খরায় আমের গুটি ঝরে পড়ায় ফলন কম হওয়ার আশঙ্কা করছেন আমচাষিরা। নওগাঁর সাপাহার উপজেলার গোডাউনপাড়া এলাকার একটি বাগানে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন 

প্রতিনিধি নওগাঁ: রায়হান আলম এক দশকের বেশি সময় ধরে আম চাষে যুক্ত। নওগাঁর সাপাহার উপজেলার তিলনা ইউনিয়নের দোয়াশ গ্রামে তাঁর বাড়ি। গতবারের তুলনায় এবার আমগাছে মুকুল এসেছিল দেরিতে এবং ধরেছেও কম। তারপরও বাগানে গাছে গাছে যে পরিমাণ আম ধরেছিল, তাতে ভালো ফলনের আশা করেছিলেন। কিন্তু কিছু দিন ধরে তীব্র খরায় আমের গুটি ঝরে পড়েছে। রায়হানের কপালে চিন্তার ভাঁজ দেখা দিয়েছে। খরায় গুটি ঝরে পড়ায় আমের উৎপাদন কম হওয়ার আশঙ্কা করছেন এই আমচাষি।

রায়হান আলম বলেন, ‘যেসব বাগানে ঢালা সেচ দেওয়ার সুবিধা আছে, ওইসব বাগানে আমের গুটি কম ঝরে পড়ছে। বাগানে সেচ দেওয়ার কারণে ওই সব বাগানে আমের আকারও বড় হয়েছে। তার তুলনায় সেচ–সুবিধা নাই, এমন বাগানগুলোয় গুটি বেশি ঝরে পড়ছে। আমের আকারও ছোট রয়েছে। সহসা বৃষ্টি না হলে আমের উৎপাদন কম হবে।’

রায়হানের মতো নওগাঁর শুকনা অঞ্চল হিসেবে পরিচিত পোরশা, সাপাহার ও পত্মীতলা উপজেলার আমচাষিরা প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে এবার আমের ফলন কম হওয়ার আশঙ্কা করছেন। খরার কবল থেকে আমের ঝরে পড়া রোধ করতে বাগানে ঢালা সেচ, আমগাছে পানি স্প্রেসহ নানা পদ্ধতি অবলম্বন করছেন। কিন্তু তাতেও গুটি ঝরে পড়া ঠেকানো যাচ্ছে না। এতে বিপাকে পড়েছেন চাষিরা।

আমচাষিরা বলছেন, ঢালা সেচ ও গাছে পানি ছিটিয়ে হয়তো গুটি ঝরে পড়া পুরোপুরি রোধ করা সম্ভব নয়। এ ধরনের খরা অব্যাহত থাকলে গুটি ঝরতেই থাকবে। এতে আমের ফলন কমে যাবে।

■ নওগাঁয় এ বছর আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ৪ লাখ ৩৬ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন।
■ গতবারের চেয়ে ১০ থেকে ১৫ দিন দেরিতে আম পাকবে বলে মনে করছেন চাষি ও কৃষি কর্মকর্তারা।

স্থানীয় কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, জেলায় আম উৎপাদনের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, সেই লক্ষ্যমাত্রা পূরণের ব্যাপারে তাঁরা এখনো আশাবাদী। কৃষি বিভাগের পরামর্শ অনুযায়ী চাষিরা গাছের প্রয়োজনীয় পরিচর্যা করলে আমের গুটি ঝরে পড়া রোধ করা সম্ভব।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর নওগাঁ কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, জেলায় এ বছর ৩০ হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৩৬ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন। গত বছর ৩০ হাজার হেক্টর জমিতে ৩ লাখ ৮৫ হাজার মেট্রিক টন আম হয়েছিল, যা ছিল সারা দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ। উত্তরের অপর দুই জেলা রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের তুলনায় নওগাঁয় হেক্টরপ্রতি আম উৎপাদনের পরিমাণ বেশি। চাঁপাইনবাবগঞ্জে হেক্টরপ্রতি উৎপাদন ৮ মেট্রিক টনের কিছু বেশি, রাজশাহীতে ১১-এর কিছু বেশি। সেখানে নওগাঁয় তা ১৪ মেট্রিক ছাড়িয়ে যায়।

নওগাঁর ১১ উপজেলা মধ্যে সবচেয়ে বেশি আমের চাষ হয়েছে পোরশা উপজেলায় ১০ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে। এরপরই বেশি আম চাষ হয়েছে সাপাহারে ৯ হাজার ২৫০ হেক্টর জমিতে। শুকনা অঞ্চল হিসেবে পরিচিত জেলার নিয়ামতপুর ও পত্নীতলা উপজেলাতেও আম–রাজত্বের পরিধি দিন দিন বাড়ছে।

সাপাহার উপজেলার আমচাষি সাখাওয়াত হোসেন বলেন, একে তো এ বছর আমগাছে মুকুল এসেছে কম, তার ওপর খরায় আমের গুটি ঝরে পড়ছে। খরা থেকে আম ঝরে পড়া রোধ করতে যেসব বাগানে সেচ–সুবিধা আছে, সেগুলোয় ঢালা সেচ দেওয়া হচ্ছে। আবার যেসব বাগানে সেচ–সুবিধা নেই, সেগুলোয় গাছে গাছে পানি ছিটানো হচ্ছে। এতে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে।
এবার দেরিতে পাকবে আম

নওগাঁর বাগানগুলোয় গতবারের চেয়ে ১০ থেকে ১৫ দিন দেরিতে আম পরিপক্ব হবে বলে মনে করছেন স্থানীয় চাষি ও কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা। এর কারণ হিসেবে আমচাষি ও কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, অধিকাংশ আমগাছে সাধারণত ফেব্রুয়ারি মাসে মুকুল আসে। আমগাছে মুকুল আসার সময় এবার নওগাঁয় পুরো ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে অন্যান্য বছরের তুলনায় শীতের তীব্রতা বেশি ছিল। এ কারণে আমগাছে এবার ১০ থেকে ১৫ দিন পরে মুকুল এসেছে। অনেক গাছে আমের মুকুলই আসেনি। গাছে দেরিতে মুকুল আসায় এবার নওগাঁর বাগানগুলোয় গতবারের তুলনায় ১০ থেকে ১৫ দিন পরে আম পরিপক্ব হবে।

কৃষি উদ্যোক্তা হিসেবে জাতীয় যুব পুরস্কার পাওয়া নওগাঁর সাপাহার উপজেলার আমচাষি সোহেল রানা বলেন, ‘এ বছর আমার বাগানসহ নওগাঁর অনেক বাগানেই কিছু কিছু গাছে আমের মুকুল মিসিং (মুকুল ধরেনি) হয়েছে। এ কারণে আমের মুকুল ধরতে এবার ১০ থেকে ১৫ দিন লেট হয়েছে। ফলে নওগাঁর বাগানগুলোয় এবার আম একটু দেরিতে পরিপক্ব হবে। আবার অনেক গাছে মুকুল না আসায় আমের উৎপাদন কমে যাবে। তারপর শুরু হয়েছে খরার কারণে আমের গুটি ঝরে পড়ার সমস্যা। সেচ দেওয়া, পানি স্প্রে করাসহ নানাভাবে আমের গুটি ঝরে পড়া রোধ করার চেষ্টা করে যাচ্ছি। অচিরেই বৃষ্টি হলে এই সমস্যার অনেকটাই সমাধান হয়ে যেত।’

নওগাঁ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘আমের মুকুল আসার সময় দিনের বেলা তাপমাত্রা একটু বেশি থাকলে ভালো। কিন্তু এবার গাছে মুকুল আসার সময় নওগাঁতে তাপমাত্রা প্রয়োজনের তুলনায় কম ছিল। এ কারণে আমের মুকুল ৮-১০ দিন দেরিতে দেরিতে এসেছে। মুকুল দেরিতে আসায় আম পরিপক্বও হবে দেরিতে।’