প্রতিনিধি নওগাঁ: চারদিকে সবুজ বৃক্ষের বেষ্টনি। মাঝখানে ১ হাজার ১০০ মিটার দৈর্ঘ্য ও ৫০০ মিটার প্রস্থের একটি দিঘি। শীতে দিঘির জলে ডানা ঝাপটাত, খুনসুটিতে মেতে উঠত নানান পরিযায়ী পাখি। দিঘির টলটলে জলে বড় বড় পাতার মধে৵ ফুটে থাকত সাদা ও গোলাপি পদ্ম। সে এক নয়নাভিরাম দৃশ্য। দিঘিটি দেখতে দূরদূরান্ত থেকে পর্যটকেরা আসতেন।

দুই বছর আগেও এমন দৃশ্য দেখা যেত নওগাঁর ধামইরহাট উপজেলার আলতাদিঘী জাতীয় উদ্যানের মধ্যে অবস্থিত বিশাল দিঘিটিতে। সংস্কারের নামে এখন একখণ্ড মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে প্রায় হাজার বছর আগে খনন করা ঐতিহাসিক আলতাদিঘী। খননের নামে পাল আমলে সৃষ্ট দিঘিটির চারপাশের গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। এতে আশ্রয়হীন হয়ে এলাকা ছেড়েছে পশুপাখি। পুনঃখনন করতে গিয়ে শুকিয়ে ফেলা হয়েছে দিঘিটি। ধ্বংস হয়েছে জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণী। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ স্থানীয় লোকজন ও পরিবেশবাদীরা।

বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, আলতাদিঘী পুনঃখননের কাজ বাস্তবায়ন করতে গিয়ে দিঘির চারপাশের ১ হাজার ১০২টি গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে শুরু করে নভেম্বর পর্যন্ত গাছগুলো কাটা হয়েছে।

তবে স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, দিঘি খননের নামে তিন হাজারের বেশি গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। দিঘির মূল জলাশয় থেকে পাড়ের অনেক দূরের গাছ কাটা হয়েছে। এমনকি দিঘির পাড়ের আশপাশের প্রাকৃতিক সৃষ্ট শালবনের অনেক বড় বড় গাছও কেটে ফেলা হয়েছে। এ ছাড়া অনেক শোভাবর্ধনকারী গাছও কাটা পড়েছে।

মঙ্গলবার দুপুর ১২টার দিকে কথা হয় আলতাদিঘী জাতীয় উদ্যানে বেড়াতে আসা নওগাঁর নজিপুর সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী সাইফুল ইসলাম ও মুশফিকুর রহমানের সঙ্গে। দিঘির বর্তমান অবস্থা দেখে তাঁরা দুজনই ক্ষুব্ধ। সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘পুনঃখননের জন্য দিঘির পানি শুকিয়ে ফেলা হয়েছে, এটা মেনে নেওয়া যায়। কারণ, প্রয়োজনে পানি দিয়ে দিঘিটি আবার ভরা যাবে। কিন্তু যেভাবে দিঘির পাড়ের গাছ কাটা হয়েছে, এটা মানতে পারছি না। পুরো এলাকা যেন ধু ধু মরুভূমি হয়ে গেছে।’

পুনঃখননের আগে আলতাদীঘিতে ছিল সবুজের সমারোহ | ছবি: সংগৃহীত

জানতে চাইলে ধামইরহাট বনবিট কর্মকর্তা আনিসুর রহমান  বলেন, দিঘির পাড়ে যেসব গাছ কাটা হয়েছে, সেগুলো সামাজিক বনায়নের আওতায় ইউক্যালিপটাস ও আকাশমণি প্রজাতির চারা দ্বারা বনায়ন করা গাছ। যথাযথ প্রক্রিয়া অবলম্বন করে মোট ৩৫ লাখ ৯৫ হাজার ২৫৬ টাকার গাছ দরপত্রের মাধ্যমে বিক্রি করা হয়েছে। মোট ১ হাজার ১০২টি গাছ কাটা হয়েছে।

নওগাঁ বন বিভাগের পাইকবান্দা রেঞ্জের ধামইরহাট বন বিট কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, সম্প্রতি আলতাদিঘী জাতীয় উদ্যানের মধ্যে অবস্থিত দিঘি পুনঃখনন কাজের প্রকল্প হাতে নেয় পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়। গত বছরের ১৭ জুন সাবেক বনমন্ত্রী শাহাব উদ্দিন দিঘির পুনঃখনন কাজের উদ্বোধন করেন। প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ৬ কোটি ৩৯ লাখ টাকা।

পুনঃখননের নামে নওগাঁর ধামইরহাট উপজেলার আলতাদিঘির চারপাশের হাজারো গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। পানি সেচে শুকিয়ে ফেলা হয়েছে দিঘিটিও। গতকাল দুপুরে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) নওগাঁ জেলা শাখার সহসভাপতি রফিকুল ইসলাম বলেন, আলতাদিঘী জাতীয় উদ্যানে প্রায় ৪০০ একর আয়তনের একটি প্রাকৃতিক সৃষ্ট শালবন রয়েছে। সরকার ওই এলাকার গুরুত্ব অনুধাবন করে ওই এলাকাকে সংরক্ষিত বনাঞ্চল হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। অথচ সেই বনভূমির মধ্যে আলতাদিঘী পুনঃখননসহ বন ধ্বংসকারী বেশ কিছু প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। দিঘিটি পুনঃখননের নামে তিন হাজারের বেশি গাছ কেটে ফেলায় প্রচুর পশুপাখি আশ্রয়হীন হয়ে এলাকা ছেড়েছে। এ ছাড়া দিঘি খনন করতে গিয়ে পদ্মগাছসহ প্রচুর জলজ উদ্ভিদ ধ্বংস হয়েছে। এই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে কয়েক দশক লেগে যাবে।