বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির | ফাইল ছবি

আরিফুর রহমান: বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাসহ স্থানীয় জনগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক উন্নয়নে বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে ৭০ কোটি ডলার ঋণ ও অনুদান নিচ্ছে সরকার। এর মধ্যে ৫৪ কোটি ডলার ঋণ। বাকি ১৬ কোটি ডলার অনুদান। ঋণের অর্থ সরকারকে ২ শতাংশ হারে সুদসহ পরিশোধ করতে হবে।

 অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) ও পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

এই অনুদান ও ঋণ ব্যয়ের জন্য নেওয়া প্রস্তাবিত প্রকল্পগুলো নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এসব প্রকল্পে পরামর্শকের জন্য অস্বাভাবিক খরচের প্রস্তাব করা হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রকল্পের বিস্তারিত সমীক্ষা করা হয়নি। আবার চলমান প্রকল্পের মতোই কিছু প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে।

সূত্র জানায়, চলতি মাসের শেষ দিকে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংকের বোর্ড সভায় সহায়তার প্রস্তাবটি অনুমোদন পেতে পারে। ১২টি প্রস্তাবিত প্রকল্পে এ অর্থ খরচ করার কথা রয়েছে। চলতি সপ্তাহে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভায় (একনেক) এসব প্রকল্প পাস হতে পারে।

বিশ্বব্যাংক থেকে বড় আকারের এই ঋণসহায়তা তড়িঘড়ি ও অনেকটা গোপনীয়তা রক্ষা করে নেওয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে কেউ আনুষ্ঠানিকভাবে কথা বলছেন না। নাম প্রকাশ না করার শর্তে পরিকল্পনা কমিশনের একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, মাত্র দুই মাসের প্রস্তুতিতে বিশ্বব্যাংক থেকে এ ঋণসহায়তা নেওয়া হচ্ছে।

২০১৭ সালে মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গারা এ দেশে আসার পর এটি হবে কোনো উন্নয়ন সহযোগীর কাছ থেকে বাংলাদেশের বড় আকারের ঋণ নেওয়ার ঘটনা। এত দিন সরকার রোহিঙ্গাদের জন্য মানবিক সহায়তা হিসেবে শুধু বিদেশি অনুদান গ্রহণ করেছে। যৌথ সাড়াদান পরিকল্পনার (জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যান) আওতায় প্রায় সাত বছর ধরে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা দিয়ে আসছে জাতিসংঘ।

বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বাংলাদেশ এমনিতেই এখন বৈদেশিক ঋণের চাপে রয়েছে। সামনে এই চাপ আরও বাড়বে। উন্নয়ন সহযোগীরা একসময় বলেছিল, রোহিঙ্গাদের সহায়তা করবে। তারা এখন প্রতিশ্রুত সহায়তা দিচ্ছে না। এখন তারা কিছু অর্থ অনুদান হিসেবে দিচ্ছে। পরে তারা সব অর্থই ঋণ হিসেবে চাপিয়ে দিতে চাইবে। সরকারকে এ ব্যাপারে দর-কষাকষি করতে হবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বিশ্বব্যাংকের সহায়তা দুই ভাগে ব্যয় করার পরিকল্পনা করা হয়েছে।

সহায়তা কীভাবে ব্যয় হবে
বিশ্বব্যাংকের সহায়তাকে দুই ভাগে ব্যয়ের জন্য ভাগ করা হয়েছে। প্রথম ভাগে কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম এলাকায় বসবাসকারী স্থানীয় লোকজনের জন্য ব্যয় হবে ৩৫ কোটি ডলার। এ অর্থ রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ, বনায়ন, ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ খাতে ব্যয় করা হবে। এ জন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয় আলাদা করে ছয়টি প্রকল্প নিয়েছে।

দ্বিতীয় ভাগের ৩৫ কোটি ডলার ব্যয় হবে রোহিঙ্গাদের আর্থসামাজিক উন্নয়নে। এর মধ্যে ১৯ কোটি ডলার ঋণ। বাকি ১৬ কোটি ডলার অনুদান। এ অর্থে রোহিঙ্গা শিশুদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সপ্তাহের পাঁচ দিন খাবারের ব্যবস্থা করা হবে। কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে করা হবে ডায়াগনস্টিক সেন্টার। দেওয়া হবে ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবা। জন্মনিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এসব কর্মসূচি বাস্তবায়নে ছয়টি প্রকল্প নিয়েছে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়। 

সমীক্ষা নেই, পরামর্শকের জন্য অস্বাভাবিক ব্যয়
বিশ্বব্যাংকের ঋণের অর্থে স্থানীয় নাগরিকদের যাতায়াতব্যবস্থা সহজ করতে বান্দরবান জেলায় বিদ্যমান ৩টি সড়কের ৫০ কিলোমিটার অংশ চওড়া করা হবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় হবে ৮৯১ কোটি টাকা। এই সড়ক নির্মাণে পরামর্শকের জন্য খরচ ধরা হয়েছে ১৫ কোটি টাকা।

নথি ঘেঁটে দেখা যায়, গত ২৫ মার্চ এই প্রকল্পের ওপর প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা হয়। সেখানে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী সৈয়দ মঈনুল হাসান বলেন, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে কম সময়ে প্রকল্পটি তৈরি করা হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে গাছ কাটার প্রয়োজন হবে। প্রকল্পে পাহাড়ি এলাকার সড়কের ওপর কোনো বিস্তারিত সমীক্ষা করা সম্ভব হয়নি।

পরিকল্পনা কমিশন সূত্র বলছে, বান্দরবানের এই রাস্তাগুলো নির্মাণ এখন কতটা অগ্রাধিকার, তা প্রকল্পে বিবেচনায় নেওয়া হয়নি।

রোহিঙ্গা ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে আরেকটি প্রকল্পে খরচ ধরা হয়েছে ১ হাজার ২১৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে বিশ্বব্যাংকের ঋণ ৬৬০ কোটি ও অনুদান ৫৫০ কোটি।

বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, কেউ জানে না, রোহিঙ্গারা কবে নিজ দেশে ফেরত যাবে। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীদের আর কত এভাবে বসিয়ে খাওয়াবে সরকার? রোহিঙ্গা সমস্যা সহজে সমাধান হবে না। তাই বলে বছর বছর ঋণ নিয়ে তাদের খরচ চালানো হবে? আহসান এইচ মনসুরের পরামর্শ, রোহিঙ্গাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে পাসপোর্টের ব্যবস্থা করে সৌদি আরবসহ অন্যান্য দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে পারে সরকার। যে ১২টি প্রকল্পের কথা বলা হচ্ছে, সেখানে কর্মসংস্থান-সংক্রান্ত কিছু নেই।