কাজী নজরুল ইসলাম | কোলাজ: পদ্মা ট্রিবিউন |
কামরুল ইসলাম: দুঃখ-দারিদ্র্য ছিল তার আজন্ম সঙ্গী। সেই দুঃখকেই পরম আদরে পোষ মানিয়ে নিয়েছেন। আর ফুটিয়েছেন বেদনার ফুল, কবিতার ছন্দে, গানের সুরে। দ্রোহের আগুন যেমন জ্বলেছে তার শব্দের অন্দরে, সমান্তরালে জায়গা করে নিয়েছে প্রেমের গভীরতম অনুভব আর সাম্যের জয়গান। তিনি কাজী নজরুল ইসলাম। বাংলাদেশের জাতীয় কবি।
আজ ১১ জ্যৈষ্ঠ ২৫ মে কবির ১২৫তম জন্মবার্ষিকী। ১৩০৬ বঙ্গাব্দের (১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দ) এই দিনে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। কবির জন্মদিন উদযাপনে জাতীয় ও বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন আয়োজন হচ্ছে। সেসব আয়োজনের টুকরো তথ্য রইলো এখানে…
উৎসব
কাজী নজরুল ইসলামের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে একাধিক উৎসব অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ময়মনসিংহের ত্রিশালের নজরুল অডিটোরিয়ামে চলছে তিন দিনব্যাপী উৎসব। বৃহস্পতিবার (২৩ মে) এটি উদ্বোধন করেছেন ত্রাণ ও পুনর্বাসন প্রতিমন্ত্রী মহিববুর রহমান এমপি। এছাড়া ত্রিশালের নজরুল স্কুল মাঠে বসেছে নজরুল মেলা।
তরুণ ও বৃদ্ধ বয়সে কাজী নজরুল ইসলাম | ছবি: সংগৃহীত |
গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার কাওরাইদ কালি নারায়ণ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে হতে যাচ্ছে ‘ভাগ হয়নিকো নজরুল’ শীর্ষক এক দিনব্যাপী উৎসব। এটি আয়োজন করেছে ঢাকাস্থ ভারতীয় হাই কমিশনের ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টার। সহযোগিতায় নেতাজী সুভাষ-কাজী নজরুল স্যোশাল অ্যান্ড কালচারাল ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট। এতে থাকছে সেমিনার, আবৃত্তি ও সংগীতানুষ্ঠান।
সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ও তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। শনিবার বিকাল ৪টায় জাতীয় জাদুঘরে এর উদ্বোধন করবেন সংসদ উপনেতা বেগম মতিয়া চৌধুরী।
নজরুল পুরস্কার
২০২২ সাল থেকে দেওয়া হচ্ছে এই পুরস্কার। নজরুল সাহিত্যের গবেষণা, অনুবাদ ও নজরুল সংগীতের চর্চায় যারা অবদান রাখছেন, তাদের মধ্য থেকে বাছাই করে গুণীজনদের পুরস্কারটি দেয় বাংলা একাডেমি। এ বছর পুরস্কার পেয়েছেন অধ্যাপক রাজিয়া সুলতানা। গত বৃহস্পতিবার (২২ মে) বাংলা একাডেমির কবি শামসুর রাহমান সেমিনার কক্ষে আনুষ্ঠানিকভাবে পুরস্কার তুলে দেওয়া হয়। তবে রাজিয়া সুলতানা বিদেশে থাকায় তার পক্ষে সম্মাননা গ্রহণ করেছেন ডা. মোমেনা খাতুন।
নজরুল পুরস্কার প্রদান করেছে বাংলা একাডেমি | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
পশ্চিমবঙ্গ থেকেও কাজী নজরুল ইসলামের স্মরণ-শ্রদ্ধায় পুরস্কার দেওয়া হয়। সেখানকার উদার আকাশ পত্রিকা ও প্রকাশনের পক্ষ থেকে প্রদান করা হয় ‘কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতি পুরস্কার’ নামের এই সম্মাননা। এবার এটি দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশের লেখক আবু সাঈদকে।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর বাণী
কবির জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন তার বাণীতে বলেন, ‘ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এবং মহান মুক্তিযুদ্ধসহ বাঙালির প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে নজরুলের কবিতা ও গান।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘কবি নজরুল তার প্রত্যয়ী ও বলিষ্ঠ লেখনীর মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষকে মুক্তি সংগ্রামে অনুপ্রাণিত ও উদ্দীপ্ত করেছেন। নজরুল সাহিত্যের বিচিত্রমুখী সৃষ্টিশীলতা আমাদের জাতীয় জীবনে এখনও প্রাসঙ্গিক। কবি নজরুল যে অসাম্প্রদায়িক, বৈষম্যহীন, শোষণমুক্ত ও শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখতেন, তারই প্রতিফলন আমরা পাই জাতির পিতার সংগ্রাম ও কর্মে।’
রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা | ছবি: সংগৃহীত |
কবির জীবন ও কর্ম নতুন প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দিতে সরকার গত ১৫ বছরে বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছে বলেও বাণীতে জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি কবির ১২৫তম জন্মবার্ষিকীর সকল কর্মসূচির সাফল্য কামনা করেছেন।
বিটিভির আয়োজন
জাতীয় কবির জন্মদিনে বরাবরই বর্ণিল আয়োজন রাখে রাষ্ট্রায়ত্ব টেলিভিশন চ্যানেল বিটিভি। ব্যতিক্রম হয়নি এবারও। শনিবার (২৫ মে) রাত ৯টায় প্রচার হবে হবে নাটক ‘কারারুদ্ধ নজরুল’। মোঃ নজরুল ইসলামের রচনায় নাটকটি প্রযোজনা করেছেন সাাহরিয়ার মোহাম্মদ হাসান। অভিনয়ে আছেন ঝুনা চৌধুরী, সমু চৌধুরী, মোমেনা চৌধুরী প্রমুখ।
‘কারারুদ্ধ নজরুল’ নাটকের দৃশ্য | ছবি: সংগৃহীত |
এছাড়াও থাকছে আলেখ্যানুষ্ঠান ‘সৃষ্টির মহানন্দে’। নাসির উদ্দিনের প্রযোজনায় এটি উপস্থাপনা করবেন ড. সৌমিত্র শেখর। এতে সংগীত পরিবেশন করছেন খায়রুল আনাম শাকিল, ফাতেমা তুজ জোহরা, ইয়াকুব আলী খান ও ছন্দা চক্রবর্তী। আলোচনা ও আবৃত্তিতে নজরুল গবেষক মুন্সি আবু সাইফ।
শিশুদের জন্য সাজানো হয়েছে ‘মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম’ অনুষ্ঠান। যেখানে থাকছে নাচ, গান, কবিতা আবৃত্তি ও নাটিকা। উপস্থাপনায় ড. নাশিদ কামাল। ওয়ারদা রিহাবের পরিচালনায় দেখা যাবে নজরুল সাহিত্য নিয়ে নৃত্যনাট্য ‘চির উন্নত মম শির’।
নতুন গান
কাজী নজরুল ইসলামের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে একাধিক নতুন গান প্রকাশের খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে একটির শিরোনাম ‘সোনার গোধূলী রাগে’। এটি গেয়েছেন সুস্মিতা দেবনাথ শুচি, মোহিত খান, মনীষ সরকার ও মিরাজুল জান্নাত সোনিয়া। তারা চারজনই ছায়ানটের শিক্ষক। তাদের গানটি মূলত কাজী নজরুল ইসলামের তিনটি গান ‘পরদেশী মেঘ’, ‘আজও কাঁদে কাননে’ ও ‘আবার ভালোবাসার সাধ জাগে’র সমন্বয়ে সাজানো। এর মিউজিক কম্পোজিশন করেছেন তৌসিফর রহমান। গানটি প্রকাশ করেছে জি সিরিজ।
‘সোনার গোধূলী রাগে’ গানের শিল্পীরা | ছবি: সংগৃহীত |
আরেকটি গানের শিরোনাম ‘কাজী নজরুল’। এটি কবিকে ঘিরেই তৈরি করা হয়েছে। লিখেছেন ও সুর করেছেন অনুরূপ আইচ। গানটি গেয়েছেন জিন্নাহ খান। সংগীতায়োজনে জাহিদ বাশার পংকজ। এটি প্রকাশ হয়েছে জেড মিউজিক আর্টের ব্যানারে।
এক নজরে নজরুল
কবি হিসেবে তার সর্বাধিক খ্যাতি। তবে পাশাপাশি তিনি একজন গল্পকার, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, শিশু সাহিত্যিক, অনুবাদক, প্রাবন্ধিক, সম্পাদক, সাংবাদিক, গীতিকার, সুরকার, স্বরলিপিকার, গীতিনাট্যকার, গীতালেখ্য রচয়িতা, চলচ্চিত্র কাহিনিকার, চলচ্চিত্র পরিচালক, সংগীত পরিচালক, গায়ক, বাদক ও সংগীতজ্ঞ।
বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, জীবনের শেষ ৩৪ বছর সাহিত্যচর্চা থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। অর্থাৎ তার গোটা সাহিত্যসম্ভার কেবল ২৩ বছরের চর্চা। এর মধ্যেই তিনি নিজেকে বিংশ শতাব্দীর প্রধান বাংলা কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তার রচিত সাহিত্যকর্মের মধ্যে আছে ২২টি কাব্যগ্রন্থ, সাড়ে ৩ হাজার মতান্তরে ৭ হাজার গানসংবলিত ১৪টি সংগীত গ্রন্থ, তিনটি কাব্যানুবাদ, তিনটি উপন্যাস গ্রন্থ, তিনটি নাটক, তিনটি গল্পগ্রন্থ, পাঁচটি প্রবন্ধ, দুটি কিশোর নাটিকা, দুটি কিশোর কাব্য, সাতটি চলচ্চিত্র কাহিনি ইত্যাদি।
সংগীত চর্চায় কাজী নজরুল ইসলাম | ছবি: সংগৃহীত |
১৯৪২ সালে স্নায়বিক অসুস্থতায় পড়েন কাজী নজরুল ইসলাম। সেখান থেকে আর সেরে উঠতে পারেননি। ১৯৭২ সালের ২৪ মে তাকে অসুস্থ অবস্থায় কলকাতা থেকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। সেই সঙ্গে তাকে বাংলাদেশের জাতীয় কবির মর্যাদা দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এছাড়া তার রচিত ‘চল্ চল্ চল্- ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল’ গানটিকে দেশের সামরিক সংগীত হিসেবে নির্বাচিত করা হয়।
১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট তৎকালীন পিজি (বর্তমান বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান কবি। তাকে সমাহিত করা হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে।