মুফতি জহির রায়হান: অসংখ্য (মুতাওয়াতির পর্যায়ের) সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত, দাজ্জালের আত্মপ্রকাশের পূর্বে পৃথিবীতে যখন পরিত্রাণহীন দুঃখ, বিরতিহীন পাশবিকতা, প্রতিকারহীন দুঃশাসন চলবে। সত্যকে লাঞ্ছিত করবে মিথ্যা, ধর্মকে নির্বাসিত করবে অধর্ম, ন্যায়কে পদপিষ্ট করবে অন্যায়।

যখন সুন্দর ও কল্যাণের জন্য চরম দুর্দিন, সদাচার ও সততার জন্য ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ, শিক্ষা ও সংস্কৃতির জন্য ঘোরতর দুর্যোগ, নারী ও দুর্বলের জন্য মৃত্যুময় চারপাশ। কোনো নীতির শাসন চলবে না, কেবলই চলবে ‘জোর যার মুল্লুক তার’- এর রাজত্ব।

মানুষের সমাজ ও জীবন পাপাচার, ব্যভিচার ও স্বেচ্ছাচারের অন্ধ আঘাতে বিবস্ত্র। জুলুমের নিশ্ছিদ্র প্রাচীরের তলে জীবন ও জনতা; আরবে, দেশে দেশে, বিশ্বময়।

দুনিয়ার বড় বড় জাতি ও সভ্যতা আধিপত্যের লড়াইয়ে ক্লান্ত৷ ক্ষয়িষ্ণু। ঠিক তখনই স্বর্গের সুরভি নিয়ে, চিরসত্যের মহিমা নিয়ে, খোদায়ি প্রজ্ঞা ও পবিত্রতার জীবন্ত প্রতিফলন হয়ে পৃথিবীতে আগমন ঘটবে মহানবী হজরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দৌহিত্র হজরত হাসানের (রা.) বংশের উজ্জ্বল নক্ষত্র, খলীফাতুল মুসলিমীন, ‘মুহাম্মাদ বিন আবদুল্লাহ’ ওরফে ইমাম মাহদি (রা.)।

বংশ পরিচয়: নাম-মুহাম্মাদ। বাবার নাম - আবদুল্লাহ। তার মায়ের নাম আমরা কোনো রেওয়ায়েতে পাইনি। যদিও অনেকে বলে থাকেন, তার মায়ের নাম- আমেনা।

বাবার দিক দিয়ে হজরত হাসানের (রা.) বংশধর হবেন এবং মায়ের দিক দিয়ে হজরত হুসাইনের (রা.) বংশধর হবেন। মুখে কিছুটা জড়তা থাকবে। চেহারা খুব সুন্দর হবে। চরিত্র-মাধুরি হুজুর সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মতো হবে। তিনি সুন্নতের পরিপূর্ণ অনুসারী হবেন।

হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, পৃথিবীর জীবন সায়াহ্নে যদি একটি মাত্র দিন অবশিষ্ট থাকে, তবে সেই দিনটিকে আল্লাহ তাআলা দীর্ঘ করে আমার পরিবারস্থ একজন ব্যক্তিকে প্রেরণ করে ছাড়বেন। তার নাম আমর নাম এবং তার পিতার নাম আমার পিতার নাম সদৃশ হবে।
 (তিরমিযী-২২৩০/আবূ দাউদ-৪২৮৪)

বৈশিষ্ট্য: হজরত আবূ সাঈদ খুদরী (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, মাহদী আমার বংশধর। উজ্জ্বল ললাট ও নত নাসিকা বিশিষ্ট। (অর্থাৎ দীর্ঘ নাক তথা অগ্রভাগ কিছুটা সরু এবং মধ্যভাগ কিছুটা স্ফীত, একেবারে চ্যাপটে নয়) ন্যায় ও নিষ্ঠায় পৃথিবী ভরে দিবে, ঠিক যেমন ইতিপূর্বে অত্যাচার-অবিচারে ভরে গিয়েছিল। সাত বছর রাজত্ব করবে। (আবূ দাউদ-৪২৮৭)

হজরত হাসানের (রা.) বংশ থেকে হওয়ার রহস্য: পিতা হজরত আলীর (রা.) শাহাদাতের পর হজরত হাসান (রা.) যখন খলিফা হন, তখন মুসলিম বিশ্বে খলীফা দুজন হয়ে গিয়েছিল (১) হেজায ও ইরাকে হজরত হাসান (রা.)। (২) শাম ও আশপাশের এলাকাগুলোতে মুআবিয়া বিন আবি সুফিয়ান (রা.)।

ছয় মাস শাসনকার্য পরিচালনার পর পার্থিব কোনও উদ্দেশ্য ছাড়াই হযরত হাসান (রা.) সম্পূর্ণ খেলাফত হযরত মুআবিয়াকে (রা.) দিয়ে দিয়েছিলেন। যাতে এক শাসকের অধীনে মুসলমান একতাবদ্ধ হয়ে যায়। মুমিনদের পারস্পরিক রক্তপাত বন্ধ হয়ে যায়।

