ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি | ফাইল ছবি: এএনআই
পদ্মা ট্রিবিউন ডেস্ক: পাঁচ বছর ধরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অবিরাম প্রচার, সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ খারিজ করে তাঁরা প্রকৃত অর্থে কাশ্মীরের ভারতভুক্তি ঘটিয়েছেন। নিত্য উপদ্রব ও অনিশ্চয়তার অবসান ঘটিয়ে ভূস্বর্গকে ঝলমলে করে তুলেছেন। শান্তি স্থাপন করেছেন। অথচ লোকসভার এই ভোটে সেই কাশ্মীরের তিন আসনে ভারতের শাসক দল বিজেপি একজনকেও প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করাল না! প্রধানমন্ত্রীও সারা দেশ চষে ফেললেও একবারের জন্যও প্রয়োজন বোধ করলেন না ‘শান্তির নিকেতন’ কাশ্মীর উপত্যকায় প্রচারে যাওয়ার।
উপত্যকার বিরোধী রাজনীতিকদের প্রশ্ন, এত উন্নয়নের দাবিদার যাঁরা, মানুষের এত উপকার যাঁরা করেছেন, সেবা করছেন, কেন তাঁরা তিন আসনে একজনকেও দাঁড় করালেন না? তবে কি তাঁরাও বুঝে গেছেন বাস্তব পরিস্থিতির সঙ্গে সরকারি প্রচারের ফারাক বিস্তর?
জম্মু-কাশ্মীরে লোকসভার মোট আসন ছিল ছয়টি। এর মধ্যে জম্মুতে দুটি আসন, কাশ্মীর উপত্যকায় তিনটি। আর একটি আসন ছিল লাদাখে। রাজ্য দ্বিখণ্ডিত হওয়ার পর লাদাখ আর জম্মু-কাশ্মীরের অঙ্গ নয়। জম্মু ও লাদাখে বিজেপি প্রার্থী দিলেও কাশ্মীর উপত্যকার তিন আসন ত্যাগ করায় সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ন্যাশনাল কনফারেন্স (এনসি) নেতা ওমর আবদুল্লাহ সম্প্রতি বলেছেন, ‘এর মধ্য দিয়েই প্রমাণিত উপত্যকায় বিজেপি কোথায় দাঁড়িয়ে আছে।’
বিজেপি অবশ্য এই সমালোচনা গায়ে মাখছে না। তাদের প্রদেশ সভাপতি রবীন্দ্র রায়না সমালোচনার জবাবে বলেছেন, ‘দল ঠিকই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বড় লক্ষ্যে পৌঁছাতে গেলে কখনো কখনো ছোটখাটো স্বার্থ ত্যাগ করতে হয়।’ তিনি অবশ্য মনে করিয়ে দিতে ভোলেননি যে কাশ্মীর উপত্যকায় বিজেপি ‘দেশপ্রেমিক’ দল ও তাদের প্রার্থীকে সমর্থন করবে।
কংগ্রেসের প্রদেশ সভাপতি ভিকার রসুল ওয়ানি অবশ্য ওই যুক্তি উড়িয়ে বলেছেন, ‘এই অবান্তর কথার কোনো মানেই হয় না। উপত্যকায় বিজেপির না আছে সমর্থক, না আছে দল, না আছে একজনও এজেন্ট। নির্বাচন তো হাওয়ায় লড়া যায় না।’
উপত্যকার প্রধান তিন প্রতিষ্ঠিত দলের প্রত্যেকেই বিজেপিবিরোধী হলেও এনসি, পিডিপি ও কংগ্রেস জোটবদ্ধ হয়ে সম্মিলিত ‘ইন্ডিয়া’ প্রার্থী দিতে পারেনি। এনসি ও কংগ্রেস জোট বেঁধেছে, পিডিপি আলাদা লড়ছে। এই তিন দলের বাইরে রয়েছে সিপিএম, উপত্যকার কিছু এলাকায় যাদের সংগঠন রয়েছে।
