পাহাড়ি জঙ্গলের ভেতর বিধ্বস্ত হয় ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসিকে বহনকারী হেলিকপ্টার। ঘন কুয়াশা আর বৈরী আবহাওয়ার মধ্যেই সেখানে পৌঁছান উদ্ধারকারীরা। গতকাল উত্তর–পশ্চিম ইরানের পূর্ব আজারবাইজান প্রদেশের ভারজাগান এলাকায় | ছবি: এএফপি

পদ্মা ট্রিবিউন ডেস্ক: হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির মৃত্যু হলো এমন এক সময়ে, যখন বিশেষ সংকটময় সময় পার করছে মধ্যপ্রাচ্য। সাত মাস ধরে ইসরায়েলের হামাসবিরোধী লড়াইয়ে গাজায় যে মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে, তা এখন বিশ্ববাসীর মনোযোগের কেন্দ্রে। গাজার এই পরিস্থিতি মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ক্রমে উত্তেজনা বাড়িয়ে তুলেছে।

গাজায় ইসরায়েলের নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ দশকব্যাপী ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে চলমান ছায়াযুদ্ধকেও সামনে নিয়ে এসেছে। এই যুদ্ধ ঘিরে উত্তেজনার মধ্যে গত এপ্রিলে সিরিয়ায় ইসরায়েলের বিমান হামলায় ইরানের শীর্ষস্থানীয় একজন কমান্ডার নিহত হন। এর জেরে ইরান প্রথমবারের মতো নিজেদের ভূখণ্ড থেকে ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালায়। তার এক সপ্তাহের মাথায় ইরানের বিমানঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ইসরায়েল।

এরপর দুই দেশের পাল্টাপাল্টি হামলা বন্ধ হয়েছে। তবে ইরান সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর মাধ্যমে ইসরায়েলের সঙ্গে লড়াই অব্যাহত রেখেছে তেহরান। লেবাননভিত্তিক সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ ধারাবাহিকভাবে ইসরায়েলের সেনাবাহিনীর বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালিয়ে আসছে। হামাসও আবার সংগঠিত হয়ে গাজার বিভিন্ন এলাকায় ইসরায়েলি সেনাদের সঙ্গে লড়াই করছে।

ইসরায়েলের সঙ্গে এই বৈরিতা সামলে চলার পাশাপাশি ইরানের নতুন নেতৃত্বকে সবচেয়ে বড় সিদ্ধান্তটা নিতে হবে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে। ৯ মে ইরানের সর্বোচ্চ নেতার পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক উপদেষ্টা কামাল খারাজি বলেন, ইসরায়েল হামলা চালালে ইরান তার পারমাণবিক কর্মসূচির গতিপথ পাল্টে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির পথে হাঁটবে। পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি নিয়ে হালকা কথাবার্তা না বলার জন্য ইরানকে সতর্ক করেছেন আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার (আইএইএ) মহাপরিচালক রাফায়েল গ্রোসি।

হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে প্রেসিডেন্ট রাইসির সঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির আবদুল্লাহিয়ানের মৃত্যুও ইরানের জন্য বিরাট ধাক্কা হয়ে এসেছে। তাঁর মৃত্যুতে ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্বে আসা উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী আলী বাগেরি কানিকে এখন ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে পশ্চিমাদের সঙ্গে দেনদরবার করতে হবে। ইরানের নতুন নেতৃত্বের জন্য পশ্চিমাদের সঙ্গে বৈরিতা সামলে রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখাটাও বড় বিষয় হিসেবে দেখা দেবে।

দেশের ভেতরেও ক্ষমতার ধারাবাহিকতা রক্ষার চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে তেহরান। বর্তমানে ৮৫ বছর বয়সী ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির উত্তরসূরি কে হবেন, সে প্রশ্ন সামনে এসেছে। রাইসিই খামেনির উত্তরসূরি হবেন বলে মনে করা হচ্ছিল।

ইরানের শাসনব্যবস্থায় রাষ্ট্রক্ষমতায় ধর্মীয় নেতা, রাজনীতিবিদ ও সেনাবাহিনীর প্রভাব রয়েছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি আছেন সবার ঊর্ধ্বে। প্রেসিডেন্ট তাঁর সায় নিয়েই গুরুত্বপূর্ণ সব সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির খুবই অনুগত হিসেবে পরিচিত ছিলেন। সর্বোচ্চ নেতার সমর্থনপুষ্ট হয়ে ২০২১ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে প্রেসিডেন্ট হন ইব্রাহিম রাইসি। তাঁর মৃত্যুতে এ পদের জন্য খামেনির ছেলে মোজতবা খামেনির পথ পরিষ্কার হতে পারে।

এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমাদের কঠোর নিষেধাজ্ঞায় থাকা ইরানের ভেতরেও সাম্প্রতিক সময়ে ভিন্নমতাবলম্বীদের বিক্ষোভের মুখে পড়তে হয়েছে দেশটির নেতাদের। ২০২২ সালে ইরানের নীতি পুলিশের হেফাজতে মাসা আমিনি নামের এক তরুণীর মৃত্যুর পর নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে দেশজুড়ে বিক্ষোভ হয়। কঠোরভাবে ওই বিক্ষোভ দমন করে ইরানি কর্তৃপক্ষ।

গত মার্চে প্রকাশিত জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে ইরানের দমনাভিযানে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের কথা উঠে আসে। বলা হয়, কোথাও কোথাও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে।

ওই বিক্ষোভ এখন বন্ধ হলেও ইরানের অনেক নাগরিক, বিশেষত তরুণদের মধ্যে ধর্মীয় নেতাদের প্রতি বিরোধিতা রয়ে গেছে। তাঁরা দেশে চাকরির ব্যবস্থা এবং ধর্মীয় শাসন থেকে দেশকে বের করতে চান।