হাদিসে আছে, আল্লাহ তাআলার জন্য যে ব্যক্তি কোনও কিছু ত্যাগ করল, আল্লাহ তাআ'লা তাকে এবং তার বংশধরকে এর চেয়ে উত্তমবস্তু দান করবেন। (আল মানারুল মুনীফ-১৫১)

রাজত্বকাল: সাত বছর তিনি মুসলমানদের নেতৃত্ব দিবেন। ন্যায়-নিষ্ঠায় পৃথিবী ভরে দিবেন। ঠিক যেমন পূর্বে অন্যায়-অবিচারে ভরে গিয়েছিল। তাঁর রাজত্বকালে বিশ্ব সুখ স্বাচ্ছন্দ্যে পূর্ণ হয়ে উঠবে। ভূ-পৃষ্ঠ সকল গচ্ছিত খনিজ সম্পদ প্রকাশ করে দিবে। আকাশ ফসলভরা বৃষ্টি বর্ষণ করবে। বে-হিসাব মানুষের মাঝে তিনি ধন-সম্পদ বন্টন করবেন।

প্রকাশস্থল: প্রাচ্য থেকে আত্মপ্রকাশ করবেন। একা নয়; প্রাচ্যের একদল নিষ্ঠাবান মুজাহিদও তার সঙ্গে থাকবেন। দ্বীনের ঝান্ডা বুকে নিয়ে শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে থাকবেন।

প্রকাশকাল: মুসলিম বিশ্বে অধিক সংঘাতকালে তিনজন খলিফা-সন্তান কা'বা ঘরের কর্তৃত্ব নিয়ে যুদ্ধে লেগে যাবে। কেউ-ই সফল হবে না। তখনই মক্কায় ইমাম মাহদির (রা.) আবির্ভাব হবে। দ্রুত মানুষের মাঝে সংবাদ ছড়িয়ে পড়বে। লোকেরা হাজরে আসওয়াদ ও মাকামে ইবরাহীমের মাঝে তার হাতে বাইয়াত গ্রহণ করবে।

হজরত ছাওবান (রা.) ও  হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তোমাদের রত্ন-ভান্ডারের (কাবার) কাছে তিনজন খলীফা-সন্তান যুদ্ধ করতে থাকবে। কেউ-ই দখলে সফল হবে না। প্রাচ্য থেকে তখন একদল কালো ঝাণ্ডাবাহী লোকের আবির্ভাব হবে। তারা এসে (তোমাদের কাছে) নেতৃত্ব চাইবে, কিন্তু তখনকার নেতৃস্থানীয়রা তাদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে অস্বীকার করবে। ফলে তারা যুদ্ধ করবে। যুদ্ধে তাদের (আল্লাহর পক্ষ থেকে) সাহায্য করা হবে। তারা তোমাদেরকে এমনভাবে হত্যা করবে, যেমনটি ইতিপূর্বে কেউ (কখনো) করেনি। অতএব, তারা বিজয়ী হবে।

অতঃপর তাদের নেতৃত্ব দেওয়া হবে; কিন্তু এবার তারা তা গ্রহণ না করে আমার পরিবারস্থ এক লোকের হাতে সোপর্দ করে দিবে। যে জমিনকে ন্যায়-ইনসাফে ভরে দিবে। ঠিক যেমনিভাবে ইতিপূর্ব জুলুম অত্যাচারে ভরে দেওয়া হয়েছিল।

সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারাই তখন উপস্থিত থাকবে, তারা যেন এসে তার কাছে বাইয়াত হয়ে যায়। যদিও তোমাদের এমনটি করতে হামাগুড়ি দিয়ে বরফের পাহাড় পাড়ি দিতে হয়।  (ইবনে মাজাহ-৪০৮৪ ; আল-বাযযার, আল-বাহরুয যাখ্খার-১০/১০০ ; হাকেম আল-মুসতাদরাক আলাস সহীহাইনি-৮৬৫৫)

আল্লামা ইবনে কাসির (রহ.) বলেন, ইমাম মাহদিকে (রা.) প্রাচ্যের নিষ্ঠাবান একটি দলের মাধ্যমে শক্তিশালী করা হবে। তারা ইমাম মাহদিকে সহায়তা করবে এবং ইমাম মাহদির রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করবে। তাদের পতাকা কালো বর্ণের হবে। একটা গাম্ভীর্যের প্রতীক। কারন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের  পতাকাও কালো ছিল। নাম ছিলো উকাব। (আন-নিহায়া-২৭)

লেখক: মুফতি ও উপাধ্যক্ষ, জিয়াউল উলূম মাদ্রাসা, বরাকৈর, ধামরাই, ঢাকা।