব। আদালতের আদেশের কাগজ পাওয়ার অপেক্ষায় আছি। বিদেশে থেকে ওর বাবা দারুণ দুশ্চিন্তার সময় কাটাতেন। রায়ের খবর শুনে তাঁর জীবনে স্বস্তি ফিরে এসেছে।’ তিনি বলেন, ‘ছেলে কতখানি দায়ী আল্লাহ ভালো জানেন। সমাজ খারাপ হয়ে গেছে। যাঁরা সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি, সমাজ পরিচালনা করেন, তাঁরা দূষিত হয়ে গেছে। বারঘরিয়া এলাকায় মাদকের ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে।’ ছেলেকে মাদকের ছোবল থেকে বাঁচাতে দ্রুত বিদেশে পাঠিয়ে দিতে চান তিনি।

ছেলে বাড়ি ফিরলে মুঠোফোনে কল করার অনুরোধ জানিয়ে বারঘরিয়া নন্দন পার্কের মাঠে যান এই প্রতিবেদন। সেখানে গিয়ে জানা গেল, ক্রিকেট খেলে বাড়িতে চলে গেছেন সিয়াম। পার্কের বেঞ্চে চলছিল স্থানীয় সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘হৃথিবী রথ’-এর উদ্যোগে পাঠচক্র।

কবি সুকান্তের শ্রেষ্ঠ কবিতা আবৃত্তি করছিলেন স্কুলশিক্ষক আয়েস উদ্দীন। আসরে যোগ দিয়ে জানা গেল, সিয়াম সম্পর্কে তাঁর নাতি। বললেন, ছোটবেলায় তাঁকে ও তাঁর মাকে পড়িয়েছেন। সিয়ামের ঘটনায় আদালতের এমন চমকপ্রদ রায়ে তিনি খুশি।

কিছুক্ষণ পর মায়ের মুঠোফোন নম্বর থেকে এ প্রতিবেদককে কল দেন সিয়াম। দেখা করতে বলতেই কিছুক্ষণের মধ্যে নন্দন পার্কে পাকুড়তলায় এসে হাজির হন। শিক্ষক আয়েস উদ্দীনকে দেখে একটু লজ্জিত হন।

কিছুটা দূরে পাকুড়তলায় দাঁড়িয়ে আদালতের রায় নিয়ে সিয়াম বলেন, ‘জীবনে এত সুন্দর সুযোগ পাব স্বপ্নেও ভাবিনি। আমি সুন্দরভাবেই আদালতের আদেশ বাস্তবায়ন করব। প্রস্তুতিও নিতে শুরু করেছি। এই সুযোগে নিজেকে শুধরে নেব। আদালতের বিচারক হুমায়ুন কবীরের প্রতি কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।’

কথা শেষে ফেরার পথে সিয়ামকে ডেকে পাঠচক্রের আসরে বসান আয়েস উদ্দীন। বই থেকে সুকান্তের ১৮ বছর বয়স কবিতাটি সিয়ামকে পাঠ করে শোনান তিনি। প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে সিয়াম বলেন, ‘আমার বয়স ১৯ বলা হলেও আসলে তা নয়, আমি আঠারো প্লাস। সুকান্তের নাম শুনেছি। কোনো কবিতা পড়িনি। আজ প্রথম শুনলাম। ভালো লাগল।’ পাঠচক্রে উপস্থিত হৃথিবী রথের আহ্বায়ক কবি ও গল্পকার আনিফ রুবেদ তাঁকে (সিয়াম) বই পড়ার আসরে আমন্ত্রণ জানালে সিয়াম সম্মতি দেন।

আনিফ রুবেদ বলেন, ‘এখন থেকে হৃথিবী রথের পাঠচক্র ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে সিয়ামকে যুক্ত করে নেব। আশা করি সিয়াম ভালো ছেলে হিসেবে সমাজ আলোকিত করবে। এলাকা ভালো রাখার দায়িত্ব আমাদের ওপরও বর্তায়। যদিও নানা সীমাবদ্ধতায় আমরা ব্যর্থ হচ্ছি।’

মাদক মামলায় কারাভোগ করা আরেক আসামি নাসির উদ্দীন বলেন, ‘এমন সুযোগ পাব আশা করিনি। আদালতের এই রায়ের মর্যাদা রাখব। নিজেকে শুধরে নেব। আদালতের লিখিত আদেশ হাতে পাওয়ার পর থেকেই কাজে নেমে পড়ব।’ এ সময় নাসির উদ্দীনের স্ত্রী ও চাচি আদালতের রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন।