ছাত্রলীগের লোগো |
প্রতিবেদক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়: বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) ছাত্ররাজনীতি থাকা না থাকার প্রশ্নে বিতর্কের মধ্যে এবার বেসরকারি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচটি বিভাগে কমিটি ঘোষণা করেছে ছাত্রলীগ। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ–সমর্থক ছাত্রসংগঠনটি এখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তাদের রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড বাড়ানোর পরিকল্পনা নিয়েছে।
ছাত্রলীগ ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে নর্থ সাউথসহ ১৬টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের সাংগঠনিক কমিটি গঠন করেছিল। যদিও সে সময় এর বিরোধিতা করেছিল বেশ কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ। তারা আনুষ্ঠানিকভাবেই জানিয়েছিল যে তাদের ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতির অনুমোদন দেওয়া হবে না।
তবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে কমিটি গঠনসহ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনাকে ‘স্বাভাবিক প্রক্রিয়া’ হিসেবে তুলে ধরছে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। ছাত্রলীগের শীর্ষস্থানীয় নেতারা বলছেন, তাঁরা এখন তাঁদের সাংগঠনিক কার্যক্রম বাড়ানো ও পুনর্বিন্যাস করার কথা ভাবছেন। সে অনুযায়ী কমিটি গঠনসহ নিয়মিত সাংগঠনিক প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখা হবে।
বর্তমানে দেশে ১০৮টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এর মধ্যে ৩৯টিতে ছাত্রলীগের কমিটি আছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিটি বা ইউনিটগুলোর তত্ত্বাবধান করার জন্য ২৩ সদস্যের সম্মিলিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কমিটিও গঠন করেছিল ছাত্রলীগ। ২০২২ সালের নভেম্বর থেকে এই কমিটি কাজ করছে।
এবার বিভাগভিত্তিক কমিটি
নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ কমিটি গঠন করে বছর দেড়েক আগে। এখন সাংগঠনিক কার্যক্রম বাড়ানোর পরিকল্পনার অংশ হিসেবে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভাগভিত্তিক কমিটি গঠন করল ছাত্রলীগ।
গত শুক্রবার নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচটি বিভাগে কমিটি গঠন করেছেন ওই বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি আশিকুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক মাসুদ রানা। এর মধ্যে ব্যবসায় প্রশাসন (বিবিএ) বিভাগে ১৮ সদস্যের, আইন বিভাগে ১২ সদস্যের, সিভিল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং (সিইই) বিভাগে ১০ সদস্যের, ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং (ইসিই) বিভাগে ৯ সদস্যের এবং ফার্মাসিউটিক্যাল সায়েন্স বিভাগে ৪ সদস্যের আংশিক কমিটি করা হয়েছে। আগামী এক মাসের মধ্যে বিভাগগুলোকে পূর্ণাঙ্গ কমিটি করতে বলা হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিরোধিতা
নর্থ সাউথসহ বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ সেই ২০২২ সালে যখন কমিটি করেছিল, তখন এর বিরোধিতা করে একটি চিঠি দিয়েছিল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি (এপিইউবি)। সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যানদের দেওয়া ওই চিঠিতে বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি বলেছিল, ট্রাস্টের অধীন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মূলত সেশনজটমুক্ত অলাভজনক ও অরাজনৈতিক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান। কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি করা যাবে কি না, তা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মে নির্ধারিত হবে।
বেসরকারি আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি-বাংলাদেশ (এআইইউবি) তখন তাদের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে বলেছিল, ‘বিনা অনুমতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম কিংবা লোগো কোনো অনুষ্ঠান, সংগঠন বা কর্মসূচিতে ব্যবহার করা যাবে না।’
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ই-মেইল করে কর্তৃপক্ষ তখন বলেছিল, ‘ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় রাজনৈতিকভাবে একটি নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান এবং কোনো রাজনৈতিক ক্লাব বা সংগঠনকে সমর্থন করে না।’
বেসরকারি ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ (ইউল্যাব), ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি এবং স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির উপাচার্যরাও তখন ছাত্ররাজনীতির বিষয়ে তাঁদের নেতিবাচক মনোভাবের কথা জানিয়েছিলেন৷ তবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০১০-এ ছাত্ররাজনীতির বিষয়ে স্পষ্ট করে কিছু বলা হয়নি।
তবে তখন সেই বিরোধিতা নাকচ করে দিয়েছিলেন ছাত্রলীগের তৎকালীন কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। তাঁদের বক্তব্য ছিল, শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবি আদায়ের জন্য প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতি থাকা উচিত।
ছাত্রলীগের কমিটি ঘোষণার দুই মাসের মাথায় ২০২২ সালের নভেম্বরে নর্থ সাউথসহ ৯টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কমিটি গঠন করেছিল বিএনপি–সমর্থক জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল।
এখন কর্মকাণ্ড বাড়ানোর প্রশ্নে ছাত্রলীগ কী বলছে
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে কমিটি গঠনসহ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনাকে ‘স্বাভাবিক প্রক্রিয়া’ হিসেবে উল্লেখ করেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন। তিনি গতকাল শনিবার বলেন, ‘আমাদের দীর্ঘদিনের সাংগঠনিক কাঠামো কিছু ক্ষেত্রে পুনর্বিন্যাস করা প্রয়োজন। কারণ, শিক্ষাব্যবস্থা ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভূমিকায় অনেক পরিবর্তন এসেছে। এমন পরিস্থিতিতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশেষায়িত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে সার্বিক সাংগঠনিক কাঠামো নিয়ে আমরা চিন্তাভাবনা করছি।’ তিনি এ–ও বলেন, ‘সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারবে, এমন একটি রূপরেখার জন্য আমরা কাজ করছি। যৌক্তিক সময়ে সে অনুযায়ী আমরা সিদ্ধান্ত নেব। সে পর্যন্ত আমাদের নিয়মিত সাংগঠনিক প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে।’
ছাত্ররাজনীতির কারণে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘাতের পরিবেশ সৃষ্টির আশঙ্কার বিষয়ে ছাত্রলীগের সভাপতির বক্তব্য হচ্ছে ছাত্রলীগে থেকে কারও সংঘাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ নেই।
বুয়েটে রাজনীতির প্রশ্নে রূপরেখা তৈরি করছে ছাত্রলীগ
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বুয়েটের শেরেবাংলা হলে শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটে ২০১৯ সালের অক্টোবর। সেই ঘটনায় বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের এক দল নেতা–কর্মীর সাজা হয়েছে। এরপর শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে এক ‘জরুরি বিজ্ঞপ্তির’ মাধ্যমে ক্যাম্পাসে সাংগঠনিক ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করে বুয়েট কর্তৃপক্ষ। কিন্তু গত ২৭ মার্চ বুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতার প্রবেশের ঘটনাকে কেন্দ্র করে ২৯ মার্চ থেকে আন্দোলনে নামেন শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীরা বুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতির বিরুদ্ধে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরেন।
এমন পটভূমিতে ছাত্রলীগের একজন নেতার একটি রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের সেই ‘জরুরি বিজ্ঞপ্তি’র কার্যক্রম স্থগিত করেন উচ্চ আদালত। এর ফলে বুয়েটে ফের ছাত্ররাজনীতি চালুর প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে। তবে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ রাখার অবস্থানেই রয়েছেন।
বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিয়ে ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন বলেন, ‘বুয়েট একটি বিশেষায়িত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সেখানে বিশেষায়িত ছাত্ররাজনীতি হতে হবে। যেহেতু শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের বিষয় রয়েছে, সে কারণে আমরা একটি রূপরেখা দাঁড় করিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে উন্মুক্ত আলোচনা-সংলাপ করে ছাত্রলীগের সাংগঠনিক কাঠামোতে যেতে চাই।’