ট্রেন | প্রতীকী ছবি |
প্রতিনিধি চট্টগ্রাম: প্রায় সাড়ে ১৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত নতুন রেলপথ নির্মাণ করা হয়। ট্রেনও চালু হয় গত বছরের ১ ডিসেম্বর থেকে। ঢাকা থেকে পরপর দুটি ট্রেন দেওয়া হলেও চট্টগ্রামের ভাগ্যে তা জোটেনি।
এদিকে পবিত্র ঈদুল ফিতর উপলক্ষে অল্প সময়ের জন্য গত ৮ এপ্রিল বিশেষ ট্রেন চালু করে রেলওয়ে। এই ট্রেনে যাত্রীর সংখ্যা ও আয়—দুটোই বাড়ছিল। স্থানীয় লোকজন ট্রেনটি স্থায়ীভাবে চালু রাখার দাবি জানিয়ে আসছিলেন। কিন্তু ইঞ্জিন ও জনবলসংকট দেখিয়ে নির্ধারিত সময়ের ১২ দিন আগেই জনপ্রিয় এই ট্রেন বন্ধ করে দেওয়া হলো।
কক্সবাজার বিশেষ-৩ ও ৪ নামে পরিচিত ট্রেনটি সর্বশেষ চলাচল করেছে গত বুধবার। গতকাল বৃহস্পতিবার থেকে এই ট্রেন আর চলছে না। বন্ধ হওয়ার আগে মাত্র ৫২ দিনে এই ট্রেনে যাত্রী পরিবহন করা হয় ৫৪ হাজার ৮১৪ জন। আয় হয়েছে ১ কোটি ৪ লাখ ৪১ হাজার টাকা। অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে আয় হয় দুই লাখ টাকা। রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলে অন্য লোকাল ট্রেনগুলো থেকে এই পরিমাণ আয় হয় না বলে জানা গেছে।
চাহিদা থাকা সত্ত্বেও ঈদুল আজহার আগেই এভাবে হুট করে বিশেষ ট্রেনটি বন্ধ করে দেওয়ায় স্থানীয় মানুষের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। ট্রেনটি স্থায়ী করার দাবিতে স্থানীয় মানুষ স্মারকলিপি দিয়েছিলেন রেলমন্ত্রী, মহাপরিচালকসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে। আশ্বাসও পেয়েছিলেন। রেলওয়ের চট্টগ্রাম বিভাগীয় ব্যবস্থাপকের দপ্তর থেকেও ট্রেনটি চালু রাখতে রেল ভবনকে অনুরোধ জানানো হয়।
ইঞ্জিন ও জনবলের সংকটে শুধু কক্সবাজার বিশেষ ট্রেন নয়, এর আগে করোনার সময় বন্ধ হওয়া ৪২টি লোকাল ট্রেন পরবর্তী সময়ে আর চালু করা যায়নি। একই কারণে রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলে আরও লোকাল ট্রেন বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। রেলওয়ের কর্মকর্তাদের নিয়মিত বৈঠকে এ নিয়ে আলোচনা চলছে। আগামী রোববার এ নিয়ে রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে।
রেলওয়ে সূত্রে জানা যায়, ২০২০ থেকে ২০২২ পর্যন্ত ৩০টি নতুন ইঞ্জিন কেনা হয়েছিল। তারপরও সংকট দূর হয়নি বরং ইঞ্জিন–সংকট প্রকট হয়েছে। আর রেল পরিচালনায় লোকোমাস্টারসহ (ট্রেনচালক) প্রয়োজনীয় জনবলের অভাব রয়েছে। ফলে ট্রেন পরিচালনায় নিয়মিত হিমশিম খেতে হচ্ছে রেলওয়েকে। এ জন্য ট্রেনের সময়সূচি বিপর্যয়ের ঘটনাও ঘটছে।
ট্রেন পরিচালনার সুবিধার্থে বাংলাদেশ রেলওয়ে দুটি অঞ্চলে বিভক্ত। একটি অঞ্চল যমুনা নদীর পূর্ব পাশে, যা পূর্বাঞ্চল রেলওয়ে (ঢাকা-চট্টগ্রাম-সিলেট-ময়মনসিংহ বিভাগ) হিসেবে পরিচিত। আর যমুনা নদীর পশ্চিম পাশ নিয়ে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ে গঠিত (রাজশাহী-রংপুর-খুলনা বিভাগ)।
আশ্বাস ছিল কিন্তু...
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বছরের ১১ নভেম্বর চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত নির্মিত ১০০ কিলোমিটার দীর্ঘ নতুন রেললাইনের উদ্বোধন করেছিলেন। গত বছরের ১ ডিসেম্বর একটি ও চলতি বছরের ১০ জানুয়ারি একটি—ঢাকা থেকে দুটি ট্রেন চালু করা হয়। এই দুটি ট্রেনে চট্টগ্রাম স্টেশন থেকে যাতায়াতের জন্য মাত্র ১১৫টি করে আসন বরাদ্দ রাখা হয়।
চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত বিরতিহীন আন্তনগর ট্রেন চালুর দাবিতে গত ২৪ জানুয়ারি ও ১৫ মে রেলমন্ত্রী ও রেলের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের স্মারকলিপি দেয় চট্টগ্রাম-দোহাজারী-কক্সবাজার রেলওয়ে যাত্রীকল্যাণ পরিষদ। গত ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রাম সফরে এসেছিলেন রেলমন্ত্রী মো. জিল্লুল হাকিম। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, আগামী দুই মাসের মধ্যে চট্টগ্রাম–কক্সবাজার পথে ট্রেন চালু হবে।
মন্ত্রীর পাশে থাকা রেলওয়ের মহাপরিচালক সরদার সাহাদাত আলী বলেছিলেন, ইঞ্জিন ও চালকের সমস্যা প্রকট। এখন যদি চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটে ট্রেন চালু করতে হয়, তাহলে কনটেইনার ট্রেন (পণ্যবাহী ট্রেন) বন্ধ করে দিতে হবে। তবু দুই মাসের মধ্যে অন্তত একটি ট্রেন চালু করা হবে।
অবশ্য ট্রেন চালু করার আশ্বাস বাস্তবে পূরণ হয়নি। ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করে চট্টগ্রাম-দোহাজারী-কক্সবাজার রেলওয়ে যাত্রী কল্যাণ পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আবু সাঈদ তালুকদার বলেন, এই রুটে বিশেষ ট্রেন চালু হওয়ায় স্থানীয় বাসিন্দারা খুব উপকৃত হচ্ছিলেন। অফিস-আদালত ও শহরে যাতায়াতের দুর্ভোগ অনেকটা নিরসন হয়। চাহিদা যখন বেশি, তখনই ট্রেনটি স্থায়ী না করে উল্টো বন্ধ করে দিয়েছে রেলওয়ে, যা কোনোভাবেই উচিত হয়নি। এখন সবার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে কর্মসূচি দেবেন তাঁরা।
চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটের বিশেষ ট্রেনটি চট্টগ্রাম রেলস্টেশন থেকে প্রতিদিন সকাল সাতটায় ছাড়ত। আর কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রামের উদ্দেশে ছাড়ত সন্ধ্যা সাতটায়। সময় লাগত তিন থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টা। যাত্রাপথে ট্রেনটি ১০টি স্টেশনে থামত। এই ট্রেনের সর্বনিম্ন ভাড়া ছিল ১৮৫ টাকা আর সর্বোচ্চ ৩৪০। সড়কপথে যা দ্বিগুণ। বাসের ভাড়া সর্বনিম্ন ৪২০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৮০০ টাকা।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে রেলের মহাপরিচালকের মুঠোফোনে কল করা হলে তিনি সভায় ব্যস্ত বলে জানান।
ট্রেন ছাড়ছে দেরিতে
রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের যে পরিমাণ ট্রেন চলাচল করে, সে অনুযায়ী ইঞ্জিন নেই। এমনকি নতুন ইঞ্জিন কেনা হলেও তা পর্যাপ্ত নয়। আবার বিভিন্ন দুর্ঘটনার কারণে ইঞ্জিন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ব্যবহার উপযোগী করতে সময় লাগছে।
রেলওয়ের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে পূর্বাঞ্চলে রেলপথের মোট দৈর্ঘ্য ১ হাজার ৫০৩ কিলোমিটার। এ অঞ্চলে প্রতিদিন গড়ে ১৫৫টি ট্রেন চলাচল করে। এর মধ্যে আন্তনগর ট্রেন চলাচল করে ৫৪টি। মেইল ট্রেনের সংখ্যা ৬০। লোকাল ট্রেন ৩২। আর পণ্যবাহী ট্রেন ৯টি।
ট্রেন পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তারা বলেন, এসব ট্রেন পরিচালনার জন্য অন্তত ১১৬টি ইঞ্জিন প্রয়োজন। কিন্তু কাগজে-কলমে আছে ১০০টির মতো। নিয়মিত পাওয়া যায় ৮৫ থেকে ৯০টি। এর মধ্যে ট্রেন দুর্ঘটনার কারণে চারটি ইঞ্জিন এ মুহূর্তে ব্যবহার করা যাচ্ছে না। আবার ঢাকা-কক্সবাজার রুটে দুটি এবং ঢাকা-বুড়িমারী রুটে একটি নতুন আন্তনগর ট্রেন চালু হয়েছে। এই তিন জোড়া ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক রাখতে ৫টি ইঞ্জিনের প্রয়োজন। ফলে এখন জোড়াতালি দিয়ে ট্রেন পরিচালনা করা হচ্ছে।
ইঞ্জিনের পর সবচেয়ে জরুরি হলো লোকোমাস্টার (ট্রেনচালক)। পূর্বাঞ্চলে লোকোমাস্টার ও সহকারী লোকোমাস্টার প্রয়োজন ১ হাজার ২৫৪ জন। বর্তমানে আছেন ৫৪৯ জন। পদ খালি রয়েছে ৭০৫টি।
রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিওপিএস) শহিদুল ইসলাম বলেন, জনবলসংকট আগে থেকে ছিল। বিভিন্ন কারণে ইঞ্জিন–সংকট প্রকট হয়েছে। ইতিমধ্যে চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের বিশেষ ট্রেনটি বন্ধ করতে হয়েছে। এর আগে বেশ কিছু ট্রেন বন্ধ করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। এরপরও সংকট রয়ে গেছে।
স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে ট্রেনে করে গন্তব্যে পৌঁছাতে বেশি সময় লাগছে। আর দুর্ঘটনা ঘটলে সময়সূচির বিপর্যয় ঘটে। গত ১৭ মার্চ কুমিল্লার নাঙ্গলকোটের হাসানপুর রেলস্টেশন-সংলগ্ন ঢালুয়া ইউনিয়নের তেজের বাজার এলাকায় চট্টগ্রাম থেকে জামালপুরগামী বিজয় এক্সপ্রেস ট্রেনের নয়টি বগি লাইনচ্যুত হয়। বগি ও ইঞ্জিন উদ্ধারে তিন দিন সময় লাগে। ২০টির বেশি ট্রেনের সময়সূচির বিপর্যয় ঘটে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ট্রেন দাঁড়িয়ে ছিল বিভিন্ন স্টেশনে। ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক হতে তিন দিন সময় লাগে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও পরিবহনবিশেষজ্ঞ মো. সামছুল হক মনে করেন, জনগণের টাকায় প্রকল্প বাস্তবায়নের পরও কাউকে জবাবদিহি করতে হয় না বলেই এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। তিনি বলেন, উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রতিটি পদে রেলের দর্শনের ঘাটতি রয়েছে। তারা অবকাঠামোগত উন্নয়নে যতটা আগ্রহী, অপারেশন বা পরিচালন কার্যক্রমে ততটা আগ্রহী নয়। ফলে মানুষ সুফল পাচ্ছে না। যাঁদের কারণে মানুষ সেবা পাচ্ছে না, তাঁদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।