পুরোনো দলের মধ্যে রয়েছে সাজ্জাদ লোনের দল পিপলস কনফারেন্স। ২০১৯ সালে ৩৭০ অনুচ্ছেদ খারিজ করার পর বিজেপি সাবেক কংগ্রেস ও পিডিপি নেতা আলতাফ বুখারিকে মদদ দিয়ে ২০২০ সালে তৈরি করে ‘জম্মু-কাশ্মীর আপনি পার্টি’। কংগ্রেস ভেঙে গুলাম নবী আজাদ বেরিয়ে গেলে বিজেপি তাঁকেও নতুন দল গড়তে উৎসাহিত করে। শেষ পর্যন্ত তিনিও গড়ে তোলেন ‘ডেমোক্রেটিক প্রোগ্রেসিভ আজাদ পার্টি’। বিজেপির দৃষ্টিতে আজাদ, লোন ও বুখারির দল ‘দেশপ্রেমিক’। উপত্যকায় এসব দলকে সমর্থন দেওয়ার কথা বলেছেন বিজেপি সভাপতি। যদিও তিন আসনেই লড়াই প্রধানত এনসি-কংগ্রেস জোটের সঙ্গে পিডিপির। পিডিপি সভাপতি মেহবুবা মুফতি প্রার্থী হয়েছেন অনন্তনাগ-রাজৌরি কেন্দ্রে। ৭ মে এই কেন্দ্রে ভোট হওয়ার কথা ছিল। খারাপ আবহাওয়ার দরুন তা পিছিয়ে হবে ২৫ মে।
অনন্তনাগ-রাজৌরি ছাড়া উপত্যকার অন্য দুই কেন্দ্র হলো বারামুল্লা ও শ্রীনগর। তিন আসনেই জোট প্রার্থীদের সম্ভাবনা প্রবল মনে করা হচ্ছে। যদিও বিজেপির উদ্যোগে কেন্দ্রের সীমানা পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে। এতে রাজৌরির হিন্দুপ্রধানসহ কিছু এলাকা ঢুকে গেছে অনন্তনাগের মধ্যে। ওই এলাকায় কংগ্রেসে থাকাকালীন গুলাম নবী আজাদের কিছু সমর্থন ছিল। এখন দেখার, আজাদ, লোন বা বুখারির কাঁধে ভর দিয়ে বিজেপি উপত্যকার কোনো একটি আসন জিততে পারে কি না।
জম্মুর দুটি আসন উধমপুর ও জম্মুতে বরাবর লড়াই হয়ে এসেছে কংগ্রেসের সঙ্গে বিজেপির। হিন্দুপ্রধান এই দুই লোকসভা কেন্দ্রের কিছু এলাকায় বহুকাল ধরেই এনসির সমর্থন আছে। কিছু এলাকায় সমর্থন আছে পিডিপিরও। বিজেপি নেতা ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জিতেন্দ্র সিং এবারেও উধমপুর থেকে প্রার্থী হয়েছেন। জম্মুতে দাঁড়িয়েছেন যুগল কিশোর। দুই কেন্দ্রেই ভোট হয়ে গেছে যথাক্রমে ১৯ ও ২৬ এপ্রিল। উধমপুরে জিতেন্দ্র সিংকে জোর টক্কর দিয়েছেন ‘ইন্ডিয়ার’ হয়ে কংগ্রেসের দুবারের জয়ী নেতা লাল সিং। জম্মুতে প্রার্থী হয়েছেন ওই দলেরই রমন ভাল্লা।
লাদাখের আসন দখলে ছিল বিজেপির। কিন্তু সেখানকার সংসদ সদস্য জামিয়াং শেরিং নামগিয়াল গলওয়ানকাণ্ডের পর বিজেপির দাবির বিরুদ্ধে নানাভাবে সরব হন। সংসদেও তিনি বলেন, চীন জবরদস্তি ভারতীয় এলাকা দখল করে বসে আছে। ভারতীয় সেনারা বহু এলাকায় টহলদারি করতে পারছে না। এই কারণে নামগিয়ালকে বাদ দিয়ে বিজেপি প্রার্থী করেছে স্থানীয় আইনজীবী তাশি গয়ালসনকে। কেন্দ্রীয় সরকারের নীতির বিরুদ্ধে লাদাখে অনেক দিন ধরেই অনশন আন্দোলন চালাচ্ছেন শিক্ষা ও পরিবেশবিদ সোনম ওয়াংচুক। তাঁকে সমর্থন করছেন স্থানীয় মানুষ। এই কারণে বৌদ্ধ-অধ্যুষিত এলাকা লেহ ও মুসলমান-অধ্যুষিত কার্গিল দুই অঞ্চলেই বিজেপি কোণঠাসা। কিন্তু কংগ্রেস প্রার্থী তারিং নামগিয়ালও খুব স্বস্তিতে নেই। তাঁকে সমর্থনের প্রশ্নে এনসির স্থানীয় নেতারা পদত্যাগ করেছেন।
প্রধানমন্ত্রীর সফর তালিকা থেকে কেন কাশ্মীর উপত্যকা ও লাদাখ বাদ গেছে বোঝা যাচ্ছে। জম্মু-কাশ্মীরে বিজেপির ভরসা দুটি। সীমানা পুনর্বিন্যাস ও মদদপ্রাপ্ত স্থানীয় রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তি। একেকটি কেন্দ্রের ভোট করাতে হচ্ছে একেক দিনে। এ থেকেই বোঝা যেতে পারে উপদ্রুত কাশ্মীর প্রকৃত অর্থে কতটা শান্ত।