মসজিদে যেতে শতবর্ষী অন্ধ মুয়াজ্জিনের 'অবলম্বন' দড়ি আর বাঁশ

রশি ধরে-ধরে মসজিদে যাচ্ছেন দৃষ্টিহীন মুয়াজ্জিন মো. আব্দুর রহমান মোল্লা | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

প্রতিনিধি নাটোর: প্রায় ২০ বছর আগে এক দুর্ঘটনায় দৃষ্টিশক্তি হারান আব্দুর রহমান মোল্লা। এর ৬ বছর পর বড় ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে পবিত্র হজ পালন করেন। দেশে ফিরে নিজ গ্রামে ৫ শতাংশ জমির ওপর তৈরি করেন একটি পাকা মসজিদ। মসজিদের নামেই তিনি জমিটি রেজিস্ট্রি করে দেন। এরপর নিজেই সেই মসজিদের মুয়াজ্জিন হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করেন। কিন্তু জটিলতা দেখা দেয় মসজিদে আসা-যাওয়া নিয়ে। সেই প্রতিবন্ধকতাও জয় করে ফেলেছেন শতবর্ষী এই বৃদ্ধ। এজন্য বাড়ি থেকে মসজিদ পর্যন্ত টেনে নিয়েছেন দড়ি ও বাঁশ। এরপর দড়ি আর বাঁশের সাহায্যে নিয়মিত মসজিদে যাচ্ছেন, আজান দিচ্ছেন, ৫ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করছেন।

আব্দুর রহমান মোল্লার বাড়ি নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার নগর ইউনিয়নের বড়দেহা গ্রামে। দৃষ্ট বড় ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে ২০১১ সালে পবিত্র হজ্ব পালন করে এসেছেন।

স্থানীয় ও পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, আব্দুর রহমান মোল্লার ২ সংসারে রয়েছে ২৫ ছেলে-মেয়ে। এর মধ্যে ৬ জন বিভিন্ন সময় মারা যান। বর্তমানে তার ১০ মেয়ে ও ৯ ছেলে বেঁচে আছেন। সকল ছেলে-মেয়েকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন তিনি। করেছেন উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত। এদের মধ্যে কেউ হয়েছেন শিক্ষক, কেউ কৃষি কর্মকর্তা, কেউ চিকিৎসক, কেউ আছেন বিজিবিতে, কেউ করছেন ব্যবসা, কেউ আবার নিজেদের জমিজমা দেখাশোনা করেন। দৃষ্টিশক্তি হারানোর পর ২০১১ সালে বড় ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে পবিত্র হজ পালন করেন আব্দুর রহমান মোল্লা। দেশে ফিরে একই বছর বড়দেহা গ্রামে ৫ শতাংশ জমির ওপর মসজিদটি তৈরি করেন তিনি। এরপর গ্রামের মানুষ, ছেলে ও নাতীদের নিয়ে সেখানে নামাজ আদায় শুরু করেন।

আযান দিচ্ছেন মুয়াজ্জিন আব্দুর রহমান মোল্লা | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

আব্দুর রহমান মোল্লার ছেলে আলহাজ্ব মো. শফিকুল ইসলাম সাইফুল (মাস্টার) জানান, হজ পালন করে আসার পর তার বাবা যে মসজিদটি স্থাপন করেছেন সেখানে ৫ ওয়াক্ত নামাজের আজান দেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন। কিন্তু বাড়ি থেকে মসজিদের দূরত্ব প্রায় ২০০ মিটার। তখনই জটিলতা দেখা দেয় আসা-যাওয়া নিয়ে। সেই জটিলতাও নিরসনের পথ বাতলে দেন আব্দুর রহমান মোল্লা নিজেই। বাড়ি থেকে মসজিদ পর্যন্ত রাস্তায় দড়ি ও বাঁশ টানিয়ে দিতে বলেন।

মসজিদে মুসল্লিদের সাথে আব্দুর রহমান মোল্লা | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

বাবার দেওয়া পরামর্শ অনুযায়ী দড়ি ও বাঁশ টানিয়ে দেন ছেলেরা। এরপর প্রথমদিকে কয়েকদিন তার ছেলে ও নাতিরা দড়ি ও বাঁশের সাহায্যে মসজিদ পর্যন্ত নিয়ে গিয়ে তাকে যাতায়াত ও রাস্তা পার হতে অভ্যস্ত করে তোলেন। এ ছাড়া বাশ ও দড়ি খুঁজে পেতে তার হাতে তুলে দেওয়া হয় একটি লাঠিও। এভাবে কয়েকদিন দেখিয়ে দেওয়ার পর আর কারও সাহায্য নিতে হয়নি শতবর্ষী এই বৃদ্ধকে। এরপর থেকে তিনি নিজেই দড়ি ও বাঁশের সাহায্যে বাড়ি থেকে মসজিদে যাচ্ছেন, আজান দিচ্ছেন এবং ৫ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করছেন।

তার আরেক ছেলে মো. রফিকুল ইসলাম (মাস্টার) জানান, তার বাবার বয়স প্রায় ১১৫ বছর। বাবার এমন মহৎ কাজে তিনিসহ পরিবারের সবাই খুবই খুশি। বাবার জন্য সবার কাছে দোয়া চেয়েছেন তিনি।

বৃদ্ধের নাতী মো. নাইম হোসাইন জানান, দাদার এমন মহৎ কাজে উৎসাহী হয়ে সে নিজেও মসজিদে যাওয়া শুরু করেছে। 

এভাবেই বাঁশ ও রশির সাহায্যে মসজিদে আসা-যাওয়া করেন দৃষ্টিহীন আব্দুর রহমান মোল্লা | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

আব্দুর রহমান মোল্লা জানান, এই বয়সেও আল্লাহ তাকে অনেকটা সুস্থ রেখেছেন। রাস্তা পারাপারের সময় ঝুঁকি থাকলেও তিনি বিশ্বাস করেন আল্লাহ তাকে সকল বিপদ থেকে হেফাজত করে গন্তব্যে পৌঁছে দেবেন। একইসঙ্গে তিনি সকল প্রাপ্তবয়স্ক মুসলমানকে নিয়মিত নামাজ আদায়েরও আহ্বান জানান।

রাজশাহী নাজাত হাফিজিয়া কওমিয়া মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক হাফেজ মাওলানা মো. আব্দুল মজিদ বলেন, আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম রাসূলের (সা.) জন্য আজান দিতেন। তিনিও অন্ধ ছিলেন। আব্দুর রহমান মোল্লা এই বয়সেও ইসলামের খেদমতে কাজ করছেন। তিনি অনেকের জন্যই অনুপ্রেরণা হতে পারেন। এখনও যারা নিয়মিত নামাজ আদায় করেন না, তারাও তাকে দেখে আগ্রহী হবেন।