ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে ইউরোপে আসতে গিয়ে প্রতি বছর অনেক অভিবাসনপ্রত্যাশীর মৃত্যু হয় | রয়টার্স ফাইল ছবি

পদ্মা ট্রিবিউন ডেস্ক:  অন্ধকারে ভূমধ্যসাগরে ঢেউয়ের মধ্যে নৌকা আকৃতির কিছু একটা আছে, এমনটা মনে হচ্ছিল। সেটা দেখেই গিয়ানিস বলছিলেন, ‘তোমাদের সাহায্য করতে আমরা চলে এসেছি।’ কাছে গিয়ে দেখা গেল, ৩৫ জন পাশাপাশি ফাইবার গ্লাসের এক নৌকায় গাদাগাদি করে বসে আছেন। তাঁদের চোখমুখ বসা, থরথর করে কাঁপছেন, গায়ের কাপড় ভেজা, পা খালি, চোখ লাল।

সোমবার ভোরে ভূমধ্যসাগরে মাল্টা ও ইতালির মধ্যকার জলসীমা থেকে তাঁদের উদ্ধার করা হয়। তাঁরা সবাই বাংলাদেশি।

গিয়ানিস হলেন ওশান ভাইকিং চ্যারিটি জাহাজের তল্লাশি ও উদ্ধারকারী দলের একজন সদস্য। তাঁরা মাল্টা ও ইতালির মধ্যকার জলসীমায় টহল দিয়ে থাকেন। জাহাজটি এখন পরিচালিত হচ্ছে এসওএস মেডিটারেনির মাধ্যমে।

একটি নৌকা সংকটাপন্ন অবস্থায় পড়েছে, এমন ঘোষণা বারবার জাহাজের ওয়াকিটকিতে বাজছিল। বলা হচ্ছিল, ‘এসএআর টিম, উদ্ধারের জন্য প্রস্তুত হও।’

এ ঘোষণার পরপরই তাঁরা বের হয়ে পড়েন। টর্চলাইটের আলোয় অন্ধকার ভেদ করে তাঁদের নৌকা ঢেউয়ের ফেনা কেটে চলছিল। এর মধ্যে নিয়ন্ত্রণকক্ষ থেকে বলা হয়, নৌকাটি দেখা গেছে। তাঁরা অভিবাসনপ্রত্যাশীদের সেই নৌকাকে টেনে আনতেই নৌকাটির আরোহীরা তাঁদের (উদ্ধারকারী) হাত ও জ্যাকেট আঁকড়ে ধরেন। একপর্যায়ে তাঁরা উদ্ধারকারী জাহাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ১০ মিনিট পর তাঁরা ওশান ভাইকিংয়ে ফিরে আসেন।

মানসিকভাবে তাঁরা ছিলেন বিধ্বস্ত
উদ্ধার হওয়া ব্যক্তিরা জানান, তাঁরা তিন দিন ধরে নৌকায়। লিবিয়ার বেনগাজি থেকে প্রায় ৬০০ কিলোমিটার পাড়ি দিয়েছেন তাঁরা। তাঁদের গন্তব্য ছিল ইতালির সিসিলি দ্বীপ।

এসওএস মেডিটারেনি জানায়, ২০১৯ সাল থেকে তারা ওশান ভাইকিংয়ের মাধ্যমে ভূমধ্যসাগর থেকে প্রায় ১০ হাজার মানুষকে উদ্ধার করেছে।

উদ্ধারকারী দলের নার্সিং স্টাফরা দেখলেন, নৌকায় থাকা ব্যক্তিদের মধ্যে তিনজনের জরুরি ভিত্তিতে সহায়তা দরকার ছিল। একজন অচেতন অবস্থায় ছিলেন। তাঁকে কম্বলে মুড়িয়ে দেওয়া হয়।

ভোরের আলো ফুটতে শুরু করলে উদ্ধারকারী দলের সঙ্গে যোগ দেয় ইন্টারন্যাশনাল রেডক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট। তারা পানি, খাবার ও কম্বল দেয়। এরপর অভিবাসনপ্রত্যাশীরা গোসল করেন। তাঁদের কালো ট্র্যাকস্যুট পরানো হয়। তাঁদের শরীর গরম করার জন্য শুকনা ফল ও পর্যাপ্ত খাবার খাওয়ানো হয়।

ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব রেডক্রস অ্যান্ড রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির (আইআরএফসি) অপারেশনস ব্যবস্থাপক সারা মানসিনেলি বলেন, ‘তারা যেন ভালো বোধ করে, এটি আমাদের অগ্রাধিকার ছিল। তারা এখানে নিরাপদে আছে এবং তাদের লিবিয়ায় ফিরিয়ে নেওয়া হবে না বলে তাদের আশ্বস্ত করা হয়। যদিও তারা বারবারই আমাদের জিজ্ঞেস করছিল, তোমরা কি আমাদের লিবিয়ায় ফেরত পাঠাচ্ছ? তারা তাৎক্ষণিকভাবে বুঝতে পারছিল না আমরা কারা। তারা মানসিকভাবে প্রচণ্ড ভেঙে পড়েছিল।’

জাহাজটি যাবে ইতালির ওরতোনা বন্দরে
উদ্ধার করা ব্যক্তিদের নিবন্ধন করার পর তাঁদের জাহাজের ডেকে একটি কনটেইনারে রাখা হয়। এর আগেও যাঁরা উদ্ধার হয়েছিলেন, তাঁদেরও এখানে রাখা হয়েছিল। তাঁরা সেখানে আরবি, ফারসি বা বাংলায় অনেক কথা লিখে রেখে গেছেন।

আইএফআরসির আরেকজন ক্রু সদস্য সানা উদ্ধার হওয়া ব্যক্তিদের বুঝিয়ে বলেন, এখন তাঁদের সঙ্গে কী করা হবে। এই বাংলাদেশিদের মধ্যে মাত্র একজনই ইংরেজি জানতেন। তিনি অন্যদের বাংলা করে বলে দিতেন।

জাহাজটি এখন ইতালির অ্যাড্রিয়াটিক উপকূলীয় ওরতোনা বন্দরে যাচ্ছে। যাত্রা শুরু হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই অনেকে ঘুমিয়ে পড়েন।

ইতালির কট্টর ডানপন্থী সরকারের প্রধানমন্ত্রীর চালু করা নতুন নীতি অনুযায়ী, উদ্ধারকারী জাহাজগুলো একই সময়ে একটি অভিযানে অংশ নেবে এবং এরপর সোজা নির্ধারিত বন্দরে চলে যাবে। জাহাজটি ওরতোনায় পৌঁছাতে আরও দুই দিনের বেশি সময় লাগবে।

চলতি মাসে রোম বাংলাদেশকে ‘নিরাপদ দেশ’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে। এর মানে হলো উদ্ধার হওয়া ব্যক্তিদের এখানে আশ্রয় চাওয়া কঠিন হবে।

জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার তথ্যমতে, গত জানুয়ারি থেকে মধ্য ভূমধ্যসাগরে ৬২২ জন অভিবাসনপ্রত্যাশী মারা গেছেন বা নিখোঁজ হয়েছেন। অভিবাসনপ্রত্যাশীদের জন্য রুটটিকে সবচেয়ে বিপজ্জনক বলে সংস্থাটি নিশ্চিত করেছে।