বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ভোট দিতে লাঠিতে ভর দিয়ে আসেন অশীতিপর সাহিদা বেগম। আজ সকালে বামুনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

প্রতিনিধি বগুড়া: তৃতীয় ধাপে আজ বুধবার বগুড়া সদর, শাজাহানপুর ও শিবগঞ্জ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়েছে। ভোট গণনা শেষে সদর উপজেলায় আনারস প্রতীকের চেয়ারম্যান প্রার্থী শুভাশীষ পোদ্দারকে বেসরকারিভাবে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়েছে।

সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফিরোজা পারভীন রাত আটটার দিকে উপজেলা পরিষদের অস্থায়ী নিয়ন্ত্রণকক্ষ থেকে এই ফলাফল ঘোষণা করেন। তবে শাজাহানপুর ও শিবগঞ্জ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের ভোট গণনা তখনো চলছিল।

সদর উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে তিন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। জেলা যুবলীগের সভাপতি শুভাশীষ পোদ্দার আনারস প্রতীকে ৩৫ হাজার ৭৭১ ভোট পেয়েছেন। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বর্তমান চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবু সুফিয়ান ঘোড়া প্রতীকে ২৪ হাজার ১৮৫ ভোট পেয়েছেন। এই উপজেলায় ভোট পড়েছে ১৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ।

এদিকে ব্যালটে প্রতীক–বিভ্রাটের কারণে বগুড়া সদর উপজেলায় ভাইস চেয়ারম্যান পদে ভোট গ্রহণ স্থগিত করা হয়েছে। সকাল ৮টায় ভোট গ্রহণ শুরু হলেও প্রায় আড়াই ঘণ্টা পর সাড়ে ১০টার দিকে ভাইস চেয়ারম্যান পদে ভোট গ্রহণ স্থগিত করার সিদ্ধান্ত জানায় নির্বাচন কমিশন। একই সঙ্গে রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব থেকে অতিরিক্ত জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা সৈয়দ আবু ছাইদকে অব্যাহতি দেওয়ার কথাও জানানো হয়। তাঁকে অপসারণের সত্যতা নিশ্চিত করে জেলা জ্যেষ্ঠ নির্বাচন কর্মকর্তা মাহমুদ হাসান বলেন, রিটার্নিং কর্মকর্তাকে মৌখিকভাবে অপসারণের কথা নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে। তবে এ বিষয়ে এখনো কোনো লিখিত আদেশ আসেনি। লিখিত আদেশ না আসা পর্যন্ত তিনিই (সৈয়দ আবু সাঈদ) দায়িত্ব পালন করবেন।

বগুড়ার জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বলেন, ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী ইফতারুল ইসলামকে ‘কাঠি আইসক্রিম’ প্রতীক বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এর বদলে ব্যালট পেপারে ‘কুলফি আইসক্রিম’ প্রতীক ছিল। এ বিষয়ে প্রার্থী মৌখিকভাবে অভিযোগ করেছিলেন। বিষয়টি নির্বাচন কমিশনকে জানানো হয়। পরে কমিশন থেকে ওই পদে ভোট গ্রহণ স্থগিত করার সিদ্ধান্ত জানানো হয়।

বগুড়া সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ভাইস চেয়ারম্যান পদে ১৬ জন প্রার্থী ছিলেন। এই পদের প্রার্থী ইফতারুল ইসলাম বগুড়া সদর উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক। সকালের দিকে বগুড়া জিলা স্কুল কেন্দ্রে কথা হয় ইফতারুল ইসলামের সঙ্গে। তখন তিনি জানিয়েছিলেন, তিনি ভোটকেন্দ্রে গিয়েছিলেন, তবে ব্যালটে নির্ধারিত প্রতীক না থাকায় ভোট দেননি।

ইফতারুল ইসলাম বলেন, ‘প্রতীক বরাদ্দের সময় রিটার্নিং কর্মকর্তা স্বাক্ষরিত কাগজে কাঠি আইসক্রিমের নমুনা ছবি সরবরাহ করা হয়েছে। সেই অনুযায়ী পোস্টার ছাপানোসহ প্রচারণা চালিয়েছি। এখন ভোট দিতে গিয়ে ভোটাররা ব্যালট পেপারে কাঠি আইসক্রিম খুঁজে পাচ্ছেন না। কাঠি আইসক্রিমের ছবির সঙ্গে কুলফি আইসক্রিমের মিল নেই। এ জন্য আমি কেন্দ্রে গিয়েও ভোট দিইনি। পরে রিটার্নিং কর্মকর্তাকে মৌখিক অভিযোগ করেছি।’

রিটার্নিং কর্মকর্তা সৈয়দ আবু ছাইদ ভোট গ্রহণ শুরুর পর বলেন, নির্বাচন কমিশন থেকে ভাইস চেয়ারম্যান পদে ১২টি প্রতীক পূর্বনির্ধারিত ছিল। কিন্তু বগুড়া সদর উপজেলায় ভাইস চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন ১৬ জন প্রার্থী। অতিরিক্ত চারজনের প্রতীকের কথা উল্লেখ করে নির্বাচন কমিশনে চিঠি দেওয়া হয়েছিল। সেখান থেকে ভুলক্রমে কাঠি আইসক্রিমের বদলে কুলফি আইসক্রিমের ছবিসহ ব্যালট সরবরাহ করা হয়েছে।

সদরে দুই প্রিসাইডিং কর্মকর্তা প্রত্যাহার
দায়িত্ব পালনে গাফিলতি এবং একজন প্রার্থীর পক্ষে কাজ করার অভিযোগে বগুড়া সদরের দুই প্রিসাইডিং কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। দুপুরে বগুড়া শহরের জুবিলী ইনস্টিটিউশনের পূর্ব ও পশ্চিম ভবন কেন্দ্র পরিদর্শনকালে বগুড়ার জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম অনিয়মের সত্যতা পেয়ে ওই দুই প্রিসাইডিং কর্মকর্তাকে ভোটকেন্দ্র থেকে প্রত্যাহারের নির্দেশ দেন। প্রত্যাহার হওয়া ওই দুই প্রিসাইডিং কর্মকর্তা হলেন পূর্ব ভবন কেন্দ্রের মতিউর রহমান ও পশ্চিম ভবন কেন্দ্রের মো. আবু সালেহ।

জানা যায়, বেলা দেড়টার দিকে জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম ও পুলিশ সুপার সুদীপ কুমার চক্রবর্ত্তী জুবিলী ইনস্টিটিউশন কেন্দ্র পরিদর্শনে যান। এ সময় সেখানকার দুটি কেন্দ্রের প্রতিটি বুথে আনারস প্রতীকের একাধিক ‘নির্বাচনী এজেন্ট’ দেখতে পান। এসব এজেন্টের পরিচিতিপত্রে দুই প্রিসাইডিং কর্মকর্তার স্বাক্ষর ছিল। নির্বাচন বিধি অনুযায়ী, প্রতিটি বুথে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর একজন করে এজেন্ট থাকার কথা। দুই প্রিসাইডিং কর্মকর্তা ভুল স্বীকার করলে তাঁদেরকে প্রিসাইডিং কর্মকর্তার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতির নির্দেশ দেওয়া হয়। 

শাজাহানপুরে পৌর কাউন্সিলরসহ আটক ৯
শাজাহানপুর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে দিনভর নানা অভিযোগে ৯ জনকে আটক করা হয়েছে। সকাল ৯টার দিকে শাজাহানপুর উপজেলার আড়িয়া ইউনিয়নের বামুনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে ভোটারদের প্রভাবিত করার অভিযোগে একজন বহিরাগত পৌর কাউন্সিলরকে আটক করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এ ছাড়া টাকা দিয়ে ভোট কেনা, জাল ভোট প্রদানের চেষ্টা, কেন্দ্রের বাইরে ব্যালট নিয়ে আসা, কেন্দ্রে মুঠোফোন ব্যবহারসহ নানা অভিযোগে আরও আটজনকে আটক করা হয়।

বামুনিয়া সরকারি প্রাথমিক কেন্দ্র থেকে আটক পৌর কাউন্সিলরের নাম শুভ ইমরান। তিনি বগুড়ার শেরপুর উপজেলার ১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর এবং শেরপুর পৌর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক।

শাজাহানপুর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট জান্নাতুল নাঈম বলেন, বহিরাগত ওই পৌর কাউন্সিলর আনারস প্রতীকের একজন প্রার্থীর পক্ষে কেন্দ্রে ভোটারদের প্রভাবিত করার চেষ্টা করায় আটক করা হয়েছে।

এ সময় ভোটাররা অভিযোগ করেন, কেন্দ্র ফাঁকা, ভোটার উপস্থিতি তেমন নেই। অথচ এক ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়েও ভোট দেওয়া যাচ্ছে না। তাহলে ভোট দিচ্ছেন কারা?

পরে প্রিসাইডিং কর্মকর্তাকে সঙ্গে নিয়ে ৬ নম্বর বুথে গিয়ে দেখা যায়, সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তার সামনেই ব্যালটে সিল মারছেন একজন ভোটার। বিষয়টি নজরে আনার পর সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা দাবি করেন, ব্যালটে নয়, মুড়ির অপর পৃষ্ঠায় প্রিসাইডিং কর্মকর্তার সিল মারতে ওই ভোটার সহযোগিতা করছেন।

প্রিসাইডিং কর্মকর্তা রায়হান আলী বলেন, সকাল ১০টা পর্যন্ত ৬ নম্বর বুথে ৬৮টি ভোট পড়েছে। কেন্দ্রের ৭টি বুথে ভোট পড়েছে ২৪৯টি।

শাজাহানপুর থানা-পুলিশ সূত্র জানায়, বেজোড়া উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে মুঠোফোন নিয়ে অবস্থানের কারণে তিন এজেন্ট আবু মুত্তালিব, রাজু আহম্মেদ, রাব্বি হাসানকে আটক করা হয়। তাঁরা আনারস প্রতীকের চেয়ারম্যান প্রার্থী সাজেদুর রহমান এবং মোটরসাইকেল প্রতীকের প্রার্থী ও বর্তমান চেয়ারম্যান সোহরাব হোসেনের এজেন্ট। জাল ভোট দেওয়ার অভিযোগে ঢাকন্দা গ্রামের সিদ্দিকুরের স্ত্রী ফাহিমা বেগম আটক হয়েছেন। ব্যালট পেপার বাইরে নিয়ে আসার অভিযোগে বারো আনজুল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে আনারস প্রতীকের সমর্থক সাব্বির হোসেনকে আটক করা হয়েছে। আনারস প্রতীকের পক্ষে টাকা দিয়ে ভোট কেনার অভিযোগে শৈধুকুরী গ্রামের সোহেল রানা ও রাজু আহম্মেদ এবং ভোটকেন্দ্রে মুঠোফোন বহন করায় এজেন্ট মোহাম্মদ আবদুল হামিদকে আটক করা হয়েছে। ভোট গণনা শেষে তাঁদের ব্যাপারে ভ্রাম্যমাণ আদালত সিদ্ধান্ত দেবেন।

শাজাহানপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে চারজন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। তাঁরা হলেন বর্তমান চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি সোহরাব হোসেন, বগুড়া জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি সাজেদুর রহমান, উপজেলা যুবলীগের সভাপতি এম সুলতান আহম্মেদ ও নির্দলীয় প্রার্থী সাদ্দাম হোসেন মোল্লা।