নিজস্ব প্রতিবেদক: দেশের ফাস্টট্র্যাক বা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত প্রকল্পগুলোর মধ্যে তিনটি প্রকল্প আগামী মাসেই শেষ হচ্ছে। ফলে নতুন অর্থবছরের উন্নয়ন প্রকল্পের তালিকা থেকে বাদ পড়বে এ তিন প্রকল্প। প্রকল্পগুলো হলো পদ্মা বহুমুখী সেতু; পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প এবং দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেল লাইন। 

এরই মধ্যে এই তিন প্রকল্পের উদ্বোধন হয়ে গেছে। এখন আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকল্প শেষ করা বাকি। প্রকল্পগুলো চালু হলেও টুকটাক কিছু কাজ চলমান থাকে, যেমন প্রাথমিক রক্ষণাবেক্ষণ, ঠিকাদারের বকেয়া বিল পরিশোধ ইত্যাদি। এসব কাজ শেষে আগামী বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) বই থেকে এসব প্রকল্প বাদ দেওয়া হবে।

অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাস্তবায়নে সরকার দেশের আট মেগা প্রকল্পকে ফাস্টট্র্যাক প্রকল্প হিসেবে তালিকাভুক্ত করে। এসব প্রকল্প একাধিক দফা সংশোধনের জন্য একদিকে সময় বেড়েছে, অন্যদিকে বেড়েছে খরচও। ফাস্টট্র্যাক প্রকল্পের তালিকায় থাকা আটটি প্রকল্পের মধ্যে তিনটি আগামী জুনে শেষ হচ্ছে। বাকি পাঁচটি প্রকল্পের মধ্যে তিনটি শেষ হবে ২০২৫ সালে এবং দুটি শেষ হবে ২০২৬ সালে।

প্রকল্পের দলিল অনুসারে, আগামী বছর অর্থাৎ ২০২৫ সালের মধ্যে শেষ হবে উত্তরা থেকে কমলাপুর পর্যন্ত মেট্রোরেল নির্মাণ (লাইন-৬); রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র; পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্প। ২০২৬ সালে শেষ হবে মাতারবাড়ী কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্র এবং রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সর্বশেষ হিসাবে, ফাস্টট্র্যাক প্রকল্পের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অগ্রগতি পদ্মা সেতুতে। প্রকল্পটি আগামী জুনের মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হয়ে যাবে, এখন কোনো কাজ বাকি নেই। অন্যদিকে সবচেয়ে কম অগ্রগতি রূপপর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পে। এই প্রকল্পের অগ্রগতি মাত্র ৬৫ শতাংশ। বাকি প্রকল্পগুলোর অগ্রগতি ৭৬ থেকে ৯৬ শতাংশের মধ্যে।

এ বিষয়ে সাবেক সচিব ও বড় অবকাঠামোবিশেষজ্ঞ মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, ‘বর্তমানে অর্থনীতিতে একটি বিশেষ পরিস্থিতি চলছে। এমন অবস্থায় বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনায় কোনো প্রকল্প আপাতত স্থগিত (অ্যাবানডেন্ড) করা উচিত, আবার কোনোটির বাস্তবায়ন বিলম্বিত করা উচিত।’ তাঁর মতে, পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রকল্পটি আপাতত স্থগিত করা উচিত। আবার রূপপুর বা মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো প্রকল্প পিছিয়ে দেওয়া দরকার। তবে জনস্বার্থ বিবেচনায় মেট্রোরেল প্রকল্পটি দ্রুত শেষ করা উচিত।  

পদ্মা সেতু
বর্তমান সরকারের নেওয়া সবচেয়ে বড় অগ্রাধিকার প্রকল্প পদ্মা সেতু। ২০২২ সালের জুনে এই সেতু দিয়ে যান চলাচল শুরু হয়। তবে প্রকল্পটি আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হবে আগামী জুনে। গত মার্চেই প্রকল্পটির কাজ প্রায় শতভাগ শেষ হয়ে গেছে। ২০০৯ সালে প্রথম পদ্মা সেতু নির্মাণের প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। পরে একাধিকবার সংশোধনের পর এখন ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৩২ হাজার ৬০৫ কোটি টাকায়।

পদ্মা সেতু রেল সংযোগ
রাজধানীর সঙ্গে দেশের দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চলের রেল যোগাযোগ স্থাপন করতে এই প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এই প্রকল্পের খরচ ৩৯ হাজার ২৪৯ কোটি টাকা। গত মার্চ পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ৩১ হাজার ৮৭ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। আর্থিক অগ্রগতি ৮১ দশমিক ২৮ শতাংশ। প্রকল্পটি ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে শুরু হয়। ইতিমধ্যে পদ্মা রেলসেতু হয়ে ট্রেন চলাচল শুরু হয়েছে। আগামী জুন মাসে প্রকল্পটি শেষ হবে। 

মেট্রোরেল
রাজধানীতে সবচেয়ে বড় প্রকল্প মেট্রোরেল। ইতিমধ্যে উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার মেট্রোরেল চালু হয়েছে। এখন কমলাপুর পর্যন্ত সম্প্রসারিত করা হচ্ছে। ৩৩ হাজার ৪৭১ কোটি টাকার এই প্রকল্পে মার্চ পর্যন্ত অগ্রগতি ৮৭ শতাংশ। টাকার অঙ্কে খরচ হয়েছে ২৩ হাজার ৭২০ কোটি টাকা। দৃশ্যমান বা ভৌত অগ্রগতি আরও বেশি। ২০১২ সালে এই প্রকল্প নেওয়া হয়। ২০২৫ সালের জুনে এই প্রকল্প শেষ হবে। জাইকা এই প্রকল্পে অর্থায়ন করছে।

এদিকে উত্তরার দিয়াবাড়ি থেকে টঙ্গী রেলস্টেশন পর্যন্ত মেট্রোরেল সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ জন্য নতুন পাঁচটি স্টেশন নির্মাণ করা হবে। 

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র
দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয় ২০১৬ সালে। প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৯৩ কোটি টাকা। রাশিয়ার অর্থায়নে হচ্ছে এই প্রকল্প। টাকার অঙ্কে এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রকল্প। এই বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ শেষ হবে ২০২৫ সালের ডিসেম্বরে। গত মার্চ মাস পর্যন্ত এই প্রকল্পের অগ্রগতি ৬৫ শতাংশ। টাকার অঙ্কে খরচ হয়েছে ৭১ হাজার ৮৯ কোটি টাকা।
মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র

২০১৪ সালে এই প্রকল্প নেওয়া হয়। লক্ষ্য ছিল ২০২৩ সালের মধ্যে ১২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের এই কেন্দ্রের নির্মাণকাজ শেষ হবে। পরে প্রকল্প সংশোধন করে মেয়াদ বাড়ানো হয় ২০২৬ সাল পর্যন্ত। গত মার্চ মাস পর্যন্ত এ প্রকল্পে খরচ হয়েছে ৩৯ হাজার ৭৫৯ কোটি টাকা। বাস্তবায়নের হার ৭৬ শতাংশ। 

চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথ
পৃথিবীর বৃহত্তম সমুদ্রসৈকত ও পর্যটনকেন্দ্র কক্সবাজারের সঙ্গে সরাসরি রেল যোগাযোগ তৈরির জন্য চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। আরেকটি শাখা দোহাজারী থেকে রামু হয়ে মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী ঘুমধুম পর্যন্ত নেওয়ার কথা। আপাতত এই অংশের বাস্তবায়ন স্থগিত করা হয়েছে। এক দফা ব্যয় বৃদ্ধির পর এই প্রকল্পের ব্যয় দাঁড়িয়েছে ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকা। ইতিমধ্যে দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথ চালু হয়েছে।

পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর
এ প্রকল্প ৪ হাজার ৫১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়িত হচ্ছে। গত মার্চ পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ৩ হাজার ৭৮২ কোটি টাকা। আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে ৮৬ দশমিক ৪৫ শতাংশ। ২০১৯ সালে প্রকল্পটি নেওয়া হয়। ২০২৫ সালের জুনে প্রকল্পটি শেষ হবে।

রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র
বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) বাইরে ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে। ১৬ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পটির গত মার্চ মাস পর্যন্ত ৯৫ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে।