বগুড়ার দুপচাঁচিয়া উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান প্রার্থী মাহবুবা নাসরিন | ছবি: সংগৃহীত |
প্রতিনিধি বগুড়া: চাকরির নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রে জড়িত থাকার অভিযোগে আড়াই বছর আগে গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) হাতে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। এ ঘটনায় দল থেকে সাময়িক বহিষ্কারের পর বরখাস্ত হয়েছিলেন উপজেলা মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদ থেকে।
এর আগে রাজধানীর ইডেন মহিলা কলেজে ‘সিট বাণিজ্য’ ও ছাত্রলীগের এক পক্ষের ওপর হামলায় জড়ানোর অভিযোগ আছে তাঁর বিরুদ্ধে। আলোচিত সেই মাহবুবা নাসরিন ওরফে রূপা এবার বগুড়ার দুপচাঁচিয়া উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হয়েছেন।
দ্বিতীয় ধাপে ২১ মে হতে যাওয়া উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে মাহবুবা নাসরিন বগুড়ায় একমাত্র নারী প্রার্থী হিসেবে কাপ-পিরিচ প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
মাহবুবা নাসরিন ইডেন মহিলা কলেজ ছাত্রলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের পদে ছিলেন। পরে ২০১৯ সালে দুপচাঁচিয়া উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ২০২০ সালের ২০ ডিসেম্বর তিনি বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের নির্বাহী সদস্যপদ পান।
মাহবুবা ছাড়াও এ উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে আনারস প্রতীকে বর্তমান চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ফজলুল হক প্রামানিক এবং মোটরসাইকেল প্রতীকে উপজেলা যুবলীগের সভাপতি আহম্মেদুর রহমান প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
আয় ও সম্পদের অনেক তথ্যই নেই হলফনামায়
নির্বাচন কমিশনে দাখিল করা হলফনামায় মাহবুবা নাসরিন প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলা থেকে অব্যাহতি পাওয়ার কথা জানিয়েছেন। হলফনামার সঙ্গে দাখিল করা নথিতে তিনি ভাইস চেয়ারম্যানের সম্মানী থেকে বছরে ৩ লাখ ২৪ হাজার টাকা আয়ের তথ্য দিয়েছেন। আয়করের নথিতে নিট সম্পদ ১৭ লাখ ৬৬ হাজার টাকা উল্লেখ করেছেন। তবে আয় ও সম্পদের এসব তথ্য নেই হলফনামায়।
হলফনামায় মাহবুবা নাসরিন পেশা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী এবং বছরে ২ লাখ ৯০ হাজার টাকা আয় করেন বলে জানিয়েছেন। এর মধ্যে বাড়ি ও দোকানভাড়া থেকে আয় বছরে দুই লাখ টাকা। হলফনামায় স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ বিবরণীতে ব্যবসা, প্রতিষ্ঠান বা বাসাবাড়ির তথ্য দেননি মাহবুবা। হলফনামায় জানিয়েছেন, নগদ এক লাখ টাকা, নিজের ১০ ভরি স্বর্ণালংকার এবং এক বিঘা আবাদি জমির ছাড়া ব্যাংকে তাঁর কোনো অর্থ বা সম্পদ নেই।
২০১৯ সালে দুপচাঁচিয়া উপজেলা পরিষদের মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হয়েছিলেন মাহবুবা। সে সময় ধারদেনা করে নির্বাচনী খরচ জোগানোর কথা হলফনামায় জানিয়েছিলেন তিনি। হলফনামার তথ্যানুযায়ী, ওই সময়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের নির্বাচনী ব্যয় মেটানোর জন্য স্বেচ্ছা প্রণোদিত হয়ে ৩ লাখ এবং গ্রামে থাকা বড় চাচা ৩ লাখ টাকা ধার দিয়েছিলেন মাহবুবাকে। ওই সময় বিভিন্নজনের কাছ থেকে দানসূত্রে পাওয়া ১০ তোলা স্বর্ণ ছাড়া তেমন কিছুই ছিল না তাঁর।
মাহবুবা নাসরিন বলেন, একজন আইনজীবীর মাধ্যমে হলফনামা পূরণ করতে গিয়ে তিনি ভুল করে বাসা ভাড়া ও দোকান থেকে বছরে আয় দুই লাখ টাকা উল্লেখ করেছেন। ভাইস চেয়ারম্যান পদ কোনো চাকরি নয়, সম্মানীর অর্থ হলফনামায় জানানোর কোনো বাধ্যবাধকতা না থাকায় তা উল্লেখ করা হয়নি। এর বাইরে হলফনামায় কোনো অসত্য তথ্য প্রদান কিংবা কোনো তথ্য গোপন করা হয়নি।
মামলা থেকে অব্যাহতি
২০২২ সালের ২১ জানুয়ারি প্রতিরক্ষা মহা হিসাব নিরীক্ষকের কার্যালয়ে অডিটর নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের সদস্যরা মাহবুবা নাসরিনকে তেজগাঁও এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে। এ সময় তাঁর কাছ থেকে ইলেকট্রনিক ডিভাইস, মুঠোফোন, অডিটর পরীক্ষার প্রবেশপত্র এবং ১ লাখ ৯৭ হাজার টাকা জব্দ করা হয় বলে জানানো হয়। এ ঘটনায় দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নের অভিযোগে ২৩ জানুয়ারি বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগ থেকে মাহবুবাকে সাময়িক অব্যাহতি দেওয়া হয়। এক দিন পর মাহবুবাকে উপজেলা আওয়ামী লীগ থেকেও বহিষ্কার করা হয়। ওই বছরের ৫ জুন ভাইস চেয়ারম্যান পদ থেকে মাহবুবাকে সাময়িক বরখাস্ত করে স্থানীয় সরকার বিভাগ।
তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা দাবি করেছিলেন, নিয়োগ পরীক্ষায় ডিভাইসের মাধ্যমে প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের সদস্যরা দীর্ঘদিন ধরে জালিয়াতিতে জড়িত। ‘অডিটর’ নিয়োগ পরীক্ষায় চাকরি দেওয়ার কথা বলে ১৮ প্রার্থীর সঙ্গে চুক্তি করেছিল চক্রটি। এর মধ্যে মাহবুবা নাসরিনের ছোট ভাই রানাও আছেন। ২৪ জানুয়ারি ডিবি গুলশান বিভাগের উপপরিদর্শক শহিদুর রহমান রাজধানীর রমনা মডেল থানায় মাহবুবা নাসরিনসহ সহযোগীদের আসামি করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন। দুই দফায় ছয় দিনের রিমান্ড শেষে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে মাহবুবা নাসরিন ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।
মামলাটির তদন্ত শেষে গত বছরের ৪ জুন তদন্তকারী কর্মকর্তা ও ডিবি পুলিশের পরিদর্শক মাকারিয়াস দাস আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। এতে মাহবুবা নাসরিনকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার জন্য সুপারিশ করে তদন্তকারী কর্মকর্তা। পরে মামলাটি বিচারের জন্য ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালে আদালতে পাঠানো হয়। ট্রাইব্যুনাল মামলাটির অধিকতর তদন্তের জন্য সিআইডিকে নির্দেশ দেন। সিআইডির পরিদর্শক মাসুদ পারভেজ তদন্ত শেষে মাহবুবাকে অব্যাহতি দিয়ে সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল করেন।
প্রশ্নপত্র ফাঁস মামলার বিষয়ে মাহবুবা নাসরিন বলেন, ‘দুপচাঁচিয়ায় আমার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী একজন নেতা নেপথ্যে কলকাঠি নেড়ে ওই সময়ে ডিবিতে কর্মরত তাঁর এক আত্মীয়কে দিয়ে সামাজিকভাবে হেয় করতে প্রশ্নপত্র ফাঁস মামলায় আমাকে ফাঁসিয়েছিলেন। ডিবির কর্মকর্তারা আমার ছোট ভাইকে ক্রসফায়ারে দেওয়ার হুমকি ও ভয়ভীতি দেখিয়ে আদালতে স্বীকারোক্তি দিতে বাধ্য করেছিলেন। ষড়যন্ত্র প্রমাণিত হওয়ার পর আওয়ামী লীগ আমার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করেছে, ভাইস চেয়ারম্যানের পদও ফিরে পেয়েছি।’
ইডেনে ‘সিট বাণিজ্যেও’ মাহবুবার নাম
মাহবুবা নাসরিন ইডেন মহিলা কলেজ শাখা ছাত্রলীগের প্রথমে ছাত্রীবিষয়ক সম্পাদক এবং পরে যুগ্ম সম্পাদক ও যুগ্ম আহ্বায়ক পদে ছিলেন। যুগ্ম আহ্বায়কের দায়িত্বে থাকার সময় ২০১৯ সালের ৯ নভেম্বর কলেজের বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলে ‘সিট বাণিজ্য’কে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষ হয়। তখন কলেজ ছাত্রলীগের সদস্য সাবিকুন্নাহার তামান্নার ওপর হামলা চালিয়ে বঁটি দিয়ে কুপিয়ে আহত করার অভিযোগ ওঠে মাহবুবা নাসরিনের বিরুদ্ধে। এ ঘটনার পরপরই ইডেন কলেজ ছাত্রলীগের আহ্বায়ক কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়।
মাহবুবা নাসরিন বলেন, ‘মারামারির সময় আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম না। এক পক্ষের মেয়েরা আমার সমর্থক হওয়ায় প্রতিপক্ষরা ওই ঘটনায় আমাকে জড়িয়ে অপপ্রচার চালিয়েছিল। ওই ঘটনায় আমার যে কোনো সংশ্লিষ্টতা ছিল না, তা ইডেন কলেজ প্রশাসনও জানে।’