সুন্দরবনে বন বিভাগের টহল ফাঁড়ির টিউবওয়েলের পাশে হাঁড়িতে মৌমাছির জন্য ভরে রাখা হয়েছে পানি। সেখান থেকে পানি সংগ্রহ করছে মৌমাছির দল। ৭ মে সুন্দরবনের ভেতরে বজবজা টহল ফাঁড়িতে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
প্রতিনিধি কয়রা: সুন্দরবনের বজবজা টহল ফাঁড়ির নলকূপ ঘিরে ওড়াউড়ি করছে একদল মৌমাছি। পাশেই বড় একটি হাঁড়িতে পানি রাখা। এতে একটি কাপড়ের একাংশ ডোবানো এবং বাকিটুকু হাঁড়িটির মুখে প্যাঁচানো। ভেজা কাপড়ের চারপাশে বসে মিষ্টি পানি সংগ্রহ করছে হাজারো মৌমাছি। কোনোটি পানি নিয়ে উড়ে যাচ্ছে গহিন বনে নিজের চাকে। আবার কোনোটি উড়ে এসে বসছে ভেজা কাপড়ের ওপর। নলকূপের হাতল ও মুখেও বসেছে বেশ কয়েকটি। মৌমাছিগুলোকে সরিয়ে নলকূপ থেকে পানি সংগ্রহ করছিলেন বনরক্ষীরা। পানি নেওয়ার সময় উড়ে এসে পাত্রে পড়ছিল দু-একটি মৌমাছি। বিরক্ত না হয়ে বরং যত্ন নিয়ে মৌমাছি সরিয়ে দিয়ে পানি নিচ্ছিলেন বনরক্ষীরা।
গত মঙ্গলবার বনের ভেতরে বজবজা ফাঁড়িতে গিয়ে মৌমাছি আর বনরক্ষীদের এই বন্ধন দেখা গেল।
বন গবেষক ও বনরক্ষীরা জানান, এবার বনে বৃষ্টি কম। গাছের ফুলে রস নেই। ফুলগুলো ঝরে যাচ্ছে। এ জন্য মৌমাছিরা যেখানে মিঠাপানি পাচ্ছে, পানি সংগ্রহ করতে সেখানেই ভিড় করছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে অনাবৃষ্টির কারণে এবার এ সংকট দেখা দিয়েছে।
মৌমাছি বিশেষজ্ঞ ও রাজধানীর শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ সাখাওয়াৎ হোসেন বলেন, সাধারণত বন্য মৌমাছিরা যে এলাকায় থাকে, সেই এলাকার ইকোসিস্টেমের সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নেয়। তবে আশপাশে স্বাদুপানির উৎস থাকলে তারা সেদিকে যায়। তখন বৃষ্টির জমে থাকা পানি, চাপকলের দিকে তাদের আধিক্য বেশি দেখা যায়। বৃষ্টি না থাকলে তারা নলকূপের দিকে ধাবিত হয়।
বজবজা টহল ফাঁড়ির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমান মাসখানেক আগে হঠাৎ একদিন সকালে ফাঁড়ির সামনে একঝাঁক মৌমাছি উড়তে দেখেন। ঘরের বাইরে নলকূপের ওপর উড়ছিল। বুঝতে পারেন, পানির জন্য ওড়াউড়ি করছে। তখন থেকে নলকূপের পাশে মৌমাছির জন্য একটি হাঁড়িতে পানি রাখেন।
বন কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বলেন, সুন্দরবনে মিঠাপানির তীব্র সংকট। আশপাশের সব ফরেস্ট স্টেশন ও ফাঁড়িতে পানযোগ্য পানি পাওয়া যায় না। শুধু বজবজা ফাঁড়ির নলকূপের পানি পান করা যায়। এ জন্য দূরদূরান্ত থেকে বনরক্ষীরা ট্রলার নিয়ে পানি নিয়ে যান। এখন যেহেতু মধু আহরণের মৌসুম। এ জন্য মৌমাছিরাও মিঠাপানি নিতে আসে বলে তিনি জানান।
বজবজা ফাঁড়ির প্রবীণ বনকর্মী আবদুল হাই পানির হাঁড়ির দিকে ইশারা করে বলেন, ‘দেখেন, হাঁড়িতে কতটা পানি কমে গেছে! ঘণ্টাখানেক আগে হাঁড়িতে পানি ভর্তি করে দিছিলাম। এখন অর্ধেক শেষ। হাজার হাজার মৌমাছি এভাবে পানি নিয়ে যাচ্ছে। দিনে ৭-৮ বার হাঁড়িতে পানি ভরে দিতে হচ্ছে।’
বনরক্ষী মফিজুল ইসলাম এগিয়ে গিয়ে নলকূপ চেপে আবার হাঁড়িতে পানি ভর্তি করে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে বন বন করে ওড়াউড়ি শুরু করে মৌমাছির দল। হুল ফোটানোর ভয়ে দূরে যেতে চাইলে বনরক্ষীরা বলেন, ‘ভয় নেই, কিছু বলবে না ওরা। মৌমাছিরা বোঝে, আমরা তাদের জন্য ক্ষতিকারক না।’
বজবজা ফাঁড়ি থেকে বেরিয়ে ট্রলারে সুন্দরবনের আন্ধারমানিক টহল ফাঁড়িতে যাওয়ার পথে খালের পানিতে ঝরে পড়া নানা ধরনের ফুল দেখা গেল। তখন ভাটার স্রোত বইছে। বাতাস নেই। চারপাশে সুনসান পরিবেশ। পানি নামছে উত্তর থেকে দক্ষিণে। জোয়ারের সময় জঙ্গলে উঠে পড়া পানি খাল দিয়ে নামতে শুরু করে। পানির সঙ্গে জঙ্গল থেকে নেমে আসছে ঝরে পড়া নানা গাছের ফুল।
সঙ্গে থাকা সুন্দরবনের কাশিয়াবাদ ফরেস্ট স্টেশনের কর্মকর্তা নির্মল কুমার মণ্ডল জানান, ৩১ মে পর্যন্ত সুন্দরবনে মধু আহরণের মৌসুম। এ বছর পর্যাপ্ত বৃষ্টি হচ্ছে না। এ জন্য গাছগাছালির ফুল শুকিয়ে ঝরে যাচ্ছে। মৌমাছি ও কীটপতঙ্গও খাদ্যসংকটে পড়ছে। গত বছরও প্রথম দিকে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। তবে শেষের দিকে ভালোই মধু পাওয়া যায়। সামনে বৃষ্টি হলে মৌমাছির খাদ্যসংকট থাকবে না।
সুন্দরবনসংলগ্ন কয়রা আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হাসানুল বান্না জানান, গত দুই মাস সুন্দরবন ও উপকূলে তীব্র তাপপ্রবাহ ছিল। গড়ে প্রতিবছর সুন্দরবন ও উপকূলে বৃষ্টির পরিমাণ কমছে। সাধারণত সুন্দরবন এলাকায় ২ হাজার ২০০ মিলিমিটার বৃষ্টি স্বাভাবিক। কিন্তু গত বছর গড়ে ১ হাজার ৮১২ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছিল। সাধারণত এপ্রিল ও মে মাসে ২৫৪ মিলিমিটার বৃষ্টি স্বাভাবিক। কিন্তু এবার এপ্রিলে বৃষ্টি হয়েছে মাত্র ২ মিলিমিটার।
আন্ধারমানিক টহল ফাঁড়িতে পৌঁছে সেখানেও মিঠাপানির পুকুরপাড়ে মৌমাছির ওড়াউড়ি দেখা গেল। ঝাঁকে ঝাঁকে মৌমাছি পুকুরপাড়ে পানির একেবারে কাছাকাছি বসে পানি সংগ্রহ করছে। ফাঁড়ির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবদুস সালাম বলেন, পুকুরটি মিঠাপানির হলেও তাঁরা পাশের বজবজা ফাঁড়ির নলকূপ থেকে পানি এনে পান করেন। পুকুরে শুধু গোসল করেন। বন্য প্রাণীরা পুকুরে পানি খেতে আসে। বৃষ্টি কম হওয়ায় এখন সারা দিন পুকুরপাড়ে ঝাঁকে ঝাঁকে মৌমাছি ওড়ে।
বন বিভাগ সূত্র জানায়, ২০২০-২১ অর্থবছরে সুন্দরবন থেকে মধু আহরণ হয়েছিল ৪ হাজার ৪৬৩ কুইন্টাল। মোম ১ হাজার ৩৩৯ কুইন্টাল। ২০২১-২২ অর্থবছরে উৎপাদন কমে মধু ৩ হাজার ৮ কুইন্টাল ও মোম ৯০২ কুইন্টাল, ২০২২-২৩ অর্থবছরে আরও কমে মধু ২ হাজার ৮২৫ কুইন্টাল ও মোম ৮৪৬ কুইন্টালে দাঁড়ায় (১০০ কেজিতে ১ কুইন্টাল)। মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে প্রায় ১ হাজার ৬০০ কুইন্টাল উৎপাদন কমেছে।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের প্রধান অধ্যাপক আবদুল্লাহ
হারুন চৌধুরী বলেন, মূলত এপ্রিল ও মে মাস সুন্দরবনে মধু
আহরণের মৌসুম। তার আগে প্রয়োজনীয় বৃষ্টি হলে গাছে গাছে ফুল ফোটে। কিন্তু
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে অনাবৃষ্টির কারণে গাছে ফুল ফোটার পরিমাণ কমে
যায়। আবার ফুটলেও অনেক ফুল দ্রুত ঝরে যায়। এ জন্য ফুল থেকে মৌমাছি আগের মতো
মধু আহরণ করতে পারে না। আবার মৌমাছিরা সাধারণত লবণপানি সংগ্রহ করে না। এ
জন্য যেখানে মিঠাপানি পাচ্ছে, সেখানে চলে যাচ্ছে। প্রকৃতিতে পর্যাপ্ত খাবার
থাকলে সাধারণত মিঠাপানি বা কৃত্রিম খাদ্যের দিকে মৌমাছি ঝোঁকে না।