শাহরিয়ার হাসান ও হিমেল চাকমা: ‘আমি স্বেচ্ছায় চলে এসেছি। ভুলটা আমারই ছিল। তোমরা কাউকে দোষ দিয়ো না। আমার আর বাড়িতে ফেরার কোনো সুযোগ নেই। ১০ মিনিট পর আমার বিমান ছেড়ে দেবে। মোবাইলেও পাওয়া যাবে না। আমার নামে বদনাম ছড়িয়ে দিয়ো না।’

২ এপ্রিল ছোট বোনের মোবাইল ফোনে এই বার্তা পাঠায় রাঙামাটির নানিয়ারচর উপজেলার বুড়িঘাট ইউনিয়নের এক পাহাড়ি তরুণী। এর এক দিন আগে থেকে তাঁর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না। বোনকে ওই বার্তা দিয়ে তিনি পাড়ি জমান চীনের পথে। চীনে নারীদের ব্যাপক চাহিদা আছে। এক সন্তান নীতির মারপ্যাঁচে পড়ে দেশটিতে এখন নারীর চেয়ে পুরুষের সংখ্যা অনেক বেশি। অনেক পুরুষ বিয়ের জন্য নারী পাচ্ছে না।

সেই সুযোগ কাজে লাগাতে মাঠে সক্রিয় পাচারকারী চক্র। বাংলাদেশের পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে চীনাদের চেহারার মিল আছে। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে চক্রের সদস্যরা উন্নত জীবনযাপনের লোভ দেখিয়ে পাহাড়ি পরিবারগুলোকে রাজি করাচ্ছে। এরপর তরুণী-কিশোরীদের পাচার করা হচ্ছে চীনে। এ কাজে সুবিধার জন্য অনেক সময় এ দেশেই চীনাদের সঙ্গে বিয়ের ব্যবস্থা করা হচ্ছে বা বিয়ের জাল কাগজ তৈরি করা হচ্ছে।

ওয়াকিবহাল সূত্র বলছে, এভাবে চক্রের সদস্যরা গত সাত বছরে ৮ হাজারের বেশি কিশোরী-তরুণীকে চীনে পাচার করেছে। তাদের কাউকে কাউকে যৌনপল্লিতে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। আবার অনেককে বাসায় আটকে রেখে শারীরিক নির্যাতন করা হয়। জীবন বাঁচাতে কেউ কেউ পালিয়ে দেশে ফিরে এসেছেন দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে। 

এভাবে বিয়ের নামে পাহাড়ি নারীদের পাচারের বিষয়ে জানতে চেয়ে ঢাকায় চীনা দূতাবাসে ১৫ এপ্রিল  পত্রিকার পক্ষ থেকে ই-মেইল করা হয়েছিল। এরপর এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত দূতাবাস কোনো জবাব দেয়নি।

পুলিশ সদর দপ্তর বলছে, চীনে নারী পাচারের বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে তাদের কাছে কোনো তথ্য নেই।

রাঙামাটির পুলিশ সুপার মীর আবু তৌহিদ বলেন, ভুক্তভোগী পরিবারের পক্ষ থেকে কখনো কোনো অভিযোগ আসে না। তবে বিষয়গুলো তাঁরা জানেন।

আর খাগড়াছড়ির পুলিশ সুপার মুক্তা ধর বলেন, ‘নারী পাচার নিয়ে এ পর্যন্ত খাগড়াছড়ি পুলিশের কাছে কেউ অভিযোগ দেয়নি।’ যদিও নানিয়ারচর উপজেলার ওই তরুণী দেশ ছাড়ার দুই দিন পরও থানায় নিখোঁজের ডায়েরি করে। ডায়েরিতে এ ঘটনার সঙ্গে দুজনের সম্পৃক্ততার অভিযোগও করা হয়।

যারা যেভাবে টার্গেট
নানিয়ারচরের ভুক্তভোগী পরিবারটির সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চীনে এ যাত্রায় ওই তরুণীর সঙ্গী হয়েছে একই এলাকার আরও ছয়জন। আর পাচারকারী চক্রে নাম এসেছে লিমা চাকমা নামের এক নারীর। তিনি চট্টগ্রামের ব্যারিস্টার কলেজ এলাকায় এক ফ্ল্যাটে থাকতেন। এক বছর আগে এক চীনা নাগরিককে বিয়ে করে তিনি চীনে চলে যান। লিমার ছোট ভাই লিমন চাকমা ও বোন শোভারানী চাকমাও চক্রের সদস্য।

অনুসন্ধানে জানা যায়, লিমা চাকমাদের মতো অন্তত আরও ২৫-৩০টি চক্র পাহাড়ে কাজ করছে। পাচারের পর উদ্ধার একাধিক নারী ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পাচারের শিকার হচ্ছেন অধিকাংশ নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়েই। পরিবারের অভাব, মা-বাবার অসচেতনতা, বিয়ের প্রলোভন, চাকরি ও চীনে নাগরিকত্বের লোভে পড়ে মেয়েরা চীনাদের পাতা ফাঁদে পা দিচ্ছে। নাম প্রকাশের অনিচ্ছুক ভুক্তভোগী পরিবারের কেউ কেউ বলছেন, শিক্ষা-দীক্ষায় পিছে থাকায় মূল সমাজের সঙ্গে তাল মেলাতে না পেরেও অনেকে এ পথে পা বাড়াচ্ছে।

৮ থেকে ২০ লাখ টাকা লেনদেন
স্থানীয় ও ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একজন নারীকে পাচারের জন্য সর্বনিম্ন ৮ লাখ টাকা লেনদেন করে চক্রটি। তবে এ টাকা কমবেশি হয় বয়স আর চেহারার ওপরে। কম বয়সী মেয়েদের জন্য ১৫-২০ লাখ টাকা পর্যন্তও লেনদেন হয়। এই টাকার অধিকাংশ চলে যায় চক্রের হাতে। কিছু টাকা ব্যয় হয় পাসপোর্ট, ভিসা ও ঢাকায় থাকায়-খাওয়ার জন্য। ভুক্তভোগী পরিবারও এখান থেকে এক-দেড় লাখ টাকা পায়।

প্রতিবেদকের কাছে পাচার চক্রের সদস্যদের ফেসবুকে কথোপকথনের একটি স্ক্রিনশট এসেছে। তাতে দেখা যায়, জ্যাসি চাকমা নামের এক পাচারকারী এক নারীকে ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য ৪ লাখ টাকা দেওয়ার আশ্বাস দেন। তাঁর ৪ লাখের বাইরে চীনে যেতে ইচ্ছুক ওই নারীর পরিবারকেও টাকা দেওয়া হবে বলে জানান। তবে মেয়েটিকে ঢাকায় পৌঁছে দেওয়ার শর্ত দেওয়া হয়। জ্যাসি চাকমা যে চক্রে কাজ করেন, সেই চক্রের হোতা সজিব চাকমা।

ঢাকায় চলে সৌন্দর্যবর্ধন
সবকিছু গুছিয়ে পাচারের জন্য প্রথমে কাউকে পাহাড় থেকে এনে ঢাকায় তোলা হয়। রাজধানীতে মাসখানেক রেখে নারীদের সৌন্দর্য বৃদ্ধির কাজ করা হয়। একপর্যায়ে তাদের ছবি তুলে চীন ও তাইওয়ানে থাকা পাচার চক্রের সদস্যর কাছে পাঠানো হয়। কোনো মেয়েকে পছন্দ হলে চক্রের কোনো সদস্য চীনা নাগরিককে বর বানিয়ে বাংলাদেশে পাঠায়। ভিসা পাওয়ার সুবিধার্থে চীনা নাগরিকের সঙ্গে আদালতে বিয়ের ব্যবস্থা করা হয়। বিয়ে হলে কখনো দ্রুত, কখনো দুই-তিন মাস পর সেই নারীকে চীনে নেওয়া সম্ভব হয়।

চীনে গিয়ে নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফেরা এক নারীর সঙ্গে কথা হয়েছে। তিনি জানান, চীনে নিয়ে তাঁদের একপ্রকার নিলামে ওঠানো হয়। তাঁদের মধ্যে থেকে কাউকে সত্যি বউ করে বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়। আবার কাউকে বাসাবাড়ি বা যৌনপল্লিতে আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়।

কী বলছে এলাকার মানুষ
সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, পাহাড়ের প্রায় সব উপজেলা থেকেই পাচার হচ্ছে। তবে রাঙামাটি সদর, জুরাছড়ি, বরকল, লংগদু, কাউখালী এবং খাগড়াছড়ির দিঘিনালা থেকে সবচেয়ে বেশি নারী পাচার হয় বলে জানা গেছে।

খাগড়াছড়ি শহরের পানখাইয়াপাড়ার বাসিন্দা প্রকাশ চাকমা বলেন, পানখাইয়াপাড়ায় তাঁর কাপড়ের ব্যবসা ছিল। দিঘিনালা থেকে স্কুল ও কলেজপড়ুয়া এক ছাত্রী তাঁর শোরুমে বিক্রয়কর্মী হিসেবে কাজ করত। গত মার্চের প্রথম সপ্তাহে মেয়েটি হারিয়ে যায়। পরে জানতে পারেন মেয়েটি রাঙামাটি ছেড়ে ঢাকায় চলে গেছে। বিয়ে করে চীনে যাবে।

সম্প্রতি রাঙামাটির কাউখালী উপজেলার ঘাগড়া থেকে স্কুলপড়ুয়া চারজন মেয়েকে পাচার চক্রের হাত থেকে উদ্ধার করেছেন স্থানীয় লোকজন। ঘাগড়া উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক চন্দ্রা দেওয়ান বলেন, কয়েক মাসের ব্যবধানে ঘাগড়া এলাকা থেকে তিন মেয়ে চীনে চলে গেছে।

চক্রের সঙ্গে কারা জড়িত
৭-৮ বছর আগে চীনে যখন নারী পাচার শুরু হয় তখন এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন দু-একজন। কিন্তু এখন আর কোনো একক হোতা নেই। অনন্ত ২৫-৩০টি চক্র আলাদা আলাদাভাবে কাজ করে। যারা নিজেদের মতো চক্রের আন্তর্জাতিক সদস্য চীনা গ্রুপে সঙ্গে যোগাযোগ করে চীনে যেতে ইচ্ছুক কিশোরী ও তরুণীদের ছবি পাঠিয়ে দিচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, পাচার চক্রের সক্রিয় এক আন্তর্জাতিক সদস্য সোনালী চাকমা নিকো। তিনি বাংলাদেশি নাগরিক হয়েও বিদেশে বসে নারী পাচার এই চক্রের নেতৃত্ব দেন। অনলাইনে পাওয়া তাঁর নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করে দেশে থাকা একাধিক গ্রুপ।

ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেন, নারী পাচারে সঙ্গে জড়িত এমন আরও কয়েকটি চক্রের মধ্যে খাগড়াছড়ির দিঘিনালার কলি চাকমা, রিকা চাকমা, ছোট কলি চাকমা, প্রিয়াংকা চাকমা, পিউমনি চাকমা, নিক্সন চাকমা, রিকন চাকমা, পানছড়ি উপজেলার রুবিতা চাকমা, রাঙামাটির পূজা চাকমা, হেয়ালি চাকমা, একই জেলার বরকল উপজেলার সুবলং ইউনিয়নের পপি চাকমা, বরুন চাকমা, আশা চাকমা, ভূষণছড়া ইউনিয়নের ঠেগামুখ এলাকার সজীব চাকমা, তাঁর ছোট বোন জ্যাসী চাকমা, লিসা চাকমা, নানিয়ারচর উপজেলার সুপম চাকমা, কাউখালী উপজেলার ঘাগড়া ইউনিয়নের মাহজনপাড়ার রিপন চাকমা, তাঁর স্ত্রী, একই এলাকার কোকো চাকমা ও তাঁর স্ত্রী, রাঙামাটি শহরের রাঙাপানী এলাকার শংখমালা চাকমা, টুক্কপুদি চাকমা, মিতা চাকমা, ভেদভেদীর উলুছড়া গ্রামের টুম্পা চাকমা শিউলী, মানিকছড়ির লিমন চাকমা, শোভা রানী চাকমা, জুরাছড়ি উপজেলার নতুনবাজার এলাকার অঞ্জলী চাকমা, লাকী চাকমা দুমদুম্যা ইউনিয়নের মন্দিরাছড়া গ্রামের বকুল বালা চাকমা, তাঁর মেয়ে যতিকা চাকমাসহ অনেকের নাম রয়েছে।

সচেতনসমাজ যা বলছে
পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটি সভাপতি গৌতম দেওয়ান বলেন, ‘হঠাৎ চীনে নারী যাওয়া বেড়ে গেছে। লোকমুখে এমনটাই শুনছি। কিন্তু এ পর্যন্ত আসলে কতজন নারী চীনে গেছে, সে তথ্য আমাদের কাছে নেই।’

জানতে চাইলে বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত আইজি নব বিক্রম কিশোর ত্রিপুরা বলেন, ‘পাহাড়ি নারী পাচার প্রতিরোধে সরকারকে কাজ করতে হবে। যারা না বুঝে প্রতারণার ফাঁদে পা দিয়ে চীনের পথে পা বাড়িয়েছে, তাদের ফেরাতে দূতাবাস ইন্টারপোলের সহযোগিতা চাইতে পারে।’

রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিট (রামরু) প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, ‘ভারত ও পাকিস্তানে নারী পাচারকারীদের অনেকটা আটকানো গেছে অনেক কিছু করে। এখন চীনে পাচার শুরু হয়েছে। সরকারের উচিত বিদেশিদের বিয়ে করার বিষয়ে আইনে আরও কড়াকড়ি আরোপ করা। তাহলেই এ ধরনের পাচার বন্ধ হবে। পাশাপাশি পাহাড়িদের সচেতন করতে হবে। এই দায়িত্বটা সরকারকেই নিতে হবে।’