চট্টগ্রাম নগরের পতেঙ্গা থেকে কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে আনোয়ারা উপজেলাকে যুক্ত করেছে এই টানেল। সংযোগ সড়কসহ টানেলের মোট দৈর্ঘ্য ৯ দশমিক ৩৯ কিলোমিটার | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
আনোয়ার হোসেন ও সুজন ঘোষ: চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত টানেল দিয়ে এখন পর্যন্ত প্রত্যাশা অনুযায়ী যানবাহন চলছে না। ফলে টোল আদায় কম হচ্ছে। আয়ের চেয়ে টোল আদায় ও রক্ষণাবেক্ষণের ব্যয় এখন পর্যন্ত বেশি।
সেতু কর্তৃপক্ষের হিসাবে টানেল দিয়ে এখন পর্যন্ত দিনে গড়ে সাড়ে চার হাজারের কিছু বেশি যানবাহন চলাচল করেছে। পূর্বাভাস ছিল, এর অন্তত চার গুণ যানবাহন চলবে। টানেল থেকে টোল বাবদ দৈনিক গড়ে আয় হচ্ছে ১১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। অন্যদিকে এই টোল আদায় ও রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ দিনে ব্যয় গড়ে সাড়ে ৩৭ লাখ টাকা।
কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের মূল দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার। এটি দেশের নদীর তলদেশের প্রথম টানেল। চীনা ঋণ ও বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে এই টানেল তৈরি করা হয়েছে।
বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ (বাসেক) সূত্র জানিয়েছে, এ বছর থেকে টানেলের জন্য নেওয়া চীনা ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু করতে হবে। আয় কম হওয়ায় রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় অন্যান্য সেতুর আয় থেকে মেটাতে হবে। ফলে ঋণ পরিশোধে সরকারকে রাজস্ব খাত থেকে ভর্তুকি দিতে হবে।
টানেল দিয়ে যানবাহনে কর্ণফুলী নদী পার হতে ৩ থেকে সাড়ে ৩ মিনিট সময় লাগছে। ফলে মানুষের চলাচল সহজ হয়েছে। কিন্তু অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও সেতু কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তারা বলছেন, টানেলের এক পাশে বিভিন্ন গন্তব্যে যাওয়ার সড়ক প্রশস্ত করা হয়নি। কর্ণফুলী নদীর এক পাশে শহর সম্প্রসারণে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) তেমন পদক্ষেপ নেই। টানেলকেন্দ্রিক শিল্পায়নও দরকার। এসব নিশ্চিত হলে টানেলটির ব্যবহার বাড়বে।
সেতু বিভাগের সচিব মো. মনজুর হোসেন বলেন, কক্সবাজার ও মাতারবাড়ীকে টানেলের সঙ্গে দ্রুত যুক্ত করার বিষয়ে কাজ চলছে। এটা সম্ভব হলে যানবাহন চলাচল এবং আয় বাড়বে। চীনা ঋণের কিস্তি পরিশোধের বিষয়ে তিনি বলেন, বিষয়টি এখন অর্থ মন্ত্রণালয় দেখছে।
দেশের প্রথম টানেল
জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় ২০১৫ সালের নভেম্বরে ‘কনস্ট্রাকশন অব মাল্টি লেন রোড টানেল আন্ডার দ্য রিভার কর্ণফুলী’ শীর্ষক টানেল প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়। কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২০ সালের জুনে। তবে নির্মাণকাজ উদ্বোধন করা হয় ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি। শুরুতে প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় প্রায় ৮ হাজার ৪৪৭ কোটি টাকা। পরে ব্যয় বেড়ে হয় ১০ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৬ হাজার ৭০ কোটি টাকা ঋণ হিসেবে নেওয়া হয়েছে চীনের এক্সিম ব্যাংক থেকে।
চীনা ঋণের সুদের হার ২ শতাংশ। এর সঙ্গে আছে শূন্য দশমিক ২০ শতাংশ সেবা মাশুল বা সার্ভিস চার্জ। ঋণ পরিশোধের মেয়াদ ১৫ বছর। এর মধ্যে ঋণ নেওয়া ও কিস্তি শোধ শুরুর মধ্যকার বিরতি (গ্রেস পিরিয়ড) হিসেবে পাঁচ বছর সময় অন্তর্ভুক্ত। সাধারণত প্রথম কিস্তি পাওয়ার পরের পাঁচ বছরকে গ্রেস পিরিয়ড ধরা হয়।
চীনেরই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন কোম্পানি (সিসিসিসি) টানেলটি নির্মাণ করেছে। এখন টোল আদায় ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজও পেয়েছে তারা। চীনা ঋণ প্রকল্পের প্রধান শর্ত হলো, তাতে চীনা ঠিকাদার কাজ করবে, কোনো দরপত্র আহ্বান করা হয় না। অভিযোগ রয়েছে, এ ধরনের শর্তের প্রকল্পে ব্যয় অনেক বেশি হয়।
২০১৮ সালে চীনের দীর্ঘতম হাইওয়ে টানেল টাইহু টানেল নির্মাণ শুরু হয়। প্রায় ১১ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের টানেলটি চালু হয় ২০২২ সালের জানুয়ারিতে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদমাধ্যম সিএনএনের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, টানেলটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ১৫৬ কোটি ডলার। বর্তমানে বাংলাদেশি মুদ্রায় কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় দাঁড়ায় ১ হাজার ৫৯০ কোটি টাকা।
ভারতের মুম্বাইয়ে মুম্বাই কোস্টাল রোড প্রকল্পের আওতায় সমুদ্রের তলদেশে দুই কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের একটি টানেল নির্মাণ করা হচ্ছে। এতে প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় হচ্ছে ১ হাজার ৭৭৯ কোটি টাকা।
বাংলাদেশের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণে প্রতি কিলোমিটারের মোট ব্যয় ৩ হাজার ২০০ কোটি টাকার বেশি। টানেল প্রকল্পের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দাবি, ভারত ও চীনে অবকাঠামো নির্মাণে নিজেদের জনবল, যন্ত্রপাতি ও নির্মাণ উপকরণের সামগ্রী ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশে অনেক কিছুই আমদানি করতে হয়। এ জন্য খরচ বেশি পড়ে।
অবশ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রের মাধ্যমে ঠিকাদার নিয়োগ করা হলে ব্যয় কমানো সম্ভব হতো। সড়ক পরিবহনবিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মো. সামছুল হক বলেন, টানেল নির্মাণে অনেক বেশি অর্থ ব্যয় হয়েছে। আর এর রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালন খরচও অনেক বেশি। যদি কর্ণফুলী নদীতে ঝুলন্ত সেতু করা হতো, তাহলে অনেক কম টাকা খরচ হতো।
কত গাড়ি চলছে
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বছরের ২৮ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু টানেল উদ্বোধন করেন। উদ্বোধনের পরদিন থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে গাড়ি চলাচল শুরু হয়। সেই হিসাবে সাড়ে ছয় মাস হলো টানেলটি মানুষ ব্যবহার করতে পারছেন।
সড়ক যোগাযোগের যেকোনো অবকাঠামো তৈরির সময় যানবাহন চলাচলের একটি প্রক্ষেপণ করা হয়। চীনা ঠিকাদারের সমীক্ষায় বলা হয়েছিল, টানেল চালু হলে (২০২০) দিনে ২০ হাজার ৭১৯টি যানবাহন চলবে। প্রতিবছর তা ৬ দশমিক ৪ শতাংশ হারে বাড়বে। ২০২৫ সালে দৈনিক গড়ে ২৮ হাজার ৩০৫টি যানবাহন চলবে। ২০৩০ সালে সংখ্যাটি দাঁড়াবে দিনে প্রায় ৩৮ হাজার।
২০২০ সালের জায়গায় টানেল চালু হয়েছে ২০২৩ সালে। সেতু কর্তৃপক্ষের হিসাবে চালুর পর ৬ মে পর্যন্ত দিনে যানবাহন চলেছে গড়ে ৪ হাজার ৬১৩টি করে। টোল আদায় হয়েছে প্রায় ২২ কোটি টাকা। দিনে গড়ে আয় হয়েছে ১১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। শুরুর চেয়ে সাম্প্রতিক সময়ে যানবাহন চলাচল কমেছে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
বঙ্গবন্ধু টানেল নির্মাণ ও পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে সরকারের সেতু বিভাগের অধীন সংস্থা সেতু কর্তৃপক্ষ। সংস্থাটির প্রকৌশলীরা বলছেন, টানেল চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার পর অনেক দিন হরতাল ও অবরোধ চলেছে। এ কারণে যান চলাচল কম হয়। কিন্তু দৈনন্দিন যানবাহন চলার প্রবণতা বিশ্লেষণে দেখা যায়, শুরুতে টানেল দেখার জন্য অনেকে গাড়ি নিয়ে গেছেন। সাম্প্রতিককালে বরং যান চলাচল কমেছে।
সংস্থাটির সূত্র বলছে, টানেলটি দিয়ে ভারী যানবাহন বেশি চলাচল করবে বলে ধরা হয়েছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত বেশি চলেছে ব্যক্তিগত গাড়ি বা প্রাইভেট কার। টানেল দিয়ে মোটরসাইকেল ও তিন চাকার যান চলাচল নিষিদ্ধ।
আয় কম, ব্যয় বেশি
নির্মাতা প্রতিষ্ঠান চীনের সিসিসিসিকে পাঁচ বছরের জন্য টানেল রক্ষণাবেক্ষণ ও টোল আদায়ের দায়িত্ব দিয়েছে সরকার। তাদের দিতে হবে ৯৮৪ কোটি টাকা (৩৫ শতাংশ বৈদেশিক মুদ্রায়)। সেতু বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, ঠিকাদারকে যে টাকা দেওয়া হবে, এর মধ্যে ৩০০ কোটি টাকার মতো ব্যয় হয়েছে স্ক্যানার কিনতে। রক্ষণাবেক্ষণে পাঁচ বছরে প্রকৃত ব্যয় ৬৮৪ কোটি টাকা। সেই হিসাবে রক্ষণাবেক্ষণের দৈনিক ব্যয় দাঁড়ায় সাড়ে ৩৭ লাখ টাকা।
সব মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে, আপাতত টোল থেকে যে অর্থ আয় হচ্ছে, তা রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়ের তিন ভাগের এক ভাগের সমান। এ ছাড়া প্রতি পাঁচ বছর পর একবার টানেলের বড় ধরনের রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে, যাকে বলা হয় ‘রেগুলার মেইনটেন্যান্স’। সমীক্ষায় বলা হয়েছে, একবার এ ধরনের রক্ষণাবেক্ষণকাজে প্রায় ১৯ লাখ ডলার ব্যয় করতে হবে, যা প্রায় ২১ কোটি টাকার সমান।
বর্তমানে আয়ের যে ধারা, তাতে টোল থেকে টানেলের রক্ষণাবেক্ষণ ও ঋণের কিস্তি পরিশোধ সম্ভব কি না, জানতে চাইলে সেতু কর্তৃপক্ষের প্রধান প্রকৌশলী কাজী মো. ফেরদাউস বলেন, পর্যাপ্ত টোল আদায় না হলে সরকার ব্যয় করবে। পরে আয় বাড়লে সরকারকে পরিশোধ করা হবে।
সড়ক অপ্রশস্ত
টানেল নির্মাণের সময় চট্টগ্রামের আনোয়ারার চাতরী থেকে ওয়াই জংশন পর্যন্ত সড়ক সম্প্রসারিত করা হয়েছে। তবে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক প্রশস্ত করা হয়নি। টানেল থেকে বের হয়ে আসার পর পটিয়া-আনোয়ারা-বাঁশখালী (পিএবি) সড়কের আনোয়ারা ও বাঁশখালী অংশের সম্প্রসারণ করা হয়নি। যে কারণে এখনো টানেল হয়ে কক্সবাজারে যেতে বাড়তি পথ পাড়ি দিতে হচ্ছে যাত্রীদের। বাঁশখালী দিয়ে কক্সবাজারে যাতায়াতের ব্যবস্থা করা হলে অন্তত ২৫ কিলোমিটার দূরত্ব কমে যাবে। সড়ক সম্প্রসারণের প্রকল্প এখনো আলোচনার পর্যায়ে আছে।
কর্ণফুলী টানেল হলে চীনের সাংহাই শহরের মতো চট্টগ্রাম শহরকে ‘ওয়ান সিটি টু টাউনে’র মডেলে গড়ে তোলার পরিকল্পনা সরকারের। কিন্তু চট্টগ্রামের দক্ষিণ প্রান্তে শহর সম্প্রসারণ বা সেখানে পরিকল্পিতভাবে নাগরিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার বিষয়ে সিডিএ ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের দৃশ্যত কোনো কার্যক্রম নেই।
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মইনুল ইসলাম বলেন, টানেলের তখনই ভালো ব্যবহার হবে, যখন চট্টগ্রামের মিরসরাই থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত মেরিন ড্রাইভ নির্মাণ করা হবে। মেরিন ড্রাইভ হয়ে গেলে তখন এর পাশে নানা ধরনের শিল্পকারখানা গড়ে উঠবে। এসব কারখানার পণ্যবাহী যানবাহন টানেলের ভেতর দিয়ে চলাচল করবে। যদি তা না হয়, টানেল একরকম অব্যবহৃত থেকে যাবে।