টনি হেমিং ও তানজিনা মিতু | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

সাইফুল্লাহ্ বিন আনোয়ার: মেলবোর্ন থেকে সাউথ গিপসল্যান্ডের দূরত্ব ১৫০ কিলোমিটারের একটু বেশি। টনি হেমিংয়ের কাছে জায়গাটা ইউরোপের মতো। পাহাড়, উঁচু-নিচু রাস্তা। হেমিংয়ের বড় দুই ভাই ভিক্টোরিয়া রাজ্যের জুনিয়র পর্যায়ে সাইক্লিস্ট ছিলেন একসময়। আর হেমিংয়ের প্রথম রেসটা ছিল ১০ বছর বয়সে। নিজের আরেকটি পরিচয় তিনি দেন এভাবে—সাবেক পেশাদার সাইক্লিস্ট।

হেমিং সাউথ গিপসল্যান্ড ছেড়েছেন আগেই, মেলবোর্ন-লন্ডন-দুবাই হয়ে এখন থিতু পার্থে। স্ত্রী-সন্তান থাকেন সেখানেই। পার্থ স্টেডিয়ামের অ্যারেনা ম্যানেজারের কাজটা একটা সময় একঘেয়ে লাগছিল বলে ছেড়ে দিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত এসেছেন বাংলাদেশে, বিসিবির কিউরেটর হিসেবে।

ঢাকায় কোনো কোনো দিন তেমন কিছু করার থাকে না। তখন সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়েন, পূর্বাচলের ৩০০ ফুট ধরে প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টায় সাইক্লিং করেন ১০০ কিলোমিটারের মতো। হাতের স্মার্টওয়াচটা আগের দিন হেমিংকে বার্তা দিয়েছিল, ফিটনেস বেশ ভালো পর্যায়েই আছে। সেটি নিয়ে বেশ গর্ব হচ্ছিল বিসিবির অস্ট্রেলিয়ান কিউরেটরের।

সেদিন সকালে বেরিয়েছিলেন সাড়ে ছয়টার দিকে। পুরো রাস্তা দুবার চক্কর দিয়েছেন, মানে প্রায় ৩০ কিলোমিটার সাইক্লিং করা হয়ে গেছে। পরের ল্যাপটা শুরু করবেন। সাইক্লিংয়ের জন্য দারুণ এক সকাল, রাস্তায় তেমন গাড়িও নেই। আর কত কিলোমিটার, ভাবছেন তা।

সে সময় রাস্তার অন্যদিকে এক মেয়েকে দেখলেন হেমিং। তাঁর সঙ্গেও সাইকেল, তবে সেটি থামিয়ে রাখা। প্রথমে ভেবেছিলেন, মেয়েটার সাইকেলের টায়ার পাংচার হয়ে গেছে। এরপর সেদিকে তাকিয়ে তাঁর মনে হলো, মেয়েটা কিছু বলতে চায়, হয়তো সাহায্য চায়। ব্রেক চেপে তাই নিজের গতি কমিয়ে আনলেন।

সাধারণত রাস্তার মাঝ থেকে ইউটার্ন তিনি নেন না। পেছন ফিরে দ্রুত একঝলক তাকিয়ে কাউকে খেয়ালও করেননি। ভেবেছিলেন, তাঁর লেনে কেউ নেই। সেটি যে ভুল, একটু পরই তা টের পেলেন। পেছন থেকে এক মোটরসাইকেল এসে মারল ধাক্কা।

মোটরসাইকেলের চালক গোত্তা খেয়ে ছিটকে গেলেন। হেমিংয়ের ভাষায়, ‘মোটোজিপির কোনো রাইডারের মতো।’ হেমিং নিজে ছিটকে গেলেন আরেক দিকে।

২.
তানজিনা মিতু কুমিল্লার তরুণী। নিজের পরিচয়টা তিনি দেন ধাপে ধাপে। তবে দিন শেষে তাঁর সবচেয়ে বড় পরিচয়, তিনি একজন খেলোয়াড়। শুরুটা ভলিবল দিয়ে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কারাতেতে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন, সেটির ব্ল্যাকবেল্টধারী ২৪ বছর বয়সী তানজিনা। উশুও খেলেন জাতীয় পর্যায়ে। একবার বেনাপোল হয়ে বাইসাইকেলে চেপে ভারতে কারাতে খেলতে গিয়েছিলেন।

দল আগেই ভারতে পৌঁছে টুর্নামেন্ট শুরুর আগে কোথাও ঘুরতে গেছে আর তিনি তখন তিন দিনের সাইকেল-সফরে। টুর্নামেন্টের আমন্ত্রণপত্র দেখিয়ে সাইকেল নিয়েই পার হয়েছিলেন সীমান্ত।

উশুর কোনো একটা ক্যাম্প চলার কথা এখন, তবে মিতু সেখানে অংশ নিচ্ছেন না। তিনি সাইকেল নিয়ে বেরিয়েছেন দেশভ্রমণে। উদ্দেশ্য, ৬৪ জেলা ঘুরে নিজের দেশটা দেখা। সুযোগ পেলে পরের বছর আবার উশুতে নামবেন। 

মঙ্গলবারের ওই সকালে ঢাকা থেকে ওই সফর শুরু হওয়ার কথা ছিল মিতুর। ৩০০ ফুটের রাস্তায় তাঁর সামনে একটু আগে একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে। মোটরসাইকেলচালক আর তাঁর আহত আরোহীকে মিতু সহায়তাও করেছেন ৯৯৯-এ কল করে অ্যাম্বুলেন্স ডেকে এনে।

এরপর নিজের সফরের শুরুতে একটা ব্যানার বের করে ছবি তুলছিলেন সাইকেলের সামনে। সকাল আটটার মতো বাজে। ফেসবুকে পরিচয় হওয়া ভারতের সাবেক এক কারাতে খেলোয়াড়কে তিনি ‘মা’ ডাকেন, সেই ‘কাকলী মায়ের’ দেওয়া কোনো একটা মেসেজ পড়ছিলেন ফোনে।

ওপাশে চোখ যেতে দেখলেন, আরেক সাইকেল আরোহী তাঁকে দেখে গতি কমিয়ে এনেছেন। মিতুর মনে হয়েছিল, তিনি কোনো ঝামেলায় পড়েছেন ভেবেই ওই সাইকেল আরোহী অমন করলেন। ঠিক সে সময় পেছন থেকে মোটরসাইকেল এসে ধাক্কা দিল ওপাশের সাইকেল আরোহীকে, এরপর দেখলেন তাঁকে উল্টে পড়ে যেতে। মিতুর প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া ছিল এমন, ‘একদম চিৎকার দিয়েছি।’

ভিক্টোরিয়ার সাবেক পেশাদার সাইক্লিস্ট হেমিং আর কুমিল্লার শখের সাইক্লিস্ট মিতুকে এভাবে মিলিয়ে দিল একটি দুর্ঘটনা। হেমিংয়ের ভাষায়, ভাগ্যই মিলিয়ে দিল তাঁদের। দিন শেষে সবই ঘটে কোনো এক কারণে, ‘থিংস হ্যাপেন ফর আ রিজন!’

৩.
হেমিংয়ের বয়স যখন ১২ বছরের মতো, সাইক্লিং করতে গিয়ে প্রথম বড় দুর্ঘটনায় পড়েছিলেন। কনকাশন। এরপর প্রায় সাত বছর সাইক্লিং বাদ। অবশ্য এ সময়ে ইংল্যান্ড গিয়েছিলেন ওভালে কাজ করতে, সেখানে সামাজিকীকরণের মাধ্যম হিসেবে তাঁর নিয়মিত গন্তব্যস্থল ছিল পানশালা। অস্ট্রেলিয়ায় ফিরে সপ্তাহান্তে তেমন কিছু করার থাকত না বলে আবার সাইকেলে চেপে বসেন।

‘সাধারণত যারা সাইকেল চালায়, এমন দুর্ঘটনা হলে বড় আঘাতটা লাগে কলারবোনে—ভেঙেই যায়। কারণ, ছিটকে যাওয়ার পর দুই হাত মাটিতে ঠেস দেওয়ার একটা সহজাত ব্যাপার কাজ করে। তবে আমার কোনো দিন কলারবোন ভাঙেনি। আমার ধারণা, ছোটবেলাতেই ঠিকঠাক পড়ে যেতে শিখেছিলাম। জীবনে সাইকেল রেস করতে গিয়ে অবশ্য শরীরের অনেকটা চামড়া গেছে’—সম্প্রতি সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে নিজের অফিসে বসে বলছিলেন হেমিং।

ওই দুর্ঘটনার পর মিতুই ছুটে এসেছিলেন, আশপাশে কয়েকজন জড়ো হলেও সেভাবে সহায়তা করার আগ্রহ দেখাননি শুরুতে। মোটরসাইকেলচালক হেমিংয়ের দোষ বলে অর্থও দাবি করে বসেছিলেন। মিতু সাহায্য করেছিলেন তাঁকেও, নেহাত মোটরসাইকেলের ওজন বেশি বলে সেটি তুলে দিতে পারেননি। বিসিবিতে ফোন দেওয়ার পর তাদের পরামর্শে হেমিং যান হাসপাতালে। এক্স-রে থেকে শুরু করে আরও যত পরীক্ষা-নিরীক্ষা—প্রায় চার ঘণ্টার পুরোটা সময় হেমিংয়ের সঙ্গে ছিলেন মিতু।

হাসপাতাল থেকে হেমিং ছাড়া পাওয়ার পরই নাকি মিতু সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়তে চেয়েছিলেন দেশভ্রমণে। হেমিং সেটা মনে করে হাসেন, ‘তখন দুপুর, বাইরে ৩৮ ডিগ্রি। আর সে কিনা বলছে তখন সে রাইডে বের হবে!’

৪.
মিতু ঢাকা থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নরসিংদী, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার ঘুরে তারপর এসেছিলেন সিলেটে। বাংলাদেশ-ভারত সিরিজের জন্য হেমিংও তখন সেখানে। মিতুকে হোটেলে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন সকালের নাশতায়। দুজনের গল্পটা সেখানেই একটু শুনেছিলেন বিসিবির ডেপুটি মিডিয়া ম্যানেজার জাহিদুর রহমান। সেই গল্পের সারমর্মটা তিনি যখন শোনাচ্ছিলেন প্রেসবক্সে দাঁড়িয়ে, মিতু তখন খেলা দেখতে সিলেট স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে। খেলা দেখার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন হেমিংই।

হেমিংয়ের সঙ্গে যেদিন কথা হচ্ছিল, মিতু তার আগের দিন ছিলেন ময়মনসিংহে। দেশভ্রমণে বেরিয়ে প্রতিটি জেলায় এক দিন করে থাকার কথা। কথা বলতে গিয়ে বিচ্ছিন্নভাবে ফেডারেশন, তাঁর উশু ক্লাব, পরিবার, কয়েকজন স্যারের কে কীভাবে সহায়তা করছেন, প্রতি জেলায় সরকারি ডাকবাংলোতে কীভাবে থেকেছেন, কে কোথায় ঘুরে দেখাচ্ছেন—বলে চলেন মিতু। সঙ্গে বলেন হেমিংয়ের কথাও। এই কদিনে তিনিও হয়ে উঠেছেন তাঁর অন্যতম সমর্থক।

হেমিংয়ের একটু দুশ্চিন্তাও আছে মিতুকে নিয়ে। সাইক্লিংয়ের উপযুক্ত পোশাক নেই, এমন টানা সাইক্লিংয়ের অভ্যাস নেই। তার ওপর বাংলাদেশের রাস্তাঘাটের অবস্থাটাও টের পেয়েছেন গত প্রায় এক বছরে, ‘এখানে সবাই যেন ঈশ্বরের হাতে নিজের জীবনটা তুলে দিয়েছে। প্রতিদিন নিশ্চয়ই অনেক মানুষ মারাও যায়! বিসিবির সবাই আমাকে এভাবে সাইকেল নিয়ে বের হতে বারণ করে।’

দুর্ঘটনার পর চিকিৎসকেরা প্রাথমিকভাবে ধারণা করেছিলেন, হেমিংয়ের পা ভেঙেই গেছে। সেটি হয়নি। তবে হাঁটু ফুলে গিয়েছিল, ভেতরে নাকি তরলও জমা হয়েছিল পরে। এখন হাঁটতে পারছেন ঠিকঠাক, তবে সিঁড়ি ভাঙতে কষ্ট হয়। হেমিং অবশ্য জীবনটা উপভোগ করতে চান, ‘আমার বয়স মাত্র ৫৭, একটা অফিসে ডেস্কের সামনে বসে থাকব নাকি!’

মিতুকে তাই ‘মানসিক সমর্থন’ দিয়ে যান হেমিং। তাঁর মন্ত্র, ‘জীবন উপভোগ করতে হবে। ঈশ্বর নিশ্চয়ই একটা পরিকল্পনা করে রেখেছেন। কোনো কিছু তো এমনি এমনি ঘটে না। কারণ থাকে। থিংস হ্যাপেন ফর আ রিজন। হারুন বা জিতুন—কিছু তো করতে হবে। এখনকার বাংলাদেশ দলের মতো। নিশ্চয়ই অনেক কিছু শিখবে। শেখো, ভুল করো, আবার শেখো।’ এরপর মিতুর জন্য প্রার্থনা, ‘আশা করি, সে নিরাপদে দেশটা ঘুরে আসতে পারবে।’

ওই দুর্ঘটনার পর মিতুই ছুটে এসেছিলেন, আশপাশে কয়েকজন জড়ো হলেও সেভাবে সহায়তা করার আগ্রহ দেখাননি শুরুতে। মোটরসাইকেলচালক হেমিংয়ের দোষ বলে অর্থও দাবি করে বসেছিলেন। মিতু সাহায্য করেছিলেন তাঁকেও, নেহাত মোটরসাইকেলের ওজন বেশি বলে সেটি তুলে দিতে পারেননি। বিসিবিতে ফোন দেওয়ার পর তাদের পরামর্শে হেমিং যান হাসপাতালে। এক্স-রে থেকে শুরু করে আরও যত পরীক্ষা-নিরীক্ষা—প্রায় চার ঘণ্টার পুরোটা সময় হেমিংয়ের সঙ্গে ছিলেন মিতু।

হাসপাতাল থেকে হেমিং ছাড়া পাওয়ার পরই নাকি মিতু সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়তে চেয়েছিলেন দেশভ্রমণে। হেমিং সেটা মনে করে হাসেন, ‘তখন দুপুর, বাইরে ৩৮ ডিগ্রি। আর সে কিনা বলছে তখন সে রাইডে বের হবে!’

৫.
কয়েকটা ছবি দরকার—বললে পাশে রাখা একটা চেয়ার তুলে নিলেন হেমিং। বাউন্ডারি সীমানা ঘেঁষে বসে পড়ে বললেন ছবি এমনভাবে তুলতে, যাতে পেছনের পুরো ‘ভিউ’টা আসে। ছবি তোলা শেষ হলে জিজ্ঞাসা, ‘মিতু নাকি এদিকটা ঘুরে ফেলেছে? এরপর কোন দিকে যাবে, জানো নাকি?’

ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, গাজীপুর, মুন্সিগঞ্জ ঘুরে মিতুকে ঢাকা ফিরতে হয়েছিল। কারণটাও জানালেন, ‘ম্যাপটা দেখতে একটু ভুল করে ফেলেছিলাম। এরপর মানিকগঞ্জ যাব। ঢাকা থেকে শুরু করেছিলাম, শেষটা করার ইচ্ছা কুমিল্লায়।’

এদিকে সিলেটে সিরিজ শেষ হলে হেমিংয়ের ফেরার কথা ঢাকায়। বিসিবির সঙ্গে একটা মিটিং হবে বলেছিলেন। এরপর ছুটতে হবে বরিশালে, সেখানে পিচ তৈরির কাজ করছেন। অবশ্য সিলেটের আবহাওয়া দেখে একবার বলেও বসলেন, ‘ভাবছি বাইকটা (সাইকেলকে তাঁরা বাইক বলেন) এখানে আনব।’

সিলেট আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামের আউটার গ্রাউন্ড বা একাডেমি বিল্ডিংয়ের সামনে একটু পর আবার হেমিংয়ের সঙ্গে দেখা, ‘ছবিগুলো একটু পাঠিয়ো তো। স্ত্রীকে পাঠাব। সে তো নিশ্চয়ই ভাবে আমি এখানে কোনো কাজ করি না, শুধু বসে থাকি।’

অবশ্য এ ছবিগুলোতেও তো তিনি বসেই আছেন, এমন মনে করিয়ে দেওয়ার পর হেমিং একটু হাসেন। নিজের অফিসের দিকে হাঁটা দেন এরপর।

ইনবক্সে পাওয়া ছবিগুলো হেমিং হয়তো পার্থে স্ত্রীকে পাঠিয়েছেন। মিতুর গল্পটাও এরই মধ্যে তাঁর কাছে করেছেন নিশ্চয়ই। আর বলেছেন, ‘থিংস হ্যাপেন ফর আ রিজন